আইন যখন আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে না
তার মানে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল যশোরের কিছু পুলিশ সদস্যের চোখে একজন 'দুর্ধর্ষ' ও 'দাগি আসামি'।
এজন্যই পিছমোড়া করে তাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। আর এভাবেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্থানীয় আদালতে, যেখানে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন। তবু তিনি আদালত থেকে হ্যান্ডকাফ মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে দুইমাস আগে একজন আইণপ্রণেতাকে মানহানি করার অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। অথচ সেই মামলাটিও জামিনযোগ্য।
একজন মানুষ যদি 'দুর্ধষ' ও 'দাগি আসামি' না হয়, তাহলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার সময় হ্যান্ডকাফ পরাতে পারে না পুলিশ।
'পুলিশ প্রবিধানমালা, বেঙ্গল-১৯৪৩'-এর ৩৩০ (এ) ধারায় এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হয়েছে, হ্যান্ডকাফ কিংবা রশি ব্যবহার একটি অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদার ঘটনা।
ওই ধারা অনুসারে, পুলিশের হেফাজত থেকে কোনো কারাবন্দি কিংবা গ্রেপ্তারকৃতের পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতেই শুধু এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
ভারতেও একই আইন প্রচলিত রয়েছে। তিন দশক আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন : 'হ্যান্ডকাফ পরানোটা প্রথমত অমানবিক ও অযৌক্তিক বিষয়। যদি উক্ত লোকটি বেপরোয়া, দাগি কিংবা জামিন-অযোগ্য কোনো অপরাধে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন, শুধু সেক্ষেত্রেই এটি ব্যবহার করা যাবে।'
কাজল কি বেপরোয়া আচরণ করেছেন? কিংবা পুলিশের হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার করেছেন চেষ্টা? না। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পুলিশ তোলেনি।
তার মানে তাকে হ্যান্ডকাফ পরানোটা প্রথম অমানবিক ও অযৌক্তিক কাজ; আর এই অত্যধিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে যশোর পুলিশ 'ধারা ৩৩০ (এ)' লঙ্ঘন করেছে।
অবশ্য পুলিশ যদি তাকে একজন 'দাগি আসামি' হিসেবে গণ্য করে, সেক্ষেত্রে তিনি ভালো ব্যবহার আশা করতে পারেন না।
কিন্তু আইনের চোখে তিনি এখনো নিরপরাধ। আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার তারও রয়েছে। তবে কাজল এ দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীই যেহেতু আইনের তোয়াক্কা করেনি, ফলে কোনোকিছুই তাকে সুরক্ষা দিতে পারেনি।
ফৌজদারি আইনের একটি বেসিক তত্ত্ব অনুসারে তিনি নির্দোষ; কেননা, সেখানে বলা আছে, একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে নিরপরাধ হিসেবে ধরে নিতে হবে।
মানহানির যে মামলা তার বিরুদ্ধে করা হয়েছে, সেটির কোনো চার্জশিট এখনো দাখিল করেনি পুলিশ; এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিরিখে তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কি না- বিচারকের সামনে এ রকম কোনো শোনানিও করা হয়নি তার।
বাংলাদেশের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতো আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। তাকে এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে সংবিধান।
আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ (৫)-এ স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে : 'কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।' দেশের যেকোনো নাগরিকের মতো এই মৌলিক অধিকারটিও কাজলের প্রাপ্য।
অথচ যশোর পুলিশের কারণে তাকে নিষ্ঠুর, অমানুষিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহারের শিকার হতে হয়েছে। 'টর্চার অ্যান্ড কাস্টডিয়াল ডেথ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট ২০১৩'-এ যেকোনো পরিস্থিতিতে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাজলের সঙ্গে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর এমন আচরণ সেই আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এ রকম অপরাধের দায়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কোনো সদস্য দোষী সাব্যস্ত হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
ফৌজদারি আইন ও দেশের সর্বোচ্চ বিধান- সংবিধানকে যারা উপেক্ষা করেছেন, সেই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে? নাকি আইনভঙ্গের অভিযোগের দায়ভার শুধু কাজলকেই বইতে হবে; শুধু তাকেই মাথা পেতে নিতে হবে শাস্তি?
