পরিবহন লাইনে সুখ নাইরে পাগল!
পয়ত্রিশ বছরের এক লোক বাসে উঠেছে। কন্ডাকটর এসে ভাড়া চাইলে লোকটি জানালো সে ছাত্র! ভাড়া অর্ধেক তার জন্য। কন্ডাকটার ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলে যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলো-আপনার বয়স কতো? কীসের ছাত্র আপনি? অর্ধেক ভাড়া দিতে লজ্জা করবে না আপনার? লোকটি উত্তর দিলো-আমি তিন বছর ধরে পিএইচডি করছি। এই তিন বছরে চাল, আলু, পিয়াজের মতো বাসের ভাড়া বেড়েছে অনেক, ডিগ্রির দাম বেড়েছে কিনা বুঝতে পারছি না!
লেখাপড়া করে যারা তাদের সবাই 'গাড়িতে' চড়ে না। কেউ কেউ বাসে চড়তে বাধ্য হয়! পিএইচডি ডিগ্রি ঘোড়ার জন্য কিনে পরে নিজের জন্য কিনতে চাইলে বিক্রেতার সরস উত্তর-'এখানে ঘোড়ার জন্য পিএইচডি বিক্রি হয় গাধার জন্য না'-এই গল্পের স্বাদ নিশ্চয়ই অনেকে পেয়েছেন! স্বাধীনতার পর অনেক কিছুতে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া গেছে, সবচেয়ে বেশি স্বাদ পাওয়া গেছে পরিবহন লাইনে! বিশ্বাস না হলে খেয়াল করে দেখবেন অনেক বাস ও ট্রাকের তেলের টাংকিতে লেখা থাকে-পরিবহন লাইনে সুখ নাইরে পাগল!
বেশি স্বাধীনতায় সুখ নষ্ট হয়! স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনী গঠনের শুরুর দিকে তাদের প্রথম কাজের একটি ছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের একটি ট্রেনে যাত্রীদের যাতায়াত ও ভাড়া তদারকি করা। দেখা গেল দু-তিনজন বাদে সব যাত্রী স্বাধীন! কেউ ট্রেনের টিকেট কাটেনি। এর ভেতরে প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন! তবে এখন পর্যন্ত বাস মালিক ও বাসের কর্মচারিরা 'প্রায় স্বাধীন'ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা যখন ইচ্ছে খুশি নিজেদের মতো করে ভাড়া বাড়ান, ইচ্ছে মতো যাত্রী তোলেন! দুই বাসের 'চিপায়' পরে মরে যায় মানুষ! সবক্ষেত্রে শৃংখলা আসলেও পরিবহন লাইনে আসবে কিনা সন্দেহ আছে!
হাল আমলের যাত্রীরা অবশ্য আগের মতো স্বাধীন না। তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে (বাঙালি আজও নাকি লাইনে দাঁড়াতে শেখে নি! আগে কয়েক জায়গায় টিকেট কেটে বাসে উঠতে হতো, করোনার সময় সেসবও উঠিয়ে দেয়া হয়েছে) টিকেট কাটতে হয় অথবা বাস ভাড়া দিতে হয়! প্রতিবছরে অন্ততঃ দু-বার বিদ্যুৎ ও তেলের দাম বাড়ে। সেই হিসেবে গত দশ বছরে বিশ বার বেড়েছে বাস ভাড়া! মানুষের চেহারা দেখে যেমন ভেতরটা বোঝা যায় না তেমনি বাস বা মিনিবাস দেখে বোঝা যায় না সেটা সিএনজিতে নাকি তেলে চলে! সিএনজির ভাড়া না বাড়লেও সিএনজি চালিত বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। ঋতুভেদে ওঠা কিছু সবজি ছাড়া বাংলাদেশে কোন কিছুর দাম একবার বাড়লে সহসা নাকি কমে না! পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের