একশ জোড়া জুতা, বিদেশ ভ্রমণ ও সঞ্চয় কাহিনি

মতামত

সাইফুল হোসেন
25 May, 2020, 08:00 pm
Last modified: 25 May, 2020, 08:07 pm
সঞ্চয় একটা অভ্যাস; খরচ করাও অভ্যাস। দুটোর মধ্যে সঞ্চয়াভ্যাস গ্রহণীয়। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ অভ্যাস থাকলে করোনাভাইরাসের মতো মহাবিপর্যয়েও আর্থিক সংকট মোকাবেলা করার শক্তি থাকে, যদি সেটা অতি দীর্ঘ মেয়াদের না হয়।

আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে করোনাভাইরাসের আঘাত অত্যন্ত গভীর। পৃথিবী তার আপনগতিতে চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছে। কবে আবার সচল হবে, কখন আবার মানুষ আগের চঞ্চলতা ও স্বাধীনতা ফিরে পাবে, সেটা কেউ বলতে পারে না।

অনেক মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে; ফলে বাড়ছে বৈশ্বিক বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। গত শতকের ত্রিশের দশকের মহামন্দার পরে পৃথিবী এত বড় অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন থেকে ৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ, করোনায় ক্ষতির অংক হতে পারে ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি থেকে ৮ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার (এক ট্রিলিয়নে এক লাখ কোটি)। আর এই ক্ষতি বৈশ্বিক জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হবে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২২ মে শুক্রবার বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত 'পটেনশিয়াল ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯-এর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে নতুন করে এই পূর্বাভাস দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি। আর এর পরিমাণ জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এডিবি বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন ও সাধারণ ছুটিসহ অন্যান্য কারণে গড়ে ৩৫ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে।

আসলে অনেকে অনেক ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, কিন্তু সঠিক হিসাব কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, কেউ জানেন না এটা কতদিন ধরে মানুষকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখবে।

যাহোক, এটা হলো সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়, যা মূলত ব্যষ্টিক অর্থনীতির সামগ্রিকতা। আপাত-ভাবনা হচ্ছে, আমাদের ব্যক্তিজীবনের অবস্থা কী হচ্ছে, পারিবারিক জীবনের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে- সেটা নিয়ে। অসংখ্য পরিবার নিয়েই যেহেতু রাষ্ট্র, তাই ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন রাষ্ট্রীয় জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে এখন অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না থাকাতে আয় নেই, দ্রব্য ও সেবা কেনার সক্ষমতা নেই; তাই বাজারে চাহিদা নেই, সঞ্চয় নেই, বিনিয়োগ নেই। আবার, অনেক পণ্যের চাহিদা থাকলেও জোগান নেই। তাই টাকা থাকলেও অনেক সময় কোনো কাজে লাগছে না। অর্থনীতিতে লেনদেন কমে গেছে; কমে গেছে সামগ্রিক ব্যয়। এজন্য সামগ্রিকভাবে জিডিপি কমে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। 

আমরা এখন শুধু অতীব প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবা ক্রয় করছি। আমরা এখন মূলত বেঁচে থাকার জন্য যেটা দরকার, সেটা কিনছি; সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনেকেই বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি না, কোনো কাপড় কিনছি না, ইউটিলিটি পরিশোধ করছি না, ব্যাংকের ঋণ শোধ করছি না, কোনো ব্যক্তিগত ঋণ শোধ করছি না, স্কুলের ফি শোধ করছি না। যেটুকু সঞ্চয় আছে, তা দিয়ে কোনোভাবে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ কিনে শুধু খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। (সমাজের আফ্লুয়েন্ট শ্রেণি ও সরকারি চাকুরেদের কথা ভিন্ন)। 

