কালো টাকার আলো, তবেই কি সব ভালো 

মতামত

শাহানা হুদা রঞ্জনা
15 June, 2020, 12:30 pm
Last modified: 15 June, 2020, 01:54 pm
‘আমরা যারা কষ্ট করে, সৎ পথে টাকা আয় করার চেষ্টা করি, তারা জানি কর দেয়াটা কতখানি ভার হয়ে দাঁড়ায় আমাদের মত মধ্যবিত্তের জন্য। বেতন থেকে বড় একটা অংশ চলে যায় সরকারের কোষাগারে।’

দেশের বাড়ি রংপুর থেকে একজন কিশোর গৃহকর্মী এল আমাদের বাসায়। নাম ছিল ঢ্যাড়ামদ্দী। ঢ্যাড়ার দোষ ছিল চুরি করে খাওয়া। যেকোনো কিছুই ও বেশ পারদর্শিতার সঙ্গে চুরি করে হজম করে ফেলতো। মাঝে মাঝে ওর এই চুরি করার ক্ষমতাকে ম্যাজিক বলে মনে হতো। তবে ওর নজর ছিল শুধু খাওয়া দাওয়ার দিকেই, ও অন্যকিছু চুরি করতো না। 

ঢ্যাড়া বলেছিল ,"মোর বাপ মোক চুরি কারা শিখাইছে। মোর বাপও চোর ছিল। বাপের সাথোত থাকি মুইও শিখছি। ওমরালা মোক হাটোত ধরি যাইতো, মাছ চুরি কইরবার তানে। চুরি কইরবার পাইলে খাওয়ান পাইতাম, না পাইলে খায়োনও নাই।" (বাবাই হাটে নিয়ে চুরি করা শিখিয়েছে আমাকে। চুরি করতে পারলে খাওয়া আছে, না পারলে খাওয়া নাই )। "মোর আটখান মাও ছিলে। কায় যে মোর নিজের মাও মুই তাও জানো না। কোনদিন কাহো আদর করি খাইতে দেয় নাই।" এই ঢ্যাড়া যে চুরিবিদ্যায় পাকা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। খাবার অভাবে চুরি করতো বলে, হয়তো ও খাবারটাই চুরি করতে শিখেছিল। আমরাও কেমন জানি ঢ্যাড়ার চুরিবিদ্যাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। 

কেন এতদিন পর ঢ্যাড়ামদ্দির কথাটা মনে হলো, সেটা বলি। এক থালা ভাতের জন্য ঢ্যাড়া চুরি শিখেছিল। আর তাই চুরির নীতি-নৈতিকতা মেনে ও শুধু খাবারই চুরি করতো। কিন্তু যারা শিক্ষিত, প্রভাবশালী, ধনীমানুষ জনগণের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বা নেয়, তাদের কিন্তু চুরির কোন এথিকস নেই। উপরন্তু তারা যেন সেই চুরির টাকা হালাল করতে পারে, সেজন্য রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

বহুবছর ধরে বাজেটে 'কালো টাকা সাদা করা' বলে একটি শব্দ শুনে আসছি। আমার অর্থনীতি নিয়ে খুব একটা ধারণা নেই। বাজেটও তেমন কিছু বুঝি না। তবে কালো টাকা সাদা করার বিষয়টির প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ আমরা যারা কষ্ট করে, সৎ পথে টাকা আয় করার চেষ্টা করি, তারা জানি কর দেয়াটা কতখানি ভার হয়ে দাঁড়ায় আমাদের মত মধ্যবিত্তের জন্য। বেতন থেকে বড় একটা অংশ চলে যায় সরকারের কোষাগারে। এর উপর আছে নানাধরণের পারিপার্শ্বিক ভোগান্তি। মনে হয় কলিজা ধরে টান দিচ্ছে কেউ।

অথচ যারা অবৈধ পথে টাকা আয় করছে এবং যাদের আয় অপ্রদর্শিত থাকছে এবং যারা এই আয় লুকিয়ে রাখছ, তারা যেন সেই টাকা হজম করতে পারে, এজন্য এই কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা করে সব সরকার। চুরির কথা স্বীকার করলে সরকার তাদের পুরস্কার ও সুরক্ষা দিচ্ছে। বাহ বেশ ভাল নিয়ম। মন্দ কাজের জন্য পুরস্কার এবং ন্যায়ের পথে আয় করলে ভোগান্তি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেছেন,'আইনে কালো টাকা হলো অপ্রদর্শিত আয়। যে আয়ের কর দেয়া হয়নি। সেই আয় বৈধ ও অবৈধ দুইই হতে পারে। কিন্তু এনবিআর আয়কর নেয়ার সময় আয়ের উৎস জানতে চায় না। এখানে আয় বৈধ না অবৈধ সেটা আলাদা করার সুযোগ নেই। তবে খরচের খাত যখন দেখানো হয়, তখন তার আয়ের উৎস বলতে হয়।' (ডয়েচে ভেলে)

