একটি পথ দুর্ঘটনা বা পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি

মতামত

গৌতম গুহ রায়
22 October, 2020, 12:15 pm
Last modified: 22 October, 2020, 12:24 pm
সবুজ ঘাস জীবনানন্দের প্রিয় ছিলো, অন্তিম আঘাতেও তিনি ছিটকে পড়েছিলেন সেই সবুজ ঘাসেই।

২২ অক্টোবর, জীবনানন্দের মৃত্যুদিন।

শরীর খুব অসুস্থ, কদিন ধরেই মেজাজ তেতে ছিলো অভব্য প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ার কারণে। প্রতিদিনের মতই ১৪ অক্টোবর বিকালে তিনি হাঁটতে বের হলেন। একা জীবনানন্দ। যখন বেরুচ্ছিলেন স্ত্রী লাবণ্য তাঁকে বেরুতে নিষেধ করলেন, শরীর অসুস্থ ছিলো কয়েকদিন ধরেই। লাবণ্যর নিষেধ না শুনেই জল দিয়ে মাথা ধুয়ে একাই বেড়িয়ে যান। ফেরার সময় বাড়ির কাছের লেক মার্কেট থেকে দুটো ডাব কিনে নেন। 

হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগ স্থলের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছেন, তিনি আসছিলেন রাসবিহারী এভিনিউয়ের দক্ষিণ দিকের ফুটপাথ ধরে, সংযোগ স্থলে এসে ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তা অতিক্রম করার জন্য পথে নামলেন। রাস্তার এই অংশটা বেশ চওড়া, ট্রাম যাতায়াতের জন্য রাস্তার মাঝখানে দুটো ট্রাম লাইন পাতা। ট্রাম লাইনের জমিটা ঘাসে সবুজ। তিনি ফুটপাথ থাকে নেমে মোটর, বাস, ট্যক্সি প্রভৃতির জন্য পিচ রাস্তার অংশ অতিক্রম করে ট্রাম লাইনের কাছে এলেন, মনটা কিছুটা চঞ্চল ছিলোই, ভাবলেন ট্রাম আসার আগেই লাইন পার হয়ে যেতে পারবেন, এর আগেতো একটা স্টপেজ আছেই, এই সব ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়েই ট্রাম লাইন পার হতে লাগলেন।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, অন্ধকার অল্প অল্প করে জমছে। ট্রামটা আসছিলো, আগের স্টপেজে লোক ওঠা-নামার না থাকায় না থেমে বেশ দ্রুতই চলে এলো, ছুটন্ত ট্রামটি এসে জোড়ের সাথেই ধাক্কা দিলো কবিকে, জীবনানন্দ আর ট্রাম লাইন পার হতে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গে আহত ও অচৈতন্য হয়ে ট্রাম লাইনের মাঝের সেই সবুজের উপর ছিটকে পড়লেন, ট্রামের ক্যাচারের ভিতরে দেহটা ঢুকে গেলো।

রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের দক্ষিণে একটা জলখাবারের দোকান ছিলো, নাম ছিলো 'জলখাবার'। মালিক চুনীলাল দে পরে সেখানে 'সেলি কাফে' নামে রেস্টুরেন্ট খোলেন। জীবনানন্দের দুর্ঘটনার সময় এই চুনীবাবুই শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই ছিলেন না, তিনি ছুটে গিয়ে অনেক সাহায্যও করেছিলেন।

সেই চুনীবাবুর কথায়, 'একটু পরেই হঠাৎ ট্রামের একটা শব্দ, বালিগঞ্জমুখো একটা ট্রাম কাকে যেন চাপা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই পথচারীদের অনেকেই এসে গেলেন। গেয়ে দেখি একজন লোক অচৈতন্য হয়ে ট্রামের ক্যচারের মধ্যে পড়ে আছেন। ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। ট্রামের ড্রাইভার দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ভীড়ের মাঝে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়েছে। 

'যাইহোক, আমি তখনি ট্রামের তলায় ঢুকে আস্তে আস্তে তাকে বের করলাম। সমবেত জনতার দু'একজনের কথা কানে আছে, তাাদের কেউ কেউ বলেছিলেন, ট্রাম লাইনের ঘাসের উপর দিয়ে এই ভদ্রলোক আনমনে আসছিলেন। ট্রাম ড্রাইভার হর্ন দিয়েছিল, দু'একজন চিৎকার করে উঠলেও ভদ্রলোক কীসের চিন্তায় এমন বিভোর ছিলেন যে কিছুই তাঁর কানে যায়নি। যখন তাঁকে বের করা হলো, তখন তিনি অজ্ঞান। দু-তিনজনে মিলে জ্ঞানহীন জীবনানন্দকে ট্যক্সিতে তুলে শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।' 

চুনীবাবু তাঁকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রেখে এলেন, সাধারণ রুগির মতোই পড়ে রইলেন জীবনানন্দ দাশ। পরে আত্নীয়স্বজনরা তাঁকে অন্য বিভাগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁর শরীরের অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি আর। ট্রামের ধাক্কায় জীবনানন্দের বুকের কয়েকটা পাঁজর, কাঁধের হাড় এবং পায়ের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো। 

ডা. বিধান রায় তাকে দেখতে গিয়ে জানিয়ে দেন যে তাঁর আর বাঁচার আশা নেই, যতদিন থাকেন একটু শান্তিতে রাখবেন। শম্ভুনাথ হাসপাতালেই যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন কবি। ১৪ অক্টোবর রাত ৮টায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ২২শে অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। গোটা জীবন অশান্তি ও অতৃপ্তির যন্ত্রণার এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটলো। সবুজ ঘাস তার প্রিয় ছিলো, অন্তিম আঘাতেও তিনি ছিটকে পড়েছিলেন সেই সবুজ ঘাসেই । 

  • লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.