তাদের ক্ষোভ অন্যায্য নয়

মতামত

21 June, 2020, 11:00 pm
Last modified: 22 June, 2020, 01:41 am
নিম্নমানের পিপিই'র কারণে নিজের সুরক্ষা নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার জবাব ছিল তাই সোজাসাপ্টা, 'জানি, আজ নয়তো কাল আমি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি। ভাগ্য সহায় হলেই শুধু রক্ষা পাওয়া সম্ভব।'

স্বাস্থ্যকর্মীদের অত্যাবশ্যক সুরক্ষার নাজুক অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন।

শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) দেশে চিকিৎসক ও নার্সদের মাঝে কোভিড-১৯ দ্রুত সংক্রমণের দায় চাপিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের ওপর।

সংগঠনটির মতে, নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) কারিগরি ত্রুটি ও চিকিৎসকদের অপ্রতুল প্রশিক্ষণ এভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী।

মন্ত্রীর কাছে চিকিৎসকদের এ রকম কড়া তিরস্কার পাঠানো কি ন্যায়সঙ্গত? করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মন্ত্রণালয় পরিচালিত কার্যক্রমের হীন ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিতে একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে চলুন মহামারি মোকাবেলায় সরকারের বহু ব্যর্থতা ও বিএমএর হতাশার যুক্তিসঙ্গত চিত্র আঁকা যাক।

তিন মাস আগে ওই চিকিৎসক একটি জেলা হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে যখন ঢাকার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে আসেন, নিজের নতুন কর্মস্থলের অবস্থান সম্পর্কে তার ধারণা ছিল খুবই কম। গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে হাসপাতালটিতে তিনি পৌঁছেন; ততদিনে সেটি করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য 'ডেডিকেটেড' হাসপাতাল হয়ে ওঠেছে।

সাধারণ ছুটির দিনগুলোতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা যখন ঢাকার বাসায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন, তখন বাসার ভেতরে থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার 'বিলাসিতা' তার ভাগ্যে জুটেনি। প্রতিদিন হাসপাতালে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসাসেবায় ১০-১২ ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে তাকে।

গত মাসে তার সঙ্গে আলাপকালে জানতে চেয়েছিলাম, কোভিড-১৯ রোগীদের এত কাছাকাছি এত বেশি সময় কাটানোর ফলে তার মনে কোনো ভয় কাজ করে কি না। নিম্নমানের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) কারণে নিজের সুরক্ষা নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার জবাব ছিল তাই সোজাসাপ্টা, 'জানি, আজ নয়তো কাল আমি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি। ভাগ্য সহায় হলেই শুধু রক্ষা পাওয়া সম্ভব।'

না, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভাগ্য ছাড় দেয় না। তিনি এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একটি হোটেলে আইসোলেশনে রয়েছেন, যে হোটেলকে কয়েক মাস আগে চিকিৎসকদের আবাসস্থল হিসেবে নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।

করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় 'পজিটিভ' আসার আগে থেকেই, এই অস্থায়ী আবাসনে তিনি গত দু'মাস ধরে রয়েছেন; এই দীর্ঘ সময়ে নিজের ছোট দুটি সন্তানের সঙ্গে দেখা হয়নি তার।

তার গল্প ব্যতিক্রম কিছু নয়। অনেক চিকিৎসক ও নার্সের গল্পও একই রকম। বাড়ি ও পরিবার থেকে দূরে এসে, কোভিড-১৯ রোগীদের জীবন রক্ষায় লড়াই করে যাচ্ছেন তারা; এই নায়কোচিত প্রচেষ্টা তাদের নিজেদের জীবনকেই ঠেলে দিয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে।

মহামারি ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মুখসারির যোদ্ধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তারা। এই বিপত্তির সামনে তারা এতটাই অরক্ষিত, খুব সহজেই সংক্রমিত হতে পারেন।

প্যাথোজেন, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, মানসিক চাপ, অবসাদ, পেশাগত পরিশ্রান্তি, স্টিগমা, এবং শারীরিক ও মানসিক সহিংসতাও যুক্ত হয়েছে এই বিপত্তিতে।

দুর্ভাগ্যক্রমে, কোভিড-১৯-এর মতো মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সময় নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে মাস্ক, গ্লাভস ও গাউনসহ প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) তাদের দেওয়া হয়নি।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ (বিএইচডব্লিউ) প্রকাশিত সাম্প্রতিক দুটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী এখনো পিপিই পাননি; অন্যদিকে, যারা পেয়েছেন, তাদের ৪৪ শতাংশই এর মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন।

তার মানে, পরিস্থিতি তিন মাস আগে যা ছিল, এখনো তা-ই। মার্চ থেকে এপ্রিলে হেলথ ওয়াচের করা এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ২৫ শতাংশ চিকিৎসক ও নার্স এবং ৬০ শতাংশ সহায়তাকর্মীর পিপিই ঘাটতি রয়েছে।

পিপিইর মান নিয়ে গত তিন মাসে এত যে হৈচৈ হলো, আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সময়ে করেছে কী?

সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো স্পষ্ট জানান দেয়, চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় একেবারেই উদাসীন।

অবশ্য, একটা কাজ মন্ত্রণালয় দক্ষতার সঙ্গেই করেছে। এপ্রিলে এক নির্দেশনা জারির মাধ্যমে চিকিৎসক ও নার্সদের কণ্ঠরোধ করে দিয়েছে, যেন তারা পিপিইর ঘাটতির ব্যাপারে গণমাধ্যমে মুখ খুলতে না পারেন।

এন৯৫/কেএন৯৫/এফএফপি২ ফেস মাস্ক ও পিপিইর সরবরাহ ঘাটতি প্রসঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে নোয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসা কর্মকর্তা সেটির সুপারিনটেনডেন্টের কাছ থেকে 'কারণ দর্শানো'র নোটিশ পেয়েছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে একটি সতর্কবার্তা জারি করেছেন। ২২ এপ্রিল তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কর্মকর্তাদের কথা বলা বারণ করে নির্দেশনা দেন; বলেছেন, এর অন্যথা হলে সেটি সরকারি নীতিমালার বিরোধিতা হবে।

চিকিৎসকদের কণ্ঠরোধ করে তার মন্ত্রণালয় আদতে কী পেল? এ প্রশ্নের উত্তর শুধু মন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই ভালো জানেন।

কিন্তু চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বিএমএ যখন জানায়, দেশে এ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এ ১ হাজার ১০০ চিকিৎসকসহ সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ৪৪ জন মারা গেছেন, তখন বাস্তবতাকে বিবর্ণ লাগে।

বিএমএ'র ওই চিঠিতে বলে হয়েছে, বাংলাদেশ ছাড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত আর কোনো দেশে এত বেশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হননি কিংবা মারা যাননি। তার মানে এটি একটি মাইলফলক; অথচ এমন মাইলফলকে তো আমরা কোনোদিনই পৌঁছতে চাইনি।

আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো ব্যাখ্যা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে হয়তো রয়েছে। কিন্তু কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়ে স্রেফ বুলি কপচালে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না।

কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের খামখেয়ালি কর্মকাণ্ডের কারণে নিজে জীবন বিপন্ন হতে না দেওয়ার অধিকার দেশের অন্য সব নাগরিকের মতো রয়েছে প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মীরও- হোন তিনি চিকিৎসক কিংবা নার্স কিংবা মেডিকেল স্টাফ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মীর রয়েছে মানসম্মত পিপিই পাওয়ার অধিকার। নিজেদের জীবন কিংবা স্বাস্থ্য কোনো আসন্ন ও গুরুতর ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মস্থল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার অধিকারও তাদের রয়েছে।

কোনো রকম প্রয়োজনীয় রিমেডিকেল অ্যাকশন নেওয়ার আগ পর্যন্ত, জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর বিপজ্জনক- এমন কর্ম পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের ফিরিয়ে নিয়ে পারবে না, ১৯ মার্চ প্রকাশিত গাইডলাইনে এ কথা জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনের শর্তাবলিতে থাকা অধিকার ভোগের অধিকার কি আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের নেই?

বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও, ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের অবস্থান এখনো আমাদের অজানা। আর কত মাস লড়তে হবে, আমরা জানি না। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ধারণা করছেন, আগামী বছরও এই ভাইরাসের সঙ্গেই বসবাস করতে হতে পারে আমাদের।

একটি ব্যাপার পরিষ্কার: ভাইরাসটি দিন-দিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, আরও প্রাণহানী ঘটাচ্ছে, এবং প্রতিদিন আক্রান্ত করছে হাজারও মানুষকে।

এমন অনিশ্চয়তার কালে একেকজন স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু একেকটি অপূরণীয় ক্ষতি। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি আক্রান্তের ঘটনা তিন মাস আগের তুলনায় বর্তমানে আরও অনেক বড় হয়ে ওঠা এই যুদ্ধে আমাদের শক্তি আরও খর্ব করে দেয়।

আমাদের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে এটা বুঝতে হবে। বড় বড় কথা বলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে কারও কোনো লাভ হবে না।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.