এক ধরনের মিতব্যয়িতা অবলম্বন করা ছাড়া এখন কোনো উপায় নেই। তাছাড়া এখন কেউ কারও বাসা বাড়িতে যাচ্ছেন না, কোনো আমন্ত্রণে যাচ্ছেন না; যাচ্ছেন না কোনো ক্লাবে বা পার্টিতে। ফলে খরচের অনেক খাত কমে এসেছে। এত অল্প খরচে চলার অভ্যাস আমাদের অনেকেরই ছিল না। করোনাভাইরাস আমাদের অল্প খরচে চলতে বাধ্য করে এক ধরনের বাধ্য মিতব্যয়ী করে তুলছে। আমরা সোজা সরল পথে চলতে শিখে যাচ্ছি। আমাদের অনেকেই জীবনের ফেলে আসা দিনের দিকে তাকানোর সময় পাচ্ছেন এবং এই ভাবনায় পেয়ে বসছে, আমরা অতীতে অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ করেছি, টাকা বিপদকালীন সময়ের জন্য জমানোর কথা চিন্তায় আসেনি। অনেকেই ভাবতেই পারছেন না এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ মাথার উপরে হঠাৎ করে চেপে বসবে। 

সত্যি কথা বলতে কি, বিপদ বলে-কয়ে আতিথ্যগ্রহণ করে না। এটা না বলেই আসে; আপনি পছন্দ করেন বা না-করেন, সেটা আপনার-আমার ব্যাপার।

এখন স্বাস্থ্য সমস্যার কথা, করোনাভাইরাসের কথা বাদ দিলেই যে সমস্যাটা প্রকট, সেটা হলো আর্থিক সমস্যা। হিসাব করলে দেখা যাবে, আমাদের সবার হাতেই অনেক টাকা এসেছে; কিন্তু আমরা ধরে রাখতে পারিনি, ধরে রাখার চেষ্টা করিনি, অভ্যাস গড়ে তুলিনি। এখন দেখি, হাতে কিচ্ছু নেই। অথচ থাকতে পারত, একটু হিসেব করে চললে, অপ্রয়োজনীয় খরচ না করে একপাশে রেখে দিতে পারতাম। পারতাম ঋণ নিয়ে অযথা বিলাসের জীবন না চালাতে, পারতাম একটু অল্প দামে পোশাকগুলো কিনে একপাশে কিছু টাকা রাখতে,পারতাম বোনাসের টাকাটা একপাশে সরিয়ে রাখতে, পারতাম রোজ ক্যাফেতে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবসহ তিনশ টাকা কাপের কফিতে চুমুক না দিয়ে ১০ টাকা কাপের চা পান করতে।

কিন্তু তখন বুঝিনি; ঠিক যেমন বুঝেননি আমার এক পরিচিত। ধনী পরিবারের সদস্য তিনি। স্বামী সন্তান নিয়ে ঢাকার অভিজাত এলাকায় বসবাস। শপিং তার খুব প্রিয় একটা বিষয়। কোনো মার্কেটে একবার ঢুকলে অনেক সময় ধরে কেনাকাটা করেন। ক্রেডিট কার্ড আছে তিন চারটা। নগদে টান পড়লে ক্রেডিট কার্ড। তার এই অভ্যাস যখন আমি জানলাম, একদিন ইচ্ছে করেই তার কেনার অভ্যাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলাম। 

আমরা জানি, প্রয়োজন দুই ধরনের। একটা হচ্ছে নিড (NEED), আর অন্যটা ওয়ান্টস  (WANTS)। নিড মূলত আপনার বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার, সেগুলো; যেমন- চাল, ডাল, পোশাক ইত্যাদি। আর ওয়ান্টস হচ্ছে মূলত সেই প্রয়োজনগুলো, যেগুলো না হলেও আপনার বাঁচতে সমস্যা হয় না; কিন্তু হলে ভালো হয়। যেমন, এক জোড়া জুতা আপনার লাগে; না হলে চলতে পারেন না। অন্যদিকে, দামি আরেক জোড়া জুতা না হলে আপনার চলে; কিন্তু থাকলে স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে।

আমার পরিচিত জনের জুতার প্রতি খুব অনুরাগ আছে। তিনি বাজারে ঢুকলে কারণে-অকারণে জুতা কেনেন। কিনতে কিনতে তার জুতার সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে। তারপরও তিনি জুতা কেনেন। বাবার সঞ্চিত টাকা, যেটা বাবা তার প্রাপ্য হিসেবে ওনাকে দিয়েছেন এবং স্বামীর আয়ের টাকা তার আয়ের উৎস।

আলোচনার এক পর্যায়ে জানলাম, তার এমন অনেক জুতা আছে, যেগুলোর বয়স পাঁচ বছর হয়েছে; কিন্তু একদিনও পরে দেখা হয়নি। প্রশ্ন করলাম, 'কেন কিনেছিলেন ওগুলো?' উত্তর হচ্ছে, 'কিনতে ভালো লেগেছিল!'

