প্রাণ কাঁদে

মতামত

ফরিদ আহমেদ
23 December, 2020, 09:40 am
Last modified: 23 December, 2020, 10:14 am
এই বছরের ৭ মাসের মধ্যে হারালাম নিজ সম্প্রদায়ের ৫ জনকে। গড়ে প্রায় প্রতি মাসে একজন করে পরিচিত মুখ নেই হয়ে গেল।

করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক শ্রদ্ধেয়-প্রিয়জনদের হারাতে হয়েছে আমাদের। একে একে চলে গেলেন শিক্ষাগুরুগণ। জীবন চলার পথে যাদের আদর্শ গ্রহণ করতে ছেয়েছি সবসময়। পরিবার থেকে শুর করে কাছের বন্ধুদের অনেককে ছিনিয়ে নিয়েছে মহামারী। হারিয়েছি আপনজনদের। এ ব্যথা কি সারবে? হৃদয়ের ক্ষত থেকেই যাবে আজীবন। এই বছরের ৭ মাসের মধ্যে হারালাম নিজ সম্প্রদায়ের ৫ জনকে। গড়ে প্রায় প্রতি মাসে একজন করে পরিচিত মুখ নেই হয়ে গেল। 

শুরু হয় জুন ২০২০-এ, সন্দেশ প্রকাশনীর লুৎফর রহমান চৌধুরী। প্রিয় লুৎফর ভাই।  বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি'র বর্তমান কার্য-নির্বাহী পরিষদের একজন পরিচালক। বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার ৬ মাস আগে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় আমাদের স্মৃতি এখনও তরতাজা রয়েছে। লুৎফর ভাই, আপনাকে নিয়ে কতো খুঁনসুটি করলাম আমরা। লুতু চৌধুরী সম্ভোধন করে আপনাকে রাগাতে চাইলাম কিন্তু উল্টো আমাদের বোকা বানিয়ে সাদরে গ্রহণ করে নিলেন সম্ভোধনটা। কতো সরল আর প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন আপনি! সম্ভবত ২০০৭ সালে নিউ ইয়র্ক বইমেলা এবং টরন্টো বইমেলাতেও অনেক স্মৃতি রয়েছে। আর সমিতি'র সভাপতি হিসেবে ২ বছরের অধিক সময় একত্রে কাজের স্মৃতি তো রয়েছেই। কাজ পাগল মানুষ, আপনি কি করে থাকবেন কাজ ছাড়া?

সর্ব বাঁয়ে জাহাঙ্গীর ভাই

কাছাকাছি সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সুবর্ণ'র আহমেদ মাহফুজুল হক, আমাদের অতি প্রিয় জাহাঙ্গীর ভাই। তাঁর সাথে স্মৃতির কোনো শেষ নেই। '৯২ সালে হবিগঞ্জের হুমায়ূন আহমেদের একক বইমেলায় ৩/৪ দিনের আনন্দ-ফূর্তি। সারা রাত জেগে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা। '৯৪-এ টেকনাফ ভ্রমণ। মজা করার জন্য মাঝ পথে তাকে আর হানিফ ভাইকে ফেলে হুমায়ূন ভাই আমাকে নিয়ে গাড়ি টান দিতে বললেন ড্রাইভারকে। হুমায়ূন ভাই সব সময় তাঁকে আঁতেল প্রকাশক বলতেন। '৯১ বা '৯২ সালের বইমেলায় আপনি হুমায়ূন আহমেদের 'কৃষ্ণপক্ষ' বই বের করলেন। হুমায়ূন আহমেদ মজা করে বললেন, 'এখন আমি লেখক হয়েছি, কারণ জাহাঙ্গীর আমার বই বের করেছে।' আপনি সেই মেলাতে আর একটা চমক দিলেন, শাহরিয়ার কবির ইন্টারভিউ করলেন হুমায়ূন আহমেদের। 'অন্তরঙ হুমায়ূন' নামে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকারের বই। খুব গুছিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন। '৯০ দশকে কতো দিন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বাসায় সময় কাটিয়েছি। '৯৮ সালে হুমায়ূন আহমেদের ৫০তম জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান আয়োজনে একত্রে কতো দৌডাদৌডি। বয়সে অনেক বড হয়েও কখনও আমাদের একলা ছেডে যাননি জাহাঙ্গীর ভাই। ২০২০-২০২২ বর্ষে সমিতি'র নির্বাচনে আমাদের প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নোমিনেশন জমা দিলেন। আমি খুব চাইছিলাম আমার চেয়ে বয়সে বড দুয়েকজন থাকুক এই প্যানেলে আমার মুরুব্বী হয়ে। আপনার শরীর ভালো যাচ্ছিল না তারপরও আপনি আমাদের সঙ্গ দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর থাকলেন না জাহাঙ্গীর ভাই! আমি মুরুব্বীহীন হয়ে গেলাম!

