পেগাসাস স্পাইওয়্যার ও গুপ্তচরবৃত্তির আন্তর্জাতিক রাজনীতি

মতামত

29 July, 2021, 10:00 pm
Last modified: 29 July, 2021, 09:58 pm
প্রযুক্তি গবেষণা খাতে এত এত বরাদ্দের ফলাফল হিসেবেই ইসরায়েলের হাতে এসেছে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মত প্রযুক্তি, যা গত তিন বছরে বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করে দেশটি বিলিয়ন ডলার অজর্নের সাথে সাথে আরব বিশ্বের সঙ্গেও কূটনৈতিক উষ্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

প্রাচীনকাল থেকেই গুপ্তচরবৃত্তি রাষ্ট্রীয় কাজের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। গুপ্তচরবৃত্তির কল্যাণেই কত কত সম্রাজ্য ভেঙেছে, আবার অন্যদিকে কত সম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়েছে তার হিসাব নেই। প্রাচীন গ্রন্থ ইলিয়ড, বাইবেল কিংবা ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনীগুলোয় বর্ণনা রয়েছে বিচিত্র রকম সব গুপ্তচরবৃত্তিক ঘটনার। তবে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও যে শান্তি আনায়নে গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা গোয়েন্দাগিরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে প্রথম আলোকপাত করা হয়েছিলো চীনা কৌশলী সান জ্যু (Sun Tsu)- এর বিখ্যাত গ্রন্থ "দ্য আর্ট অফ ওয়ার" এবং প্রাচীন ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অর্থমন্ত্রী কৌটিল্যের "অর্থশাস্ত্র" গ্রন্থে। সেই থেকে শুরু। এরপর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবেই গড়ে উঠেছে গোয়েন্দা সংস্থা।

সন্ত্রাসী কিংবা গোপনে রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করতে পারে এমন ব্যাক্তি বা দলের খবরাখবর রাখা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে জনসাধারণের জানমানের নিরাপত্তা দিয়ে রাষ্ট্রগুলো পালন করছে তার মৌলিক দায়িত্ব। তবে জগতে কোনোকিছুই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উর্ধ্বে নয়। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেমন অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা দিয়ে থাকে, তেমনি ব্যাক্তিগত তথ্য চুরির অভিযোগও রয়েছে অনেক সরকারের বিরুদ্ধে যা আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত।

সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব মিডিয়ায়। বলছি, ইসরায়েলী প্রতিষ্ঠান এনএসও প্রস্তুতকৃত "পেগাসাস স্পাইওয়্যার"- এর কথা। বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এতটাই উন্নতি লাভ করেছে যে এখন আর গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রাচীনকালের মত বিশ্বস্ত মানুষকে শত্রুপক্ষের কাছে ছদ্দবেশে পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না। একটি স্পাইওয়্যার প্রতিপক্ষের মোবাইল ফোনে ঢুকিয়ে দিলেই চলে। একটি মানুষের সম্পূর্ণ গতবিধি, সে কখন কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে কথা বলছে, কী কথা বলছে, তার মোবাইল ফোনে সংরক্ষিত সকল প্রকার তথ্য, এমনকি মালিকের অগচরে মোবাইলের ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোনটিও ব্যবহার করে তথ্য পাচারের ক্ষমতা রয়েছে স্পাইওয়্যার পেগাসাসের। 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ বিশ্বের প্রথম সারির কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে পঞ্চাশ হাজার মোবাইল নম্বরের একটি তালিকা, যাদের উপর নজরদারী চালিয়ে আসছিলো পেগাসাস স্পাইওয়্যার ক্রয়কারীরা। এই পঞ্চাশ হাজার মোবাইল নম্বর অনুসন্ধান করে দেখা গেছে এরমধ্যে বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্র প্রধান, প্রধানমন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং রাজ পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। এধরণের নজরদারী এবং ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা ভঙ্গ করা নিঃসন্দেহে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলা যায়।

ছবি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

তবে এনএসও-এর দাবী যেসব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত সেসব দেশের সকারকে তারা এই সাইবার পণ্য আইনত বৈধ উপায়ে রপ্তানি করেছে। এমনকি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গানৎজও বলেছেন, "আমরা সাইবার পণ্য রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছি শুধু বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে বিক্রি করতে এবং শুধু আইনসম্মতভাবে তা ব্যবহারের জন্য।" তবে তথ্য ফাঁসের এই কেলেঙ্কারির ঘটনা ইসয়ায়েল সরকার খতিয়ে দেখবে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেছেন।