সত্যি কথা বলতে কি, এটা হচ্ছে বায়িং অবসেশন। অনেকেরই এটা আছে, বিভিন্নভাবে। এটা একটা মানসিক বিশেষ অবস্থা। তাকে আমি দেখেছি সবসময় খুব অশান্ত থাকতে। খিটখিটে নয়, মেজাজ খারাপ নয়; কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব দ্রুত ও ক্ষিপ্র, কে যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে! মন চাইলে বিদেশ চলে যাবেন। বিদেশে আত্মীয় স্বজন আছেন। জিজ্ঞেস করেছি, এভাবে কতদিন চলা যাবে? উত্তর হচ্ছে, 'দেখা যাক!'

কিছুদিন আগে তার সঙ্গে ফোনে কথা হলো। জানতে পারি, তাদের ডিভোর্স হয়েছে। প্রশ্ন করে কারণ জানতে চাইনি; তবে অনুমান করতে পারি। তার ক্রয় অভ্যাস, বিদেশ ভ্রমণ- সব মনে পড়ে। অনেকের ক্ষেত্রেই মানসিক হতাশা ও অশান্তি এক ধরনের মানসিক বৈকল্য নিয়ে আসে। বায়িং অবসেশনও তেমন এক ধরনের মানসিক অবস্থা। তিনিও সম্ভবত মানসিক বৈকল্যে ভুগছিলেন; তার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে বায়িং অবসেশনের মধ্য দিয়ে।

তার সঞ্চয় কেমন আছে, জিজ্ঞেস করলে কণ্ঠনালী থেকে ঝরে পড়ে হতাশা। বোঝা যায়, সঞ্চয় থাকতে পারত অনেক টাকা; কিন্তু জীবনে অনিশ্চয়তা আসবে- তা কি তিনি ভেবেছিলেন! এখন চলতে কষ্ট হবে কি না- এই প্রশ্নের উত্তর আসে, হ্যাঁ, এখন হিসেব করে চলতে হবে।

তাকে ঠাট্টা করে বলি, 'ইতিহাসে দেখা গেছে, প্রতিটা মহামারিতে মেয়েদের লিপস্টিকের ব্যবহার ও দাম দুটোই বেড়েছে। এটা গত শতকের ত্রিশের দশকে হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হয়েছে, এমনকি ২০০৮ সালের মন্দাতেও হয়েছে। বোধকরি এবারের মন্দা-পরবর্তীতেও এটা হবে। এবার আপনি লিপস্টিক কিনতে থাকুন। দাম জুতার চেয়ে কম।' 

তার উদাস উত্তর, 'না; আর কিনতে ভালো লাগে না।'

আমরা চেতনে খরচ করি, অবচেতন মনে খরচ করি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করা অপব্যয়। আমাদের ধর্মে অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যয়ের অভ্যাস করা দরকার। সবসময় নিজের সাধ্যের মধ্যে চলা দরকার। নিজে আর্থিকভাবে ভালো থাকার জন্য, ঋণ থেকে দূরে থাকার জন্য সবসময় নিজের যে আয়, তার চেয়ে কম খরচ করা উত্তম; ওয়ান্টসের পেছনে খরচ না করে নিডসের পেছনে খরচ করা উত্তম। আর আয়ের একটা অংশ সঞ্চয় করে বিনিয়োগ করা দরকার।

মনে রাখা উচিত, সঞ্চয় একটা অভ্যাস; খরচ করাও একটা অভ্যাস। দুটোর মধ্যে সঞ্চয়াভ্যাস গ্রহণীয়। অল্প আয় থেকেও সঞ্চয় করা সম্ভব। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ অভ্যাস থাকলে করোনাভাইরাসের মতো মহাবিপর্যয়েও আর্থিক সংকট মোকাবেলা করার শক্তি থাকে, যদি সেটা অতি দীর্ঘ মেয়াদের না হয়।

  • লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
    ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.