অসম্পূর্ণ ইতিহাসের দায়

মতামত

24 December, 2020, 04:40 pm
Last modified: 24 December, 2020, 04:43 pm
আমাদের দেশের রাজনীতির এমনই হাল, সরকার বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় এ দেশের ইতিহাসও। একে অনেকটা ‘ইতিহাসের সরকারিকরণ’ বলা যায়।

বিষয়টি নিয়ে আগেও বহুবার লিখেছি, আরও বহুবার লিখব। কারণ এ দেশকে জানানো দরকার তার প্রকৃত ইতিহাস। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে, যেন তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছি প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র প্রকল্প নিয়ে আমার প্রথম কাজ শুরু হয়। তখন ১৯৭৮ সাল। এরপর কাজ করেছি বিভিন্ন পর্যায়ে। কখনো বই লিখেছি, কখনো সিনেমা, কখনো ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। 

এত বছর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করে আমি যে বিষয় উপলব্ধি করেছি, তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক প্রচার-প্রচারণা হয়ে থাকলেও খুব সীমিত আকারে সেই ইতিহাসগুলো আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু কেন আমাদের ইতিহাসকে সীমিত করে প্রকাশ করা হচ্ছে? 

আমরা যেসব দলিলপত্র ছাপিয়েছি, সেগুলো ছিল বিভিন্ন সরকারি দলিল, দাপ্তরিক দলিল, আন্