নারীর ভোটাধিকার ও শ্রেণি সংগ্রাম: রোজা লুক্সেমবুর্গ

মতামত

অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
09 March, 2021, 01:30 pm
Last modified: 09 March, 2021, 01:31 pm
অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমাজের শাসক শ্রেণির নারীরা জনগণের ভেতরের কোনো স্বাধীন শ্রেণি নয়। তাদের একমাত্র সামাজিক কাজ হলো শাসক শ্রেণির স্বাভাবিক প্রচারের ক্রীড়নক হওয়া।

জার্মানিতে কর্মজীবী নারীদের জন্য কোনো সংগঠন নেই কেন? কেন আমরা মেহনতি, শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলন বিষয়ে এত কম শুনতে পাই? এসব প্রশ্ন নিয়েই জার্মানিতে সর্বহারা নারী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এমা ইহেরের ১৮৯৮ সালে তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধ 'শ্রেণি সংগ্রামে মেহনতি নারী (ওয়ার্কিং ওমেন ইন দ্য ক্লাস স্ট্রাগল)'-এর সূচনা করেন। সেই থেকে চৌদ্দ বছর পার হতে না হতেই কিন্তু শ্রমজীবী নারীর আন্দোলনের বিপুল সম্প্রসারণ আমরা দেখছি। দেড় লাখেরও বেশি নারী ইউনিয়নগুলোতে সংগঠিত হয়েছেন এবং তারা সর্বহারার অর্থনৈতিক লড়াই বা সংগ্রামে সবচেয়ে সক্রিয় বাহিনী হিসেবে কাজ করছেন। রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হাজার হাজার নারী সামাজিক গণতন্ত্র বা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ব্যানারে র‌্যালী করছেন: সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক নারীদের কাগজের রয়েছে (দাই গেইশহিট, ক্লারা জেটকিন সম্পাদিত) এক হাজারের বেশি গ্রাহক; সোশ্যাল ডেমোক্রেসির প্ল্যাটফর্মে নারীর ভোটাধিকার অন্যতম প্রধান ইস্যু।

ঠিক এই ঘটনাগুলোই আপনাকে নারীর ভোটাধিকারের জন্য লড়াইয়ের গুরুত্বকে খাটো করে দেখাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আপনি ভাবতে পারেন: নারীর সম-রাজনৈতিক অধিকার ছাড়াই আমরা নারীকে শিক্ষিত এবং সংগঠিত করার কাজে বিপুলভাবে অগ্রসর হয়েছি। সুতরাং, নারীর ভোটাধিকার বিশেষ জরুরি নয়।

আপনি যদি এভাবে ভেবে থাকেন, তবে প্রতারিত হবেন। গত পনের বছরে সর্বহারা নারীর রাজনৈতিক এবং গোষ্ঠীগত জাগরণ সত্যিই চমকপ্রদ। তবে এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র অধিকার বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও শ্রমজীবী নারীর তরফ থেকে রাজনীতি এবং সংসদেও তাদের শ্রেণিগত লড়াইয়ে তাজা আগ্রহ জারি রাখার কারণে। সর্বহারা নারী তারই শ্রেণির পুরুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে সমাজে টিকে আছে এবং পুরুষের ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে সে পরোক্ষভাবে অংশ নেয়।

শ্রমজীবী শ্রেণির বিপুলসংখ্যক নারী ও পুরুষ ইতোমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারাভিযানকে তাদের উভয়ের আগ্রহের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করেছে। সামাজিক গণতন্ত্রী বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সব নির্বাচনী বৈঠক বা মিটিংয়ে মেয়েরা বিশাল সংখ্যায় উপস্থিত হয়, কখনো কখনো তারা এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবেও উপস্থিত হয়। তারা সদা আগ্রহী এবং গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

যে সমস্ত অঞ্চলে একটি দৃঢ় সামাজিক গণতন্ত্রী বা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব অঞ্চলেই মেয়েরা নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সাহায্য করে। এবং নারীরাই লিফলেট বিতরণ করা থেকে শুরু করে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সংবাদপত্রের গ্রাহক হওয়ার মাধ্যমে অমূল্য ভূমিকা রেখেছে। কেননা লিফলেট বিতরণ এবং পার্টিজান সংবাদপত্রের গ্রাহক হওয়া যে কোনো নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। 

পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া রাষ্ট্র নারীকে তার রাজনৈতিক জীবনের সব কর্তব্য ও প্রচেষ্টা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। প্রতি পায়ে পায়ে এই রাষ্ট্রকে বাধ্য করা হয়েছে নারীকে তার ইউনিয়ন এবং সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণের অধিকার মঞ্জুর করতে।

এখনো পর্যন্ত নারীর একটি রাজনৈতিক অধিকারই অস্বীকৃত: ভোটদানের অধিকার, আইনসভা ও প্রশাসনে জন প্রতিনিধি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং নিজেও সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানে একজন নির্বাচিত সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণের অধিকার। তবে ঠিক এই জায়গাটায় এসে, সমাজের আর দশটা জায়গার মতোই, পিতৃতন্ত্রের মূল সুরটা হয়ে দাঁড়ায়: 'এখনই সবকিছু শুরু করো না!'

কিন্তু সবকিছু তো শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্র যখনই সর্বহারা নারীকে সভা-সমিতি ও রাজনৈতিক নানা সমিতিতে অংশগ্রহণের অধিকার দিয়েছে, তখনই আসলে প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গেছে। এবং রাষ্ট্র এই অধিকার স্বেচ্ছায় দেয়নি; দিয়েছে নিতান্ত প্রয়োজনের জায়গা থেকে এবং উদীয়মান, শ্রমজীবী শ্রেণির অপ্রতিরোধ্য চাপের মুখে।

সর্বহারা নারীর আবেগময়, সজোর ধাক্কা উপেক্ষা করতে না পেরেই এই প্রুশো-জার্মান পুলিশ রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে 'নারীর জন্য একটি বিভাগ' রাখতে এবং মেয়েদের জন্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দরজা খুলে দিতে। আর এভাবেই হাতের মুঠোয় থাকা বলটি গড়াতে শুরু করল। সর্বহারার শ্রেণি সংগ্রামের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিই শ্রমজীবী নারীর অধিকারকে রাজনৈতিক জীবনের ঘূর্ণিজলে উড়িয়ে এনেছে। ইউনিয়ন এবং সভা-সমিতি করার অধিকারকে ব্যবহার করার মাধ্যমে, সর্বহারা নারী সংসদীয় জীবন এবং রাজনৈতিক প্রচারাভিযানে সক্রিয়তম একটি অবস্থান নিয়েছে। আজ শুধুমাত্র এই আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য এবং যৌক্তিক ফলাফল হিসেবেই লাখ লাখ সর্বহারা নারী বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারে: আমাদের ভোটাধিকার দাও, দিতে হবে!

একটা সময় ছিল, যখন কি না সেই প্রাক-১৮৪৮ সালের রাজতন্ত্রী কর্তৃত্ববাদের সময়ে গোটা সর্বহারা শ্রেণিকেই বলা হতো- তারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার অনুশীলনের জন্য যথেষ্ট পরিণত নয়। আজকের সর্বহারা নারী সম্পর্কে এই অপরিণত থাকার কথা আর বলা যাবে না, যেহেতু ইতোমধ্যে তারা তাদের রাজনৈতিক পরিণত মনস্কতার প্রমাণ দিয়েছে। 

সবাই জানে, সর্বহারা নারীর প্রাণবন্ত সাহায্য ছাড়া ১৯১২ সালের ১২ জানুয়ারির নির্বাচনে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি কিছুতেই এই গৌরবোজ্জ্বল বিজয় অর্জন করতে পারত না। কিছুতেই এই চার লাখ পঁচিশ হাজার ভোট তারা পেত না।

যে কোনো মূল্যেই হোক, শ্রমজীবী শ্রেণিকে সর্বদাই জনতার সফল, বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সংগঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তার প্রয়োজনীয় পরিণত মনস্কতার প্রমাণ রাখতে হয়। শুধুমাত্র যখন সিংহাসনে উপবিষ্ট জাতির সেরা ও মহত্তম মানবেরা সর্বহারার কড়া পড়া হাতের মুঠো তাদের চোখের ওপর এবং সর্বহারার হাঁটুর চাপ তাদের বুকের ওপর অনুভব করলেন, তখনই কেবল তারা গণমানুষের রাজনৈতিক 'পরিণত মনস্কতা'য় প্রত্যয় অনুভব করতে পারলেন। এবং সেটা তারা করতে পারলেন বজ্রের গতিতে।

আজ সর্বহারা নারীর সময় এসেছে এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে তার 'পরিণত মনস্কতা' বোঝানোর। আর এটা সম্ভব শুধুমাত্র ধারাবাহিক, শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে, যাকে কি না সর্বতোভাবে সর্বহারার সংগ্রাম এবং জোর ব্যবহার করতে হবে। 

