চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগের নেপথ্য কারণ ভিন্ন!

মতামত

17 April, 2021, 05:35 pm
Last modified: 17 April, 2021, 05:36 pm
কেবলমাত্র শোনা কথার উপরে অথবা সামান্য, অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই ধরনের অভিযোগ তোলা মানে বিশ্ববাজারের জন্য বিপদ তৈরি করা।

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তুলা উৎপাদনকারী দেশ চীন। পৃথিবীতে উৎপাদিত তুলার ৫০% উৎপাদিত হয় ভারত ও চীনে। তবে ভারত সামান্য কিছু পরিমাণ বেশি উৎপাদন করে চীন থেকে। ৫০ শতাংশের মধ্যে ভারতে ২৬ শতাংশ, চীনে ২৪ শতাংশ। এরপরে রয়েছে ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র। ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র ২১ শতাংশের মতন তুলা উৎপাদন করে। এ দুই দেশের তোলা উৎপাদন প্রায় সমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলার প্রধান ক্রেতা চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল পৃথিবীর প্রধান তুলা রপ্তানিকারক দেশ। চীন প্রায় ১১.৫ মিলিয়ন বেল তুলা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ক্রয় করে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের তুলা ক্রয়ে দ্বিতীয় স্থানে, তুলা কেনে প্রায় সাত মিলিয়ন বেল।

 ২০০৯ সালে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি সংগঠন গড়ে ওঠে তার নাম হচ্ছে বিসিআই [Better Cotton Initiative]। পৃথিবীব্যাপী এখন তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার। এরসঙ্গে আছে তুলা উৎপাদক চাষী, তুলার ব্যবহারকারী; যারা সুতা থেকে কাপড় বানায়। আমাদের দেশের নিট গার্মেন্টস প্রস্তুতকারকদের বিসিআই সার্টিফাইড তুলা থেকে তৈরি সুতা সংগ্রহ করতে হয়, যা প্রধানত ভারত থেকে আমরা সংগ্রহ করে থাকি।

পৃথিবীর ২৪ শতাংশ তুলা চীন উৎপাদন করার পরেও চীনের বার্ষিক আমদানি প্রয়োজন ১১.৫ মিলিয়ন বেল (৪৮০ পা: প্রতি বেল)। চীনের উৎপাদিত গার্মেন্টস পৃথিবীর মূল বাজার দখল করে আছে। পৃথিবীর বড় ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাকের খুচরা বিক্রেতাদের প্রধান বাজার এখন চীন।  H&M একটি বড় ব্র্যান্ড। বিশ্বব্যাপী ৭৪টি দেশে এদের ৫০০০ খুচরা বিক্রয় কেন্দ্র আছে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেক বড় ব্র্যান্ড Nike মিলে অভিযোগ নিয়ে এসেছে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ নিয়ে। অভিযোগটি হলো চীন সরকার সেখানে তুলা চাষে শ্রমিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক কাজে বাধ্য করছে।

যেখানে চীনের ৮৭% তুলা উৎপাদন হয়, সেখানে ফোর্স লেবার ব্যবহার করা হচ্ছে এই অভিযোগের ফলে H&M এবং অন্যান্য ব্র্যান্ড চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উৎপাদিত তুলার‌ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এর পরেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠন ব্যাপক প্রচারণায় নামে। তারা এই রিপোর্টকে ভুয়া বলে উল্লেখ করে এবং চীনের বাজারে তাদেরকে বয়কটের আহ্বান জানায় চীনের যুব কমিউনিস্ট লীগ। এই আহ্বানের ফলে দেখা যায় চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাট থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় H&M-কে। উইচ্যাট চীনের খুচরা বিক্রেতাদের একটি যোগাযোগ মাধ্যমও। এই ঘোষণার ফলে চীনের বাজারে H&M-এর বিক্রির ওপর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া নেমে আসে।