মাঝখান দিয়ে নীরবে নিভৃতে চলে গেলেন আবুল হাসানাত ভাই। অনেক সিনিয়র বিধায় তেমন আড্ডা হয়নি তাঁর সঙ্গে, খুব কম কথা বলতেন। কিন্তু খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিল আমাদের। আমাদের সঙ্গ তাঁর পছন্দ ছিল। নিজে আগ্রহ করে সমিতিতে বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের প্রতিনিধিত্ব করতেন। বেশ কয়েক বার যাওয়া হয়েছিল আপনার বাসায়- সিঁড়ি থেকেই শুরু সব রুমে সাজানো সুন্দর সুন্দর এবং বিখ্যাত সব পেইন্টিং। আপনার প্রিয় এই সব পেইন্টিং আর বন্ধুদের রেখে এভাবে চলে যেতে পারলেন শ্রদ্ধেয় হাসানাত ভাই!

লুৎফর ভাইয়ের সঙ্গে আমি।

নভেম্বরের ২৫ তারিখে জোরে ধাক্কা দিলেন বাহার ভাই। তিন দশকেরও বেশি সময়ের পরিচয়। বাংলাবাজারে আমার যাত্রা শুরুর বন্ধু শিখা প্রকাশনীর কাজী নজরুল ইসলাম বাহার। শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে- পারিবারিক বন্ধু। '৯০ দশেক দেশব্যাপী চষে বেডিয়েছি আমরা বইমেলা নিয়ে। আমরা তিন বন্ধু সবসময় একত্রে, কোথায় না গিয়েছি আমরা? ২০১১-১২, ২০১২-১৩ বর্ষে আমি সমিতি'র নির্বাহী পরিচালক, সভাপতি ইউপিএল-এর মহিউদ্দীন আহমেদ, সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর ভাই আর আমার যুগ্ম-নির্বাহী ছিলেন বাহার ভাই। ২য় বছরে কেউ কেউ চেয়েছিলেন যুগ্ম পদে পরিবর্তন আসুক কিন্তু আমি বলেছিলাম- যতদিন ফরিদ আহমেদ নির্বাহী থাকবে ততদিন বাহার তার যুগ্ম থাকবে। সমিতির রাজনীতি আমাদের তিন বন্ধুকে একত্রে থাকতে দেয়নি। তাই ২০১৮-তে সভাপতি হওয়ার পর আপনি ছিলেন না সহযোদ্ধা হিসেবে। তাতে কী, বন্ধু তো ছিলেন। করোনা শুরুর পর প্রায় প্রতিদিন রাত ও সকালে শুভেচ্ছা জানাতেন ম্যাসেন্জারে। সুযোগ বুঝে ফোনও করতেন। হঠাৎ করেই আপনার ফোন করা বন্ধ হয়ে গেল- আপনি হাসপাতালে। আশায় থাকলাম- সুস্থ হওয়ার পর আবার শুরু হবে আমাদের ফোনালাপ। সেই সুযোগ দিলেন না বাহার ভাই। এ অন্যায়, ভারী অন্যায়!!

আর সজীব সাহা, তোমার কী যাবার বয়স হয়েছিল? করোনা তোমাকেও নিয়ে গেল? মুক্তধারাকে নতুন উদ্যোমে নতুন রূপে সবার সামনে নিয়ে আসার জন্যে তোমার কতো উদ্যোগ। এক শুক্রবার হঠাৎ ফোন করে সকালে চলে এলো আমার বাসায়। দুপুর পর্যন্ত কতো কথা। কবিতা লিখত, ভেতরে একটা নরম শিশু মনও ছিল। ছিল অদম্য ইচ্ছা। নিজ থেকেই এসে বলল, আপনাদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করব। সব কাজেই অনেক আগ্রহ। সেও চলে গেল আমাদের ছেডে ১৮ ডিসেম্বর ২০২০, সকালে।

এ কেমন বিধান সৃষ্টিকর্তা। আমার সমিতির ২০৭ জন সদস্যর মধ্য থেকে ৫ জনকে নিয়ে নিতে হবে আপনার! এই অল্প কয়েকজন সৃজনশীল প্রকাশকদের মনের অবস্থা এখন কতো বিষন্ন- তা সহজেই অনুমেয়।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা- আর নয়। সকল সৃজনশীল প্রকাশককে সুস্থ রাখুন, আনন্দে রাখুন। আমরা সবাই মিলে একত্রে পূর্বের মতো ভবিষ্যতের ফেব্রুয়ারি বইমেলা গুলোতেও পাশাপাশি থাকতে চাই। 
দেশের সকল মানুষ যেন ভালো থাকে- এই প্রার্থনা।

লেখক: ফরিদ আহমেদ
প্রকাশক, সময় প্রকাশন
সভাপতি, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.