একজন বলেছেন- একটা স্টিকার বানিয়ে বাসের গায়ে লাগিয়ে দিতে হবে যাতে বোঝা যায় কোনটা তেলে চলে আর কোনটা সিএনজিতে! বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছেও 'সিএনজি ও তেল' বাসদের নিয়ে কোন পরিসংখ্যান নেই! বাসযাত্রীদের জন্য অবশ্য একটা যাত্রীকল্যাণ সমিতি আছে যাদের কথা সাধারণ যাত্রীরা আদৌ জানেন কিনা সন্দেহ আছে। এই কল্যাণ সমিতি অবশ্য 'যাত্রীবান্ধব' ভাড়া নির্ধারণ করতে অনুরোধ জানিয়েছে। এরা সবসময় যাত্রীবান্ধব হতে চায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের গণ-পরিবহন নাকি কখনো 'যাত্রীবান্ধব' ছিল না। পরিবহনের সব কিছু নাকি 'মালিকবান্ধব'! মালিকরা বেতন দিয়ে যাত্রী বা বাস শ্রমিকদের সব স্বপ্ন নাকি অল্পদামে কিনে রাখে! ডিজেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশে বাসভাড়া বাড়ে অথচ বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কী করোকালীন সময়ে আদৌ বেড়েছে? যে দায় নেয়া উচিত সরকার বা পরিবহন মালিকদের, সেই দায় চাপিয়ে দেয়া হয় যাত্রীদের ওপর! চাপিয়ে দেয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য কাঁধ বা পিঠ হচ্ছে 'আমপাবলিকের' কাঁধ বা পিঠ! আর শ্রমিকদের কাঁধে বা পিঠে চাপাতে মালিকদের আছে 'ওয়েবিল'!
ওয়েবিল ১৯৮৩-৮৪ সাল থেকেই আছে। দূরপাল্লার বাস ছাড়া যে কোন শহরের লোকাল বাসে টিকেট সিস্টেম ছিল না, ছিল 'খাতা বা ওয়েবিল সিস্টেম'! ধরুন আপনি ফার্মগেট থেকে উত্তরা যাবেন। সরাসরি গেলে সেটাও খাতায় লেখা থাকবে। যদি বনানী কাকলি স্টপেজে নামেন সেটাও লেখা থাকবে। এয়ারপোর্টে গেলেও লেখা থাকবে। খাতা নিয়ে মালিকের লোক স্টপেজে স্টপেজে যেয়ে দেখে আসবে, যাত্রী গুণে একটা হিসেব দাঁড় করাবে। দিনের সব ট্রিপ শেষে চালক ও কন্ডাকটর বাস মালিককে হিসেব বুঝিয়ে দেবে। এই সিস্টেমের নাম ওয়েবিল! প্রত্যেক রুটের সব বাসকে টিকেট সিস্টেমের অধীনে এনে পরিবহনকে ডিজিটাল করতে আরও কতবছর লাগে তা সম্ভবতঃ কেউ বলতে পারবে না। কেউ বলতে পারবে না বাস মালিক ও বাস শ্রমিক এবং এর সংগঠনের নেতারা কবে যাত্রীদের নুন্যতম জবাবদিহিতার অধীনে বাস করতে শিখবেন! কারণ যখন বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা দিতে আপনি বাস বন্ধ করে দেবেন তখন ক্ষতির মুখে পরা বাস মালিক ও শ্রমিকরা যা ইচ্ছে তাই করবে কারণ তাদের আপনি ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করছেন! সুতরাং সরকার যা করবে তার সুযোগ নিয়ে পরিবহন খাত নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করবে আর মাঝখান থেকে ভোগান্তি সব সাধারণ জনগণের! সাধারণ জনগণ চিরকালই দুর্বাঘাস! পাহাড় থেকে নেমে আসা দুই হাতি যখন যুদ্ধ করে তখন যেমন তাদের পায়ের নীচে দুর্বা ঘাস পিষ্ঠ হয় তেমনি দুই হাতি যখন ভালোবেসে রমন করে তখনও দুর্বাঘাস পিষ্ঠ হয়!
