একটি যথার্থ, জাতীয় ও কার্যকর নারী সংগঠনের সন্ধানে

মতামত

09 March, 2021, 09:50 am
Last modified: 09 March, 2021, 03:02 pm
এদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলপ্রধান, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং প্রশাসনের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা আসীন থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের সবচেয়ে এবং বৃহত্তম নির্যাতিত, বঞ্চিত, শোষিত জনগোষ্ঠীটি হচ্ছে আমাদের নারীসম্প্রদায়।

মাসকয়েক আগে দেশজুড়ে পরপর কয়েকটি বীভৎস ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় দেশের নারীসম্প্রদায় ফুঁসে উঠেছিলেন। তখন অন্য অনেক দলের মতোই চট্টগামের একটি বামপন্থি নারী সংগঠনও প্রতিবাদসভা, মানববন্ধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মশালমিছিল ইত্যাদির ডাক দিয়েছিল। সেই সংগঠনের একজন অত্যন্ত মেধাবী, নিবেদিত ও নেত্রীস্থানীয় কর্মী আমাকে তাঁদের সেই দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ ও আন্দোলনে শামিল হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমি তাঁর সেই আন্তরিক আহ্বানে সাধ্যমতো সাড়া দিয়েছিলাম নিশ্চয়ই, কিন্তু সেইসঙ্গে তাঁকে এই কথাটিও বলেছিলাম যে, ভিন্ন ভিন্ন দলের ব্যানারে এইসব খণ্ড খণ্ড স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ, মিছিলমিটিং এমনকি মারকুটে আন্দোলনের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার একটি ঐক্যবদ্ধ, সর্বদলীয়, সুসংহত, দেশব্যাপী দীর্ঘমেয়াদি নারীআন্দোলনের; যার নেতৃত্বে থাকবে সত্যিকার প্রগতিশীল, প্রতিনিধিত্বমূলক এবং সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় পর্যায়ের একটি কেন্দ্রীয় নারী সংগঠন। এই লেখাটি মূলত আমার সেই চিন্তারই আরেকটু প্রসারিত, বিশদ ও বিস্তারিত রূপ। 

এটা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, এদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলপ্রধান, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং প্রশাসনের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা আসীন থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের সবচেয়ে এবং বৃহত্তম নির্যাতিত, বঞ্চিত, শোষিত জনগোষ্ঠীটি হচ্ছে আমাদের নারীসম্প্রদায়। পরিবার, শিক্ষাঙ্গন, কর্মক্ষেত্র, সামাজিক পরিসর-- কোথায় পীড়ন ও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে না নারীরা নিরন্তর? ধর্ম তাদের বিরুদ্ধে, আইন তাদের বিপক্ষে, পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা, এমনকি সাংস্কৃতিক অনুশাসনসমূহও তাদের প্রতিকূলে। তার ওপর যদি দৈহিক নির্যাতন, মানসিক উৎপীড়ন, সহিংস আক্রমণ, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে এরকম একের পর এক, তাহলে নারীরা যাবে কোথায়? ঘরে ও বাইরে, সর্বাত্মক এবং শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া তখন আর কোনও বিকল্পই কি খোলা থাকে তার কাছে? ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক শ্রীমতি শোভা দে, আজ থেকে কয়েক বছর আগে ঢাকার একটি নারী সংগঠন আয়োজিত বিশ্ব নারীদিবসের অনুষ্ঠানে দেওয়া তাঁর প্রধান অতিথির বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশবিষয়ক বিভিন্ন বইপত্র পড়ে, প্রচারমাধ্যমের নানা প্রতিবেদন দেখে এবং সেদিনের দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে তাঁর পূর্ববর্তী বক্তাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, তাঁর স্বদেশের মতোই বাংলাদেশের নারীসমাজের অবস্থাও একইরকম করুণ ও ভয়াবহ। অথচ তিনি বিস্মিত হয়েছেন এটা দেখে যে, বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরের রাজপথগুলোতে, নারীঅধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তেমন জোরোলো কোনো আন্দোলন ও মিছিল সমাবেশ নেই, এমনকি আন্তর্জাতিক নারীদিবসেও। 