নারীর ভোটাধিকার হলো লক্ষ্য। তবে এই ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণআন্দোলন গড়ে তোলা নারীর একার কাজ নয়। বরং এটি সর্বহারা নারী ও পুরুষ উভয়ের অভিন্ন শ্রেণিস্বার্থের বিষয় হওয়া উচিত। জার্মানিতে এখনো নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত না হওয়া হচ্ছে জনজীবনে প্রতিক্রিয়ার শেকলের শেষ গিঁটটি বিদ্যমান থাকা। এবং প্রতিক্রিয়ার আর একটি স্তম্ভের সঙ্গে এই শেকলের গিঁটটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত: আর সেই স্তম্ভ হলো রাজতন্ত্র। তাই এই বিশ শতকের অগ্রসর পুঁজিবাদী ও বিপুলভাবে শিল্পোন্নত জার্মানিতেও এবং এই বিদ্যুৎ ও বিমানের যুগেও নারীর ভোটাধিকার বা সমান রাজনৈতিক অধিকারের অভাব হচ্ছে 'সিংহাসনে দৈবী শক্তির' উপস্থিতির মতোই অতীতের প্রতিক্রিয়াশীল অবশিষ্টাংশ টেনে চলা। এই উভয় ধারণাই- স্বর্গের উত্তরাধিকার সম্রাটেরই দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা হিসেবে মান্যতা এবং উনুনের পাশে অচঞ্চল বসে থাকা এবং জনপরিসরের ঝড়-বাদলা, রাজনীতি ও শ্রেণি সংগ্রাম সম্পর্কে আজো অজ্ঞাত বহু নারী- এই উভয়েরই শেকড় রয়েছে অতীতের পচা-গলা ব্যবস্থার সঙ্গে, যখন এ দেশে গ্রামে ছিল ভূমিদাস প্রথা আর শহরগুলোতে ছিল বণিকদের গিল্ড বা সঙ্ঘ।

সেই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তা-ও না হয় এক ধরনের দরকার বা যুক্তিগ্রাহ্যতা ছিল। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশ যখন রাজতন্ত্র এবং নারীর অধিকারহীনতার শেকড় ধরে টান দিচ্ছে, তখনো অতীতের এসব অচল প্রথার উত্তরাধিকার খুবই হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের আজকের এই আধুনিক সমাজেও যে এই রাজতন্ত্র এবং নারীর ভোটাধিকারহীনতা বিদ্যমান, সেটা শুধু এই কারণে নয় যে, মানুষ এসব প্রথা উচ্ছেদ করতে ভুলে গেছে অথবা চারপাশের অলস স্থিতিই এর কারণ।

না, এই দুই প্রথা- রাজতন্ত্র ও নারীর ভোটাধিকার তথা রাজনৈতিক অধিকারহীনতা রয়ে যাওয়ার কারণ, এগুলো কিছু মানুষের ক্ষমতার পাশা খেলার জন্য আজো কার্যকরী। রাজ সিংহাসন ও রাজবেদীতেই গেথে আছে সর্বহারার শোষণ ও দাসত্বের মন্দতম ও নিষ্ঠুরতম প্রবক্তারা, যারা নারীর রাজনৈতিক ক্রীতদাসত্বেরও সমর্থক। রাজতন্ত্র  ও নারীর অধিকারহীনতা তাই শাসক পুঁজিবাদী শ্রেণির হাতের সবচেয়ে বড় দুই হাতিয়ার।

সত্যি কথা বলতে, আমাদের রাষ্ট্র শ্রমজীবী নারী এবং শুধুমাত্র শ্রমজীবী নারীর কাছ থেকেই ভোটাধিকার দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। একদম ঠিকঠাকভাবেই তাই এই রাষ্ট্র বুঝতে পারে, তারা শ্রেণি শাসনের ধারাবাহিক প্রতিষ্ঠানগুলো- যেমন, সেনা শাসনবাদ (সর্বহারা নারী এক্ষেত্রে সাহায্য তো করবেই না, বরং মারণ শত্রু হবে), রাজতন্ত্র, মুদি দোকান থেকে ক্রয়যোগ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যাদির ওপর কর ও শুল্কের নামে প্রাতিষ্ঠানিক ডাকাতির মতো লুটে-পুটে খাবার ব্যবস্থাগুলো সবই আক্রমণের মুখে পড়বে, যদি শুধুমাত্র শ্রমজীবী নারী তার ভোটাধিকার পায়।