এটাই যখন নিয়তি তখন চলুন অন্য কিছু শুনে মন ভালো করি! হোক সেটা কৌতুক, গল্প, ছবি কিংবা গান! মন ভালো রাখুন। দিনশেষে এটাই শরীর ভালো রাখবে। আর সম্ভব হলে বাসের ওপর নির্ভর না করে এগার নম্বরের ওপর নির্ভর করতে শিখুন। ১১ নম্বর হচ্ছে 'হন্টন' পদ্ধতি। হাঁটতে হাঁটতে কাজে যাবেন, হাঁটতে হাঁটতে ফিরবেন। পয়সা হলে একটা কমদামি সাইকেল কিনে নিতে পারেন। সাইকেল চালানোর সময়ে সেই গানটা মনে করবেন-চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া/ ঢাকা শহর দেখমু আজ দুইজনে ঘুইরা ঘুইরা../ওরে ও পাবলিক ভাই সাইকেলের ব্রেক নাই!
প্রবাদ
চীনের কোটি কোটি নাগরিক 'প্রকৃতি বান্ধব' সাইকেল চালায়। চীনের একটা প্রচলিত প্রবাদ এমন- প্রেম সাইকেলের ব্রেক থাকে না! সুতরাং যারা প্রেম করেন তারা সাবধান! শাহ আবদুল করিমের দেহ-তাত্ত্বিক গানও অনেকটা সেই ধাঁচের- চড়িয়া মানব গাড়ি/ যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি/ মধ্যপথে ঠেকলো গাড়ি/ উপায় বুঝি মেলে না../ গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে..!
কৌতুক
এক ছাত্র বাসে উঠেছে। কন্ডাকটর তার কাছে বিশ টাকা ভাড়া চাইলে সে দশ টাকা দিয়ে বললো- আমি ছাত্র! কন্ডাকটর পেছনের সিটে গেলে তাকে একজন পাঁচ টাকা দিয়ে বললো- আমি ঐ ছাত্রের শিক্ষক! কন্ডাকটর অবাক হওয়ার ভান করলে শিক্ষক পরিচয় দেয়া যাত্রীর সাথে বসা আরেক যাত্রী ছোঁ মেরে কন্ডাকটরের কাছ থেকে পনের টাকা নিয়ে বললো- আমি ছাত্রের বাপ। এই টাকা আমার প্রাপ্য!
ছবি ও গান
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিবহনকে নিয়ে সিনেমা আছে। বাংলাদেশের এক সিনেমার নাম-জনতা এক্সপ্রেস। আলোচিত এক ছবির নাম-ড্রাইভিং মিস ডেইজী। গাড়ি চলে নার মতো গানও কম নেই। জনপ্রিয় আরেকটি গানের কথা এমন- ওকি গাড়িয়াল ভাই কতো রবো আর পন্থের পানে চাইয়া, মার্কিন তথা ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষের কাছে জনপ্রিয় আরেকটি গান হচ্ছে- ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস..
গল্প
ট্রাকচালক বাসকে আর বাসচালক ট্রাককে গোণে। বাকিরা নাকি ধইঞ্চা। একারণে তারা মাইক্রোবাসকে ডাকে প্লাাস্টিক। সাধারণ ছোট গাড়িকে তারা প্লাস্টিকও বলে পলিথিনও বলে! এগুলোকে ধাক্কা দেওনের আগেই পলিথিনের লাহান উইরা যায়। রাস্তা দিয়ে উইড়া উইরা ডোবায় যাইয়া সেজদা দেয়।
বাস ড্রাইভারদের জীবনে নাকি অনেক গল্প থাকে! বলা হয়ে থাকে যারা দূর পাল্লার বাস চালায় তাদের বউ থাকে ঘাটে ঘাটে। বউরা বুজরুকি করলেই নাকি ড্রাইভারদের মাথা খারাপ হয়, দুর্ঘটনা ঘটে! সম্ভবত এ কারণে ট্রাকের পেছনো লেখাই থাকে - সংকেত দিন। ১০০ হাত দূরে থাকুন। ঙক। এই ঙক মানে কী? মানে হচ্ছে ঙৎরমরহধষ করষষবৎ!
- লেখক: রম্যলেখক