তাঁর কথায় যুক্তি ছিল বৈকি। আমরা বাইরের পৃথিবীর নারীমুক্তি আন্দোলনগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব যে, নারী অধিকারের কোনো দাবিই কোথাও কখনো রাজপথের জোরালো আন্দোলন ব্যতিরেকে অর্জিত হয়নি। আমরা জগদ্বিখ্যাত দ্য সেকেন্ড সেক্স গ্রন্থখ্যাত সিমোন দ্য ব্যোভোয়ারের নেতৃত্বে ফ্রান্সের আলোড়ন সৃষ্টিকারী নারীআন্দোলন মুভ্মা দ্য লিবেরাসিয়ঁ দে ফাম এর কথা জানি, যার জোরে নারীরা তাদের নানাবিধ দাবির সপক্ষে আইনি অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। নয়ের দশকে আমার নিজেরই যুক্তরাষ্ট্রবাসের সময়টাতে দেখেছি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর উইমেন নামে একটি জাতীয় নারীঅধিকার সংগঠন কীভাবে দিনের পর দিন রাজপথের আন্দোলনে গলা ফাটিয়ে, পুলিশের সঙ্গে রীতিমতো হাতাহাতি লড়াই করে, কারাবরণ এবং একইসঙ্গে আদালতে মামলা লড়ে তাদের বহু গুরুত্বপূর্ণ দাবিদাওয়া আদায় করে নিতে। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন দ্য ফেমিনিন মিস্টিক এর যুগান্তকারী লেখক বেটি ফ্রাইডান আর তার তাত্ত্বিক ও নৈতিক সমর্থক হিসাবে ছিলেন মেরিলিন ফ্রে , কেইট মিলেট, অ্যাঞ্জেলা ডেভিস, গ্লোরিয়া স্টাইনেম, বেল হুকসে মতো বিখ্যাত নারীবাদী লেখক, সংগঠক ও বিতার্কিকেরা। এই সংগঠনটি পরিচালিত হতো কেন্দ্রীয়ভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি থেকে, তবে প্রতিটি রাজ্যেই এর একাধিক শাখা ছিল এবং এর সর্বমোট শাখার সংখ্যা সাড়ে পাঁচশোর মতো। এতেই বোঝা যায় এর কর্মী, সমর্থকের সংখ্যা কত এবং তার সাংগঠনিক শক্তির ভিত্তি কীরকম মজবুত হতে পারে। 

বাংলাদেশেও যে সেরকম কোনো সংগঠন ছিল না বা এখনও নেই, তা কিন্তু নয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একেবারে জন্মলগ্নেই বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, অধ্যক্ষ হামিদা খানম প্রমুখের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান উইমেন'স এসোসিয়েশন, স্বাধীন বাংলাদেশে যার নাম হয়েছিল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি। এরপর বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ভেতরেই ১৯৭০ সালে জন্ম নিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, যার কাণ্ডারী ছিলেন খোদ বেগম সুফিয়া কামালের মতো চিরসংগ্রামী এক মহীয়সী নারী। স্বাধীন বাংলাদেশে, আশির দশকে আবারও তাঁরই হাত ধরেই গঠিত হয়েছিলো, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নের দাবিতে সবগুলো নারী সংগঠনের সম্মিলিত জোট, ঐক্যবদ্ধ নারীসমাজ। বাংলাদেশের নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়; রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং আইনি সুরক্ষা আদায়ে এই সংগঠনগুলোর ভূমিকা একেবারে কমও নয়; তবে সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হবে যে, অনেকদিন ধরেই এদের তেমন জোরালো কোনো ভুমিকা আর দৃশ্যমান নেই।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সর্বশেষ সভাপতি, প্রগতিশীল ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী, মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানমের মৃত্যুতে এই মহতী সংগঠনটি বুঝি একেবারেই অভিভাবকহীন হয়ে গেল! একদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন, সীমাহীন শোষণ-বঞ্চনা আর সহিংস সন্ত্রাস; অন্যদিকে নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গঠিত উল্লেখিত সংগঠনসমূহের ক্রমেই নিষ্ক্রিয় ও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার উপক্রম হবার দ্বিবিধ বাস্তবতায়, এই মুহূর্তে দেশে সর্বস্তরের নারীদের অংশগ্রহণে একটি সর্বজনমান্য, সুসংগঠিত ও যোগ্য নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয়ভিত্তিক নারী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হচ্ছে আবারও প্রবলভাবে। এটি কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকেই হয়তো পরিচালিত হবে, তবে এর শাখা থাকবে দেশের জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও এবং যথাযথ সাংগঠনিক বিধান ও শর্তাদি মেনে, সদস্যচাঁদা প্রদান ও কাগজে কলমে নিবন্ধনের মাধ্যমে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে এর সদস্যদের নির্বাচন করা হবে। এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন দল হিসাবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারে, অথবা পূর্বোল্লিখিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কিংবা ঐক্যবদ্ধ নারীসমাজ নামক জোট সংগঠনটিকেও ঢেলে সাজিয়ে পুনরায় সংগঠিত ও সক্রিয় করে তোলা যেতে পারে।