চলতি প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুয়োগ অনুযায়ী শিল্প ও সেবাখাতে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থ বিনিয়োগ করলে রাজস্ব বোর্ড কোনো প্রশ্ন করবে না। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে, সম্পত্তি, ফ্ল্যাট কিনে, ব্যাংকে টাকা জমা রেখে, সঞ্চয়পত্র কিনে টাকা বিনিয়োগ করা যাবে এ বছরের জুলাই থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। 

অর্থনীতির ভাষায় কালো টাকা আর অপ্রদর্শিত টাকা এক না। কারো বৈধ আয় বেশি কিন্তু সে সেই আয়ের অনুপাতে কর না দিয়ে সরকারকে ফাঁকি দিলো, সেটাই অপ্রদর্শিত অর্থ। আর কালো টাকা হচ্ছে অসৎ উপার্জন থেকে আয় করা টাকা। কালো বাজার বা আন্ডারগ্রউন্ড অর্থনীতি। তা হতে পারে মাদকব্যবসা, অস্ত্রব্যবসা, জঙ্গীবাদ, যৌন ব্যবসা, আদম পাচার, যে কোনকিছু জাল করার ব্যবসা, জাল টাকা। দেশের প্রচলিত আইনে দুটোই অপরাধ। কালো টাকা একবার জায়েজ হয়ে যাওয়ার পর বোঝার কোন উপায় থাকে না কোনটা সাদা টাকা আর কোনটা কালো টাকা। 

এই কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নতুন কিছু না। তবে এই ২০২০-২১ বাজেটে বা করোনাকালের বাজেটে সবচেয়ে লোভনীয় দিকটি হচ্ছে ব্যক্তির কালো টাকা কোথা থেকে এলো তা বলতে হবে না। এমনকী আয়কর বিভাগও কিচ্ছু জানতে চাইতে পারবে না। কেউ তাদের টাকার উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, 'এইরকম অন্যরকম একটি সময়ে অন্যরকম পদক্ষেপই গ্রহণ করতে হয়।' মন্ত্রী আশা করেছেন এই অর্থ বিল ২০২০ অনুযায়ী মূল অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়বে, কাজের সুযোগ তৈরি হবে এবং কর আহরণও বাড়বে। অন্যভাবে এর মানে দাঁড়ালো যে যেভাবেই টাকা আয় করা হোক না কেন, ১০% হারে কর দিয়ে সাত খুন মাফ করে নিতে পারবে। আর যারা সাধারণ ও সৎ মানুষ এবং চাকরি করে অর্ধলক্ষ টাকা মাসে আয় করে তাদের কর দিতেই হবে এবং তা সময়মতো। আর তাদের দেয় করের পরিমাণ ৩৯ শতাংশ। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) অবশ্য প্রতিবারই সরকারকে এই কালো টাকা সাদা না করার জন্য বলে। টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন ব্যাপক পরিমাণে কালো টাকাকে সাদা করার যে বিধান রাখা হয়েছে, তাতো আছেই। কিন্তু দুর্নীতি দমণ কমিশন কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। দেশের অর্থনীতি কখনোই লাভবান হয়নি অতীতে এমনকী যথেষ্ট পরিমাণে করও আদায় হয়নি।" বরং এটা সরকারের দুর্নীতি দমণের ভূমিকাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে। দেশের সৎ নাগরিকের প্রতি এটা "বৈষম্যমূলক" হয়ে যায়।

আচ্ছা আমার জানার ইচ্ছা যে সরকারের এত সুবিধা দেয়ার পরও, যারা কালো টাকা সাদা করে না, তাদের কি কোনো শাস্তি হয় ? আমি শুনিনি, হয়তো আমি জানি না। শাস্তিই যদি না হয় তাহলে কেন একজন মানুষ তার কালো টাকা সাদা করবে? বা তার অপ্রদর্শিত অর্থ কেন প্রদর্শন করবে? কেন তারা সরকারের দেয়া এই সুযোগ গ্রহণ করবে? বিভিন্ন অজুহাতে সরকার এই সাদাকরণ প্রক্রিয়া চালিয়েই যেতে থাকে। সরকার বলে এই অনেক কালো টাকাকে মূলধারায় আনতে না পারলে অর্থনীতিকে চালু রাখা যাবে না। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এবং এই বিষয়ে যারা ওয়াচডগ ভূমিকা পালন করেন তারা ক্রমাগত বলেই আসছেন এই অন্যায় ও অনৈতিক সুযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয় না। খুব সামান্য টাকাই সাদা হয়  যে কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এভাবে কালো টাকাকে সাদা করতে দেয় না। সবাই কালো টাকাকে অনুৎসাহিত করে। আমরা কখনোই কালো টাকা আয়ের পথ বন্ধ করতে পারি না বা চাই না। বরং একে জায়েজ করতে চাই। কিন্তু কেন? কাদের স্বার্থে?