ইসরায়েলের পেগাসাস কেলেঙ্গারি এমন একটি সময়ে বিশ্ববাসীর সামনে আসলো যখন মধ্যপ্রাচ্যের আরব মুসলিম দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশ এবং বিশেষত আরব দেশগুলোর সম্পর্ক অনেকটা দা-কুমড়ার মত। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর পার্শ্ববর্তী মিশর ও জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে একাধিকবার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যথাক্রমে সত্তর ও নব্বইয়ের দশকে দেশটির সাথে শান্তিচুক্তি করেছিলো। সেই শান্তিচুক্তির প্রেক্ষিতে শাস্তি স্বরূপ ১৯৭৯ সালে মিশরকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো আরবলীগ থেকে। কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, যেসব আরব রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি নিন্দা জানিয়েছিলো তৎকালীন শান্তিচুক্তির প্রেক্ষিতে, এখন তারাই ইসরায়েলের সাথে উষ্ণ সম্পর্কের পাণি গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, সুদান, বাহরাইন সম্প্রতি ইসরায়েলের সাথে শান্তি ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক মহলে গুঞ্জন শোনা যায় আরব বিশ্বের অঘোষিত নেতা সুন্নি প্রধান সৌদি আরবও গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। এমনকি ইসরায়েলের পেগাসাস স্পাইওয়্যারের অন্যতম ক্রেতা হলো সৌদি আরব, এমন তথ্যও প্রকাশ করেছে লন্ডন ভিত্তিক গার্ডিয়ান। এখন প্রশ্ন হতে পারে ইসরায়েলের কাছে কী এমন আছে যার স্বার্থে আরব মুসলিম দেশগুলোও ইহুদি শত্রু ইসরায়েলের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কে আগ্রহী হচ্ছে? উত্তর হলো 'প্রযুক্তি'। ইসরায়েলের বরাবরই বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে  এগিয়ে। মাত্র এক কোটি জনসংখ্যার দেশ হয়েও ২০১৫ সালে দেশটি মোট জিডিপির প্রায় পাঁচ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করেছিলো যা ছিলো জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সর্বোচ্চ। এছাড়া ২০১৯ সালে ব্লুমবার্গ ইনোভেটিভ ইডেক্সে ইসরায়েলের অবস্থান ছিলো বিশ্বে পঞ্চম।

প্রযুক্তি গবেষণা খাতে এত এত বরাদ্দের ফলাফল হিসেবেই ইসরায়েলের হাতে এসেছে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মত প্রযুক্তি, যা গত তিন বছরে বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করে দেশটি বিলিয়ন ডলার অজর্নের সাথে সাথে আরব বিশ্বের সঙ্গেও কূটনৈতিক উষ্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। পেট্রো ডলার নির্ভর আরব দেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে ইসরায়েলের তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাকৃতিক তেল সম্পদের কল্যাণে আরব মরুভূমির দেশগুলোর জীবনযাত্রা যথেষ্ট বিলাসী হলেও প্রযুক্তি তাদের অন্যতম দুর্বলতা। একাবিংশ শতকে এসে যখন তারা তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহ অন্যান্য খাতে গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবছে, সেখানে বর্তমান ইসরায়েলে প্রতি দশ হাজার কর্মীর বিপরীতে ১৪০ জন বৈজ্ঞানিক এবং গবেষক রয়েছে, যেটা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং প্রতি মিলিয়ন জনসংখ্যার বিপরীতে রয়েছে প্রায় দশ হাজার ফুলটাইম গবেষক।  ইসরায়েল তথা ইহুদি জাতির এমন চৌকশ উন্নয়নের পিছনে রয়েছে প্রায় সাত দশকের অধ্যবসায়। আর সেই অধ্যবসায়, ধৈর্য ও নিষ্ঠা ফল হিসেবে ফিলিস্তিন ইস্যুকে তারা সেই পূর্বের অবস্থানে রেখেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির লোভ দেখিয়ে প্রতিপক্ষ আরবদেরও বশ করতে শুরু করেছে। কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে প্রযুক্তিকে কতখানি ব্যবহার করা যায় ইসরায়েল আধুনিক বিশ্ব রাজনীতিতে তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্যমতে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে টার্গেট করা হয়েছে ভারত থেকে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ এবং তার সরকারের ১৪ জন মন্ত্রী, বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিশেল, ডব্লিউএইচও প্রধান এবং ইটালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রদি সহ ১০ হাজারের মত ফোন নম্বর হ্যাকিংয়ের জন্য টার্গেট করা হয় মরক্কো থেকে। এছাড়া ইরাকের প্রেসিডেন্ট সালিহ এবং লেবাননের সাদ হারিরিকে টার্গেট করা হয়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। 
অর্থাৎ, এখানে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে এক রাষ্ট্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, যদিও বিশ্ব মিডিয়ায় অভিযুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই এই অভিযোগকে অস্বীকার করে যাচ্ছে। অধুনিক যুগের গুপ্তচরবৃত্তিতে এইটাই হলো প্রধান সমস্যা কিংবা সুবিধা। এসব স্পাইওয়্যার বা ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে ডিভাইস হ্যাক করে তথ্য চুরির সময় তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধী সনাক্ত করা যায় না এবং পরবর্তীতে অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণও সংগ্রহ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। আর এই সুযোগেই বর্তমান বিশ্বে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে প্রযুক্তি নির্ভর গুপ্তচরবৃত্তি।

সুতরাং বলা যায়, পেগাসাস স্পাইওয়্যার সব দিক দিয়েই ইসরায়েলের জন্য একটি ট্রাম্পকার্ড হিসেবে বের হয়ে আসলো। একদিকে যেমন এই প্রযুক্তি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ অর্জন হয়েছে, অন্যদিকে কূটনীতিতেও আরব আমিরাত, মরক্কো, বাহরাইনের মত বেশকিছু  দেশের সঙ্গে সত্তুর দশকের বৈরীতার প্রশমন হলো। আর যেহেতু এটা সাইবার প্রযুক্তি সংক্রান্ত ইস্যু তাই এখানে অপরাধ সংগঠিত হলে খুব সহজেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সময় ও চৌকশ গবেষণা। আর এই সময়টুকু চোখ বুঝে থেকে অপরাধ অস্বীকারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর চোখে ধুলো ছিঁটানোর কাজটাই বেশ সময় উপযোগী। 

জান্নাতুল তাজরী তৃষা। স্কেচ: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
  • ইমেইল: trisha.jannat1112@gmail.com

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.