সবশেষে, এর কর্মসূচির মধ্যে প্রাথমিকভাবে থাকবে কয়েকটি ন্যূনতম কিন্তু জনগুরুত্বপূর্ণ ও আদর্শিকভাবে অপরিহার্য দাবি উত্থাপন এবং তা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ। যেমন, রাজনৈতিক পরিসরে এর প্রধানতম দাবিটিই হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সভ্য ও নেতাদের মধ্যে নারীদের সমানুপাতিক অন্তর্ভুক্তি এবং তারই প্রসারণ হিসাবে জাতীয় নির্বাচনসমূহে, নির্বাচন কমিশন প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারেই, সংসদের পঞ্চাশজন মনোনীত, লোকদেখানো নারী সাংসদের পরিবর্তে, প্রতিটি দলের কমপক্ষে ত্রিশ শতাংশ নারীকে সরাসরি নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন প্রদান। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নই মানুষের সত্যিকারের ক্ষমতায়ন। তাই, সেই লক্ষ্য আদায়কেই এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ প্রাধিকার দিতে হবে আমাদের নারীসমাজকে, এবং তার জন্য প্রত্যেককে সরব হয়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করতে হবে। নারীদের সত্যিকার স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রয়োজন হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। তাই চাকরির বাজারে, ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা প্রতিনিয়ত যেসব দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বাধাবিপত্তি, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে তা দূরীকরণের দাবি তুলতে হবে। প্রয়োজনে, কর্মক্ষেত্রে নারীপুরুষের অংশগ্রহণের মধ্যে বর্তমানে যে দৃষ্টিকটুরকম ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান, তার নিরসনে নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগসৃষ্টির আওয়াজও তুলতে হবে বৈকি, যাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় 'ইতিবাচক বা ধনাত্মক বৈষম্য' বলা হয়ে থাকে। এর বাইরে, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদবিষয়ক আইন, গৃহকর্মের ন্যায্য পারিশ্রমিক, পারিবারিক নির্যাতনবিরোধী আইন, মাতৃত্বকালীন ছুটি, সম্পত্তির অধিকার, বিজ্ঞাপন ও প্রচারমাধ্যমে নারীর পণ্যায়ন, আদালতের প্রচলিত সাক্ষ্যআইন, বিশেষ করে ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে, ধর্মীয় বয়ানসমূহে অশ্লীল নারীবিরোধী প্রচারণা ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ, এবং সর্বোপরি একটি সুষ্ঠু জাতীয় নারীনীতি প্রণয়নের দাবিতেও সবাইকে সমান সোচ্চার হতে হবে। 

আমাদের নারীসমাজকে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, এই আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক এবং প্রবলভাবে শ্রেনিবিভক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক সমাজে নারীদের অধিকার কেউ স্বেচ্ছায় ও সানন্দে তুলে দেবে না তার হাতে। অবশ্যই এতে তার সমব্যথী পুরুষ মিত্র ও সহযোদ্ধাদের সহযোগিতারও প্রয়োজন হবে, তবে এর মূল দাবিটি নারীর নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে, এবং তার জন্য একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন, সঠিক নেতৃত্ব ও সর্বাত্মক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। এবারের আন্তর্জাতিক নারীদিবসে এটাই হতে পারত নারীর প্রকৃত মুক্তি, ক্ষমতায়ন ও সমানাধিকারে বিশ্বাসী সবার আন্তরিক অঙ্গীকার।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.