বিদ্যমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাছে নারীর ভোটাধিকার তাই একটি বিভীষিকা ও ঘৃণার বিষয়, যেহেতু নারী ভোটাধিকার পেলেই লাখ লাখ নারী এই রাষ্ট্রের শত্রু বা বৈপ্লবিক সামাজিক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে। এটা যদি বুর্জোয়া নারীর ভোটাধিকারের বিষয় হতো, তবে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিক্রিয়ার পক্ষে কার্যকরী সমর্থন ছাড়া আর কিছুই আশা করত না। 

অধিকাংশ বুর্জোয়া নারী, যারা 'পুুরুষ অগ্রাধিকার'-এর বিরুদ্ধে সিংহীর মতো আচরণ করেন, এরাই শুধুমাত্র ভোটাধিকার পেলে রক্ষণশীল, কেরানিসুলভ প্রতিক্রিয়ার শিবিরে বাধ্য মেষ শাবিকার মতো দুলকি কদমে ঘুরতেন। বরং তারা তাদের শ্রেণির পুরুষদের থেকে আরও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হবেন। খুব অল্প কিছু বুর্জোয়া নারী (যাদের চাকরি বা পেশাগত আয় আছে) ছাড়া অধিকাংশ নারীই সামাজিক উৎপাদনে অংশ নেন না। বস্তুতঃ তারা তাদের পুরুষেরা সর্বহারার কাছ থেকে যে উদ্বৃত্ত শ্রম নিংড়ে নেয়, তার সহ-ভোগী ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা সমাজদেহের পরগাছারও পরগাছা। এবং এই সহ-ভোগীরাই প্রায়শই শ্রেণি শাসন এবং বঞ্চণার প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিদের চেয়েও নিজের পরগাছা জীবনের 'অধিকার' রক্ষায় আরও বেশি নিষ্ঠুর ও ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। সব বড় বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস এই বিষয়টি ভয়ানকভাবে নিশ্চিত করে থাকে।

উদাহরণ হিসেবে ফরাসি বিপ্লবের কথাই ধরুন। জ্যাকোবিনদের পতনের পর র‍্যোঁবসপীয়েরকে যখন ফাঁসিকাঠের সামনে শেকলে বেঁধে আনা হলো, তখন বিজয় মদিরায় মাতাল বুর্জোয়া স্বৈরিণীরাই রাস্তায় আনন্দে নেচেছে এবং বিপ্লবের পরাজিত বীরের পাশ দিয়ে নিলাজ আনন্দ করেছে। এবং প্যারিসে, ১৮৭১ সালে, যখন কমিউনের বীর শ্রমিকেরা মেশিনগানের সামনে পরাজিত হলো, তখন দমিত সর্বহারাদের প্রতি পীড়ন ও প্রতিশোধে আনন্দোমত্ত বুর্জোয়া নারীরা তাদের পাশবিক পুরুষদেরও ছাড়িয়ে গেল। 

সম্পত্তির মালিক শ্রেণির নারীরা সর্বদাই শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চণা ও দাসত্বকে উন্মত্তের মতো সমর্থন করবে, যেহেতু এভাবেই তারা পরোক্ষভাবে তাদের সামাজিকভাবে অকার্যকর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমাজের শাসক শ্রেণির নারীরা জনগণের ভেতরের কোনো স্বাধীন শ্রেণি নয়। তাদের একমাত্র সামাজিক কাজ হলো শাসক শ্রেণির স্বাভাবিক প্রচারের ক্রীড়নক হওয়া।

অন্যদিকে, সর্বহারা শ্রেণির নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে থাকে। সমাজের জন্য তারা পুরুষের মতোই উৎপাদনক্ষম। এই উৎপাদনক্ষমতা বলতে আমি সর্বহারা নারী যে তাদের জীবনসঙ্গীর খুব কম বেতনে ঘরের কাজ ও শিশু পালনের কাজটা করে থাকে, তাকে বোঝাচ্ছি না। এ ধরনের কাজ এই কারণেই হালের পুঁজিবাদী দুনিয়ার নিরিখে উৎপাদনমূলক নয় যে যত বিপুল পরিমাণ ত্যাগ এবং শক্তিই মেয়েরা ঘর-গৃহস্থালীর কাজে ব্যয় করুক না কেন, হাজার হাজার এমন যত ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার খুব একটা মূল্য দিনের শেষে তৈরি হয় না।

