কোভিড টেস্ট: জনগণের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হবে, মুনাফা নয়

মতামত

08 January, 2021, 04:40 pm
Last modified: 08 January, 2021, 04:39 pm
'টেস্ট করা জরুরি' কথাটি মেনে নিয়ে যারা টেস্ট করতে চাচ্ছেন, তারা কি সেই সুযোগ পাচ্ছেন?

করোনা প্যানডেমিকের বড় একটি সময় আমরা পার করেছি, এবং এখনো করছি। এর স্বাস্থ্যগত দিক আমাদের চিন্তিত করে এবং বিভিন্নভাবে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, দুরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হলেও যথাসাধ্য এড়িয়ে চলা সবই জনগণের দৈনন্দিন কাজের একটি অংশ হয়ে গেছে।

কারা স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছে এবং কারা মানছে না, তার কোনো জরিপ না হলেও রাস্তাঘাটে মানুষদের দেখে বোঝা যায় এবং চেনাজানাদের মধ্যে এ নিয়ে যথেষ্ট চর্চা যে হয়, তার আভাসও পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শিথিল হয়ে যাওয়া, বেকারত্ব সৃষ্টি, আয় কমে যাওয়া ইত্যাদিও মহামারির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) গত বছরের মার্চ মাস (২০২০) থেকে সতর্কতা জারি করে আসছে এবং তারা একটি কথা বলে যাচ্ছে, প্যানডেমিক রোধ করার পথ 'টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট'। সবার টেস্ট করতে হবে এবং সংক্রমণ শণাক্ত হলেই ব্যবস্থা নিতে হবে। চীনসহ সকল দেশেই করোনা টেস্ট এখনো চলছে। তাতে সংক্রমণ কমছে বলা যাচ্ছে না; তবে করোনা সংক্রমণ পরিসংখ্যানগতভাবে জানতে পারছে এবং তাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সহজ হচ্ছে।

সারা বিশ্বে কোটির ঘরে সংক্রমণ আর লাখের ঘরে সুস্থতা এবং মৃত্যু পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ মাসে ৩ জন শণাক্ত হয়েছিল, জানুয়ারি ২০২১-এর ৬ তারিখ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছে  ৫  লাখ ১৮ হাজার ৮৯৮;  মৃত্যুর সংখ্যা ৭৬৮৭ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এটা ধারণা করা নিশ্চয়ই ভুল হবে না যে, করোনা শণাক্ত টেস্ট করা না হলেও করোনা সংক্রমিত হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি এবং মৃত্যুও সব রেকর্ড করা হয়েছে বলা যাবে না। অর্থাৎ, আমাদের পরিসংখ্যান এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে ফারাক অবশ্যই আছে।

'টেস্ট করা জরুরি' কথাটি মেনে নিয়ে যারা টেস্ট করতে চাচ্ছেন, তারা কি সেই সুযোগ পাচ্ছেন? 

বাংলাদেশে প্রথমে ফ্রি বা বিনা পয়সায় নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালে টেস্ট করা যেত, কিন্তু জুন মাসে একটি সরকারি সার্কুলারে জানানো হলো, করোনা টেস্ট আর বিনা পয়সায় করা যাবে না; বাড়ি থেকে নমুনা আনলে ৫০০ টাকা এবং সরকারি নির্ধারিত কেন্দ্রে গেলে ২০০ টাকা দিতে হবে। কারণ হিসেবে বলা হলো, বিনা পয়সায় টেস্ট করা হচ্ছিল বলে অনেকে কোনো করোনা উপসর্গ না থাকলেও টেস্ট করিয়েছে, সেটা বন্ধ করাই উদ্দেশ্য।

খুব হাস্যকর কারণ এবং যথেষ্ট সমালোচিত হলেও নিয়মটি বজায় থেকেছে। বদলায়নি। শুধু টাকার পরিমাণ কমেছে। কাজেই যে গরিব মানুষ তার করোনা হয়েছে কি না জানার জন্যে টেস্ট করার কথা ছিল, সে এখন তা করবে না। কারণ ২০০ টাকা তার ঘরের খাদ্য যোগানেই লেগে যায়। সে একা টেস্ট করতে গিয়ে তার পরিবারের অন্যদের অভুক্ত রেখে দিতে পারে না।