সুইডেন জন্ম নেওয়া H&M খুচরা পোশাকসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রীর বিক্রেতা। এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম ১৯৪৭ সনে। সুইডেনের বাইরে ডেনমার্কে প্রথম প্রতিষ্ঠানটি খুচরা পোশাক বিক্রির দোকান খুলেছিল ১৯৬৪ সালে। পরবর্তীকালে খুচরা বাজারে ব্যাপক সাফল্যের হাত ধরে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে পৃথিবীর পোশাকশিল্প। 

H&M-এর সঙ্গে একই রকম প্রভাব নিয়ে আছে স্প্যানিশ কোম্পানি ZARA।

H&M পৃথিবীর বহু দেশে তাদের পোশাক সামগ্রী উৎপাদন করে। চীন, বাংলাদেশ ভারত, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোসহ সর্বত্রই পোশাক খাতে তাদের ব্যাপক উত্থানের ফলে বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে এই কোম্পানিটি। ফলে তাদের এই ঘোষণার পরে বিশ্বব্যাপী সব খুচরা পোশাক বিক্রেতা এক গভীর উদ্বেগের মধ্যে পড়ে যায়।

এরপরেই বিসিআই তাদের অভিযোগের বিষয় অনুসন্ধানে নামে। বিসিআই নামক এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম সুইজারল্যান্ডে ২০০৯ সালে। পৃথিবীতে তাদের প্রায় ২১ হাজার সদস্য আছে। সদস্যদের মধ্যে তুলা চাষী, সুতা প্রস্ত্তুতকারী এবং পোশাক উৎপাদনকারীদের ব্যবসা পরিচালনায় এই প্রতিষ্ঠানটির অর্থাৎ বিসিআই সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। মূলত তুলা চাষের নানান প্রান্তরে যে সমস্ত অনিয়ম রয়েছে সেগুলো পরিশুদ্ধ করাই ছিল এ প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য। কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর অবস্থানে পৌঁছাতে পারে নাই বিসিআই নামক এই প্রতিষ্ঠান। তবে আমাদের দেশের সুতা উৎপাদনকারীদের মধ্যে যারা নিট গার্মেন্টস তৈরি করে তাদেরকে এই বিসিআই সার্টিফিকেট নিতে হয়। এবং যার জন্য বাড়তি পয়সা খরচ করতে হয় তুলার ক্রেতাকে।

H&M-এর ঘোষণার পরেই সাংহাইভিত্তিক বিসিআই প্রতিষ্ঠানটি তাদের একটি গবেষণা রিপোর্ট পেশ করে এবং তারা জানায় যে জিনজিয়ানে অনুসন্ধান করে এই ধরনের কোনো ফোর্স লেবারের ঘটনা  তারা জানতে পারে নাই। অর্থাৎ এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নাই। প্রশ্ন হলো তাহলে H&M এই ধরনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেন নিল? একটা মিথ্যা অভিযোগ কেন তারা বিশ্ব বাজারে প্রচার করল?

বিগত কয়েক বছর অর্থাৎ বলা যায় প্রায় এক দশক চীন আন্তর্জাতিক বাজারে বস্ত্রখাতের নিয়ন্ত্রণে মৌলিক কাঁচামাল তুলা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনের সেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের তুলা উৎপাদনকারী দেশগুলোর জন্য একটা সংকট সৃষ্টি হতে পারে। যদিও চীন এখনো আন্তর্জাতিক বাজারে এক নম্বর ক্রেতা; কিন্তু তার এই দ্রুত উৎপাদনের বিকাশ আন্তর্জাতিক বাজারে তুলা ক্রয়ের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাবে। ফলে প্রধানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত তুলা প্রায় ১১ থেকে ১১.৫ মিলিয়ন বেল। আর তাদের নিজেদের ব্যবহার হয় এক থেকে দেড় মিলিয়ন বেল। এই ১০ মিলিয়ন বেল আন্তর্জাতিক বাজারে তাদেরকে বিক্রি করতে হয়। এবং যার প্রধান ক্রেতা হচ্ছে চীন। সেই কারণে চীনের তুলা উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা বজায় থাকবে, অর্থাৎ চীনের তুলা উৎপাদন ব্যহত হলে লাভ হবে যুক্তরাষ্টের ধারণা করা যায়। চীনের তুলা উৎপাদনের উপর কোন ধরনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলা উৎপাদন বাড়বে এবং বাড়বে তুলার দাম। 