আমাদের কালো টাকা কত? আর কত টাকাইবা সাদা করা হয়? পত্রিকায় প্রকাশিত এক হিসাবে দেখেছি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ১৮,৩৭২ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। রাজস্ব বোর্ড পেয়েছে ১৫২৮.৭৪ কোটি টাকা কর হিসাবে। এরমধ্যে ৯৬৮২ কোটি টাকা সাদা হয়েছে গত কেয়ারটেকার সরকারের সময়। বাংলাদেশ ইকোনোমিক এসোসিয়েশন ২০১৮ সালে জানিয়েছে ধারণা করা হচ্ছে যে প্রায় ৫-৭ লাখ কালো টাকা দেশের অর্থনীতিতে ব্যবহার করা হয়েছে।

এই সুবিধা দেওয়ার ফলে সরকার কিন্তু আশানুরূপ রাজস্ব পায় না। যারা কালো টাকা আয় করে তারা উৎসাহিত হচ্ছে। যারা তাদের বাড়তি আয় প্রদর্শন করছে না তারাও এরমধ্যে কোনো অপরাধ দেখছে না। অথচ অন্যদিকে যারা সৎ আয়কর দাতা তারা পরাজিত হচ্ছে। তাদের মনে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো দেশের তরুণদের একটা বড় অংশ ধারণা লাভ করছে অসৎ পথে আয় কোনো অন্যায় বা অপরাধ নয়। টাকা আয় করে, কম টাকা রাজকর দেয়াটাও কোনো দোষের নয়। তাহলে এরকম একটি বার্তাই কি আমরা আমাদের উত্তরসূরীদের দিচ্ছি না? এর ফল কি দেশের জন্য ভাল হবে? 

প্রতি বছরই এমন সুযোগ থাকে। বলা হয় এই টাকা না হলে বিদেশে চলে যাবে। দেশের বাজারে বিনিয়োগ করলে দেশের অর্থনীতি কালো টাকার জোরে সচল হবে। কিন্তু আসলে কি তাই হয়? দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি এদেশের তৈরি পোষাক শিল্প ও অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিটেন্স। এবার সেটা মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে করোনার কারণে। কালো টাকা দেশের অর্থনীতিতে একটা গর্ত তৈরি করে। আর এই গর্ত কোনদিন বন্ধ হয় না, বরং ক্রমশ খালে রূপান্তরিত হয়। অসৎ মানুষ ফায়দা লুটে, সরকার রাজস্ব আায় থেকে বঞ্চিত হতেই থাকে, আর সাধারণ মানুষ ও সৎ ধনী মানুষ ভীষণ অসহায়বোধ করেন। 

অর্থমন্ত্রী বলেছেন সরকার আশা করছে এই সাদাকরণের ফলে নতুন কাজের সংস্থান হবে, বিনিয়োগ বাড়বে, শেয়ার বাজার চাঙ্গা হবে। অর্থনীতি বিষয়ক বেত্তারা বলেন অতীতেও এই আশাতে এটা করা হয়েছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়নি বরং এই পদ্ধতি দুর্নীতিপরায়ন মানুষকে অবৈধ পথে আরো টাকা আয়ে উৎসাহিত করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা ব্যাংকে রাখার বিধান নিয়ে বাংংলাদেশী ব্যাংকগুলো বেশ বিপাকে পড়তে পারে বলে বিজনেস স্ট্যান্ডারড্ রিপোর্টও করেছে। ব্যাংকগুলো এন্টি মানি লন্ডারিং আইন এর আওতায় 'তোমার কাষ্টমার কে' এটা জানতে বাধ্য, একাউন্ট খোলার সময় ও বড় টাকা লেনদেনের সময়। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে ব্যাংক কোন উৎস জানতে চাইবে না, তার গ্রাহকের কাছ থেকে। এই নিয়ম হবে বৈশ্বিক ব্যাংক নিয়মের বহির্ভূত একটি নিয়ম। সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংক গ্রুপের মাসরুর রিয়াজ বলেছেন, এমনকী সুইস ব্যাংকও কিন্তু এখন আর কালো টাকা রাখার নিরাপদ স্বর্গ নয়। 

এভাবে চললে একটি দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু সবাই এর সুফল ভোগ করবে না। যেহেতু কালো টাকার মালিক ও অপ্রদর্শিত আয়ের মালিকরা দেখছে যে সরকার তাদের প্রতি নমনীয়, তাদের অসৎ আয়কে দেশের অর্থনীতিতে ঢুকিয়ে নিচ্ছে, মানি লন্ডারিং করাও আর কোন অপরাধ নয়, এবার তারা ব্যাংকেও টাকা জমা করতে পারবে, সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবে, আর এই আয়ের ব্যাপারে কোন জবাবদিহিতাও থাকছেনা --- কাজেই এভাবেই চলি। সততার চেয়ে অসততাই শক্তিশালী। যদিও আমরা ছোটবেলায় পরিবারের কাছে শিখেছিলাম, নতুন বা কিছুটা দামি জিনিস, বা টাকা বা লজেন্স বাসায় নিয়ে এলে, সেটা কে দিল বা কোথা থেকে পেয়েছি তা বাবা মাকে জানাতে আমরা বাধ্য ছিলাম। নতুবা সেই জিনিস ব্যবহারের অনুমতি পেতাম না। অর্থাৎ উৎস জানানোটাও বাধ্যতামূলক ছিল। 

লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
১৪ জুন, ২০২০

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.