সবকিছুর পরও একজন শ্রমিকের ঘর-গেরস্থালীর কাজে ব্যয়িত শ্রম, তার সুখ ও আনন্দ নিতান্ত তার ব্যক্তিজীবনের বিষয় এবং সেজন্যই আমাদের বর্তমান সমাজে এই ব্যক্তিগত বিষয়ের আলাদাভাবে দৃশ্যমান হবার কোনো বাস্তবতা নেই। যতদিন পুঁজিবাদ ও বেতন ব্যবস্থা শাসন করবে, ততদিন শুধুমাত্র উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টিকারী কাজকেই উৎপাদনমূলক মনে করা হবে, যা পুঁজিবাদী মুনাফার জন্ম দিতে সক্ষম। মূলত এই দৃষ্টিকোণ থেকেই মিউজিক হল বা সঙ্গীতানুষ্ঠানের হলঘরে যে নর্তকীর পা তার মালিকের পকেট মুনাফায় ভারি করে, সে উৎপাদনমূলক কর্মী হলেও, প্রলেতারীয় স্ত্রী বা মায়েদের ঘরের চার দেয়ালের ভেতর বসে করা সব কাজই অনুৎপাদনমূলক হিসেবে পরিগণিত হতে বাধ্য। 

এ কথা শুনতে নিষ্ঠুর ও পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে; কিন্তু বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিহিত নিষ্ঠুরতা ও উন্মাদনা বা পাগলামির সাথেই এটা হুবহু খাপ খায়। এবং এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে পরিষ্কার ও তীক্ষ্ণভাবে অবলোকন করাটাই হলো সর্বহারা নারীর প্রথম কাজ। 

ঠিক এ কারণেই সর্বহারা নারীর কণ্ঠে সম-রাজনৈতিক অধিকারের দাবি দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। আজ লক্ষ লক্ষ সর্বহারা নারী ঠিক পুরুষের মতোই পুঁজিবাদী সমাজের জন্য মুনাফা তৈরি করছে- কারখানা, ওয়ার্কশপ, ক্ষেত, কুটির শিল্প, অফিস এবং স্টোর বা বিপণী বিতানগুলোয়। এজন্যই তারা আমাদের বর্তমান সমাজে কঠিনতম বৈজ্ঞানিক অর্থেই উৎপাদনমূলক।

পুঁজিবাদ দ্বারা বঞ্চিত নারীদের সংখ্যা রোজই বাড়ছে। শিল্প অথবা প্রযুক্তিতে প্রতিটি নতুন প্রগতি পুঁজিবাদী মুনাফা অর্জনের কল-কবজায় নতুন জায়গা সৃষ্টি করে দেয়। আর তাই শৈল্পিক অগ্রগতির প্রতিদিনের এবং প্রতিটি পদক্ষেপ নারীর সম-রাজনৈতিক অধিকারের দৃঢ় ভিত্তি রচনায় একটি করে নতুন পাথর যোগ করে।

বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিজের জন্যই শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। পিতৃতান্ত্রিক 'পারিবারিক বৃত্তে'র সংকীর্ণ, নির্বাসিত বা বিচ্ছিন্ন নারী শিল্প ও বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজনীতির ক্ষেত্রেও জরুরি দরকারগুলোর খুব কমই উত্তর দেয়।

এ কথা সত্যি, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রেও তার দায়িত্বে অবহেলা করেছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইউনিয়ন এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক বা সামাজিক গণতন্ত্রী সংগঠনগুলোই নারীর মন ও নৈতিকবোধের জাগরণে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এমনকি কয়েক দশক আগেও, সামাজিক গণতন্ত্রী বা সোশ্যাল ডেমোক্রাটরা সবচেয়ে দক্ষ ও বুদ্ধিমান জার্মানকর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল। একইভাবে, ইউনিয়নগুলো এবং সামাজিক গণতন্ত্র আজ সর্বহারা নারীকে তার দমবন্ধ করা, সংকীর্ণ অস্তিত্ব থেকে তুলে এনেছে; তুলে এনেছে মেধাহীন ঘর-সংসারের কাজ সামলানোর তুচ্ছ আবর্ত থেকে।

সর্বহারার শ্রেণি সংগ্রাম তাদের জীবনের দিগন্তকে প্রসারিত করেছে, মনকে করেছে নমনীয়, চিন্তাকে করেছে বিকশিত এবং তাদের দেখিয়েছে তাদের প্রচেষ্টার অভীষ্ট, মহান লক্ষ্যাবলী। সমাজতন্ত্র লাখ লাখ সর্বহারা নারীর নতুন মানসিক জন্মদান করেছে এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটাই তাদের পুঁজির জন্য সক্ষম, উৎপাদনমুখী কর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছে। 