করোনা হওয়ার পূর্বে তুলার আন্তর্জাতিক বাজার নিম্নমুখী ছিল, কারণ চীন দীর্ঘকাল ধরে ক্রমান্বয়ে তার নিজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এবং মূল্যহ্রাস এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছায় যেখানে তুলার দাম ৬০ সেন্টে নেমে এসেছিল। ফলে চাষিরাসহ তুলা উৎপাদনকারী সকল দেশেই আন্তর্জাতিকভাবে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছিল। নতুনভাবে উৎপাদন হ্রাস পাওয়াতে বর্তমান বাজার ৬০ থেকে ৯০ সেন্ট হয়েছে। 

তুলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৃষি। আমরা দেখেছি ট্রাম্প তার নির্বাচনে সহায়তা করার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি'কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তুলা ক্রয়ের জন্য অনুরোধ করেছিল। এ থেকে বোঝা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলার বাজার সংরক্ষিত না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষতিসাধন হবে। H&M এই কাজটি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলার বাজারকে সহায়তা করার জন্যই। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এমনি একটি মিথ্যা সংবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। 

এমন একটি অবস্থান H&M কেন নিল? কোন ভাবনা থেকে H&M এই অভিযোগ উত্থাপন করল? দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমা গণমাধ্যমে জিনজিয়ানে উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের যে গল্প, এটাও তারই একটি অংশ। H&M-এর অভিযোগ বিচার করে উল্টো গবেষণায় দেখা গেছে যে, তুলা চাষিরা জিনজিয়ানে শ্রমিক সংকটে ভুগছে। এমনকি স্বাভাবিক পারিশ্রমিকের থেকে বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে তারা শ্রমিক সংগ্রহ করছে। কাজেই এখানে ফোর্স লেবারের বিষয় কেমন করে আসে তা বোঝা দুঃসাধ্য?

ইউরোপভিত্তিক সংগঠন ফোর্স লেবারের কোনো সন্ধান পায়নি। তাহলে H&M-এর মতন একটি বিশ্বখ্যাত কোম্পানি চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেন অংশ নিল? চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক লড়াই চলছে, H&M-এর অভিযোগ তারই কোনো অংশ কি না তাও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে? বিসিআই তাদের অনুসন্ধানে কিছু পায়নি, বিশ্বখ্যাত অন্যান্য ব্র্যান্ড, যেমন ZARA কিংবা অন্যরা, তারাও কেউ এ বিষয় নিয়ে মুখ খুলেনি। এবং সর্বশেষ ফোর্স লেবার সংক্রান্ত অভিযোগও নিয়েও H&M চুপ। এর ব্যাখ্যা কী? কোনো উত্তর H&M বা Nike দেয়নি।

এ ঘটনায় নতুন করে একটি জিনিস পরিষ্কার হলো- চায়নিজ বাজারের গুরুত্ব। চীন আজকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সেই দেশের বাজার যদি বন্ধ হয় তাহলে পৃথিবীর যেকোনো বড় রিটেইলারের জন্য একটা মারাত্মক ঘটনা। H&M-এর অভিযোগের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি মুখ খুলেছে, প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাট থেকে নিষিদ্ধ হয়েছে H&M। ফলে প্রতিষ্ঠিানটিই এখন উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগ তুলে উল্টো সংকটের মুখে পড়েছে।

একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই ধরনের অভিযোগ কার আগে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তথ্যপ্রমাণ হাতে থাকা জরুরি। কেবলমাত্র শোনা কথার উপরে অথবা সামান্য, অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই ধরনের অভিযোগ তোলা মানে বিশ্ববাজারের জন্য বিপদ তৈরি করা।


  • লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.