পাশের দেশ থেকে নিজের দেশে ঢোকার মাধ্যমে কী করে অনুপ্রবেশের অপরাধ করলেন কাজল?
মাগুরা-১ আসনের সরকার দলীয় আইনপ্রণেতা তার ও আরও ৩১ জনের বিরুদ্ধে 'মিথ্যে তথ্যে'র ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ এনে মামলা করার পরদিনই, ১০ মার্চ রাজধানীতে নিজের কর্মস্থল থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন কাজল। যেদিন থেকে তিনি নিখোঁজ, ঠিক সেদিনই তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয় 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন'-এ।
পরের দিন চকবাজার পুলিশ স্টেশনে তার স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসী নয়ন একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর তার সন্ধান চেয়ে বিভিন্ন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ কর্মসূচি ও মানববন্ধনের আয়োজন করে।
নিখোঁজ হওয়ার ২৪ দিন পর, রোববার খুব সকালে, যশোরে আচমকা খোঁজ পাওয়া যায় কাজলের।
বেনাপোল বন্দর পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন খান বলেছেন, রোববার ভোরে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশের সময় বিজিবির রঘুনাথপুর ক্যাম্পের সদস্যরা কাজলকে আটক করেছেন। তারপর ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা দায়েরের পর তাকে পুলিশ স্টেশনে হস্তান্তর করা হয়।
ভারত তিনি কীভাবে গেলেন- কেউ কিছু জানে না। অথচ তাকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশের দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। আইন যেন এর দায় নিজের কাঁধেই নেবে! অনুপ্রবেশের দায়ে অভিযুক্ত তিনি। অপরাধী কি না- সেই রায় আদালত দেবেন।
কিন্তু কাজলকে নিষ্ঠুর, অমানুষিক ও বেআইনি শাস্তি দেওয়া যশোর পুলিশ সদস্যরা কি আইনের মুখোমুখি হবেন?
নিয়তির পরিহাস, কাজলকে যেদিন হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আদালতে হাজির করা হলো, সেদিনটি ছিল 'বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস'।
কাজলের হ্যান্ডকাফ পরা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে, জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক কিংবা অতীতের মতো না নেওয়া হোক- এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে যাবে।
উদাহরণ হিসেবে ২০১৫ সালের আগস্টের একটি ঘটনা সামনে আনা যাক। সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, যার একটি পা নেই, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে হওয়া এক মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই পঙ্গু মানুষটিকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে উঠিয়েছিল পুলিশ।
সেই ঘটনাও জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। সমালোচনার বাণ ছুটেছিল অনেক। অথচ দেশের আইন লঙ্ঘন করে তাকে এমন অসম্মান করেছিলেন যে পুলিশ সদস্যরা, তাদের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পুলিশের বিরুদ্ধে হরদম হ্যান্ডকাফ পরানোর অভিযোগ ওঠার এ রকম ঘটনা আরও অনেক রয়েছে। আইনপ্রয়োগকারীদের হাতে আইনের এইসব লঙ্ঘন প্রতিনিয়ত বাড়ছে চলমান বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই। এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা দেশে আইনের শাসনের মুখে গভীর আঁচড় কেটে দেয়।
তাই সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের সঙ্গে ঘটা পুরো ঘটনাটি যথাযোগ্যভাবে তদন্ত হওয়া উচিত। কাজল কীভাবে নিখোঁজ হলেন? কী করে ভারতে গেলেন? কী করে বাংলাদেশে ঢুকলেন? কেন পুলিশ তার সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ করল?
বিচ্ছিন্ন ঘটনা ধরে নিয়ে এটিকে এড়িয়ে যাওয়া, আইন নিয়ে যশোর পুলিশকে তামাশা করতে দেওয়া উচিত হবে না।
আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না, 'এক জায়গার অবিচার, সব জায়গার বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ।'
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
মূল লেখা: When the law cannot protect you