উপরোক্ত সব প্রেক্ষিত বিবেচনায় এ কথা বলা যেতেই পারে, প্রলেতারিয়েত নারীর রাজনৈতিক অধিকারহীনতা একটি ভয়ানক অবিচার এবং আজকের দিনে এটি অর্ধেক মিথ্যারও বেশি- যেহেতু সবকিছুর পরও অসংখ্য নারী রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।

যাহোক, সামাজিক গণতন্ত্রপন্থীরা তাদের যুক্তি-তর্কে 'অবিচার' কথাটা ব্যবহার করেন না। এটাই আমাদের ভেতরে এবং আগের ভাবালু, কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের ভেতরের পার্থক্য। আমরা শাসক শ্রেণির ন্যায়বিচারের ওপর নির্ভর করি না; কিন্তু পুরোপুরি নির্ভর করি সর্বহারা জনতার বৈপ্লবিক ক্ষমতার ওপর এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রবাহে যা এই ক্ষমতার ভিত্তিভূমি তৈরি করে। এভাবেই অবিচার নিজেই নিঃসন্দেহে কোনো যুক্তি না যার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু যদি সমাজের বিশাল অংশগুলোয় অবিচারের কোনো বোধ কাজ করে, সেক্ষেত্রে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস মনে করেন, সমাজের অর্থনৈতিক ঘাঁটিগুলোর লক্ষণযোগ্য জায়গা বদল সেই অবিচারবোধের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় এবং সেইসঙ্গে এই আস্থাও জাগায় যে, বিদ্যমান শর্তগুলো উন্নয়ন যাত্রার বিপরীতে দণ্ডায়মান।

লক্ষ লক্ষ প্রলেতারিয়েত নারী, যারা মনে করছেন রাজনৈতিক অধিকার বা ভোটাধিকারের অভাব তাদের প্রতি রয়ে যাওয়া এক প্রবল অন্যায়, তাদের গড়ে তোলা বর্তমান, শক্তিশালী আন্দোলনই বিদ্যমান ব্যবস্থার পচে যাওয়ার ইঙ্গিত। ইঙ্গিত যে, শাসকদের দিন ফুরিয়ে আসছে।

আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগে, ফরাসি চার্লস ফ্যুরিয়ের, সমাজতন্ত্রী ভাবাদর্শসমূহের আদিতম ভবিষ্যদ্বক্তাদের একজন, এই স্মরণযোগ্য পংক্তিগুলো লিখেছিলেন: যে কোনো সমাজেই নারীমুক্তির মাত্রা সেই সমাজের সর্বজনীন মুক্তি পরিমাপের স্বাভাবিক মাপকাঠি। এই কথা আমাদের বর্তমান সমাজের জন্যও পুরোপুরি সত্য। নারীর রাজনৈতিক অধিকারের জন্য বর্তমান গণসংগ্রাম সর্বহারার মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত সর্বজনীন সংগ্রামের একটি প্রকাশভঙ্গী ও অংশ। এই সংগ্রামেই নিহিত রয়েছে এর শক্তি ও ভবিষ্যৎ। সর্বহারা নারীর কারণেই সকল নারীর জন্য সর্বজনীন, সমান ও প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের দাবি নিঃসীম মাত্রায় অগ্রসর হবে এবং সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামকে ঘনীভূত করবে। এ জন্যই বুর্জোয়া সমাজ নারীর ভোটাধিকারকে এতটা ভয় পায় ও ঘৃণা করে। এবং সেজন্যই আমরা এটা চাইব এবং অর্জন করব।

নারীর ভোটাধিকারের জন্য লড়াই সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণের এগিয়ে আসাকে তরান্বিত করবে, যখন বিদ্যমান সমাজ কাঠামো সর্বহারার হাতুড়ির আঘাতে গুঁড়িয়ে যাবে।


  • রোজা লুক্সেমবুর্গ: ৫ মার্চ ১৮৭১-১৫ জানুয়ারি ১৯১৯; জার্মান মার্কসবাদী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও যুদ্ধবিরোধী কর্মী
    [১৯১২ সালের ১২ মে তিনি জার্মানির স্টুটগার্ডে নারীদের র‍্যালিতে এ বক্তব্য দেন]

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.