ভারতের একটি পত্রিকা, 'ক্যারাভ্যান ম্যাগাজিন'-এ (Caravanmagazine.in) ২৩ এপ্রিল ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের শিরোনাম "India's private COVID-19 tests cost highest in South Asia; free in Bangladesh"। সেই সময় বাংলাদেশে ফ্রি টেস্ট করা হচ্ছিল, অন্যদিকে ভারতের বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালে ৪৫০০ রুপীতে Reverse transcriptase  polymerase chain reaction, or RT-PCR টেস্ট করা হচ্ছিল।

প্রবন্ধে বলা হয়েছিল প্রতিবেশি রাষ্ট্রে একই টেস্ট বিনা পয়সায় করা হচ্ছে, এবং ভারতের নাগরিকদের টেস্ট করার ক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে। ভারত সরকারের অনুমোদিত প্রাইভেট হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি হলে তার নিগেটিভ হয়ে বের হতে গিয়ে মোট তিনটি টেস্ট করতে হয়, যার মোট মূল্য আসে ১৩,৫০০ রুপী, যা নিঃসন্দেহে অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। এই একই প্রবন্ধে Institute of Epidemiology, Disease Control and Research (IEDCR)-এর তৎকালীন পরিচালক মীরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, বাংলাদেশ সরকার গরিব নাগরিকদের টেস্ট করাবার জন্যেই বিনা পয়সায় সেবা দিচ্ছে।  

করোনা টেস্ট করতে হলে সরকারি হাসপাতাল শুধু নয়, জনগণের জন্যে সুযোগ রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে টেস্ট করার। বাংলাদেশ সরকার একা সারা দেশের মানুষের টেস্ট করতে পারবে না, এটা ধরে নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালকেও করোনা টেস্ট এবং চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবা সরকারের হাত থেকে এমনিতে ছুটে প্রাইভেট স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ৭৫% চলে গেছে। গ্রামে-গঞ্জেও চিকিৎসা নিতে হলে রোগীদের বাধ্য হয়েই প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে হয়, কারণ দুপুর দুটার পর সরকারি হাসপাতাল ডাক্তারশূন্য হয়ে পড়ে আর সেই সরকারি ডাক্তারই প্রাইভেট ক্লিনিকে বসেন টাকার বিনিময়ে। করোনার প্রথম অবস্থায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে সেবা দেওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, কারণ রোগী আসলে তার করোনা আছে কি না, না জেনে তারা রোগীদের সেবা দেবেন না। এই যুক্তি স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার জন্যে ঠিক থাকলেও পুরো ব্যাপারটা নিয়ে রোগী এবং সেবা প্রদানকারী উভয়ের জন্যেই ভোগান্তির কারণ হয়ে গিয়েছে। 

বর্তমান চিত্রটি একটু ভিন্ন। এখন নির্ধারিত এবং সরকার অনুমোদিত বড় ছোট প্রাইভেট হাসপাতালে করোনা টেস্ট এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে কর্পোরেট হাসপাতালে ব্যবস্থা করা হয়েছে ঢাকা শহরে। সেই সব হাসপাতালে যে কোনো রোগ হলে, চিকিৎসা করার অংশ হিশেবে করোনা টেস্ট করতে হয়। করোনা নেগেটিভ টেস্ট রিপোর্ট ছাড়া চিকিৎসক তাকে সেই রোগের চিকিৎসা দেবেন না। জ্বর হলে তো কথাই নাই। চিকিৎসার প্রয়োজনে করোনা টেস্ট বাধ্যতামূলক করা দোষের হতো না, যদি না প্রাইভেট হাসপাতালে টেস্টের মূল্য সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি না হতো।

বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে আরটি-পিসিআর কোভিড-১৯-এর জন্যে ১০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে, সেখানে বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালে ৩৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা নেওয়া হয়; অর্থাৎ ৩৫০ থেকে ৫০০ গুণ বেশি। করোনা টেস্টের পাশাপাশি অন্যান্য কয়েকটি টেস্ট করতে হয়, যেমন কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC)- এই টেস্টেও সরকারি মূল্য হচ্ছে ৫০ টাকা ৪০০ থেকে ৫৭০ টাকা। প্রাইভেট হাসপাতালে কারো জ্বর হলে চিকিৎসা করতে চাইলে বেশ কয়েকটি টেস্ট করতে দেওয়া হয়, যা শেষ পর্যন্ত মূল্য দাঁড়ায় ১০ থেকে ১১ হাজার টাকায়।

করোনা শণাক্ত হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, এমন কথা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরামর্শ হচ্ছে নিজ বাসায় আইসোলেশনে থাকা এবং প্রোটিনযুক্ত খাবার, ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ এবং নিয়ম মেনে চললে নির্দিষ্ট ১৪ দিন পর টেস্ট করে দেখলে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন রোগীকে অক্সিজেন দিতে হলে, কিংবা ফুসফুসে সংক্রমণ হলে, কিংবা অন্যান্য জটিলতা থাকলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে।

কর্পোরেট হাসপাতালে করোনা ইউনিট করা হয়েছে এবং সেখানে ভালো ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে অনেক সেবা গ্রহণকারী বলেছেন। কিন্তু এই সেবা দিতে গিয়ে যে মূল্য তারা ধরেন, তা রোগীর ওপর বড় একটা চাপ সৃষ্টি করে, হাসপাতালে সপ্তাহ খানেক থাকলে তার বিল আসে কয়েক লাখ টাকা। যদিও এই হাসপাতালগুলোতে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ ডাক্তার চিকিৎসা দিচ্ছেন, এমন দাবী করা যাবে না। সিনিয়র চিকিৎসকরা খুব একটা কোভিড রোগী দেখেন না।

সরকার শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে যে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রয়োজনীয় পরীক্ষায় অনেক বেশি ফি আদায় করছে। যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (৩ জানুয়ারি, ২০২১) জানা যায় যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ১০টি জরুরি পরীক্ষার দাম বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই মূল্য নির্ধারণ রোগীর স্বার্থের চেয়ে বেসরকারী হাসপাতালের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই মূল্য নির্ধারণে বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক মালিক ও ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং কর্পোরেট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সাথে আলোচনা করেই করা হয়েছে। ফলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিদ্ধ্বান্ত মূলতঃ প্রাইভেট হাসপাতালের উচ্চ মূল্যকেই জায়েজ করে দিচ্ছে।

যেমন একটি উদাহরণ হচ্ছে, রক্তের সিবিসি পরীক্ষা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক ভেবে এ পরীক্ষা করাতে ব্যয় হয় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। তাহলে বেসরকারি হাসপাতালের মূল্যেরই গড় করা হলো। অথচ সরকারি হাসপাতালের সিবিসি টেস্টের মূল্য হচ্ছে মাত্র ৫০ টাকা। তাহলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচিত ছিল সরকারি মূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখেই মূল্য নির্ধারণ করা। সেটা বড় জোর ১০০ টাকা হতে পারে, ৫০০ টাকা নয়।

এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি বলা হচ্ছে যারা আগে এর চেয়ে হ্রাসকৃত মূল্যে পরীক্ষা করত তাদের ক্ষেত্রে সেই হ্রাসকৃত মূল্যই প্রযোজ্য হবে। কিন্তু তারা যদি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিদ্ধান্ত মেনে তাদের হ্রাসকৃত মূল্য বাড়িয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে সরকার কী করবে?

কোভিডের মতো একটি সংক্রামক রোগ, যা একটি পরিবারের একজনের হলে অন্য সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, সকলের জন্য যদি সব টেস্ট করতে হয়, তাহলে এই রোগ অর্থনৈতিক মহামারিরও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই অনুরোধ, কোভিড নিয়ে ব্যবসা করুন ঠিক আছে, কিন্তু মুনাফার লোভ কমান।

সরকারের উচিত হবে কোভিড চিকিৎসায় মুনাফার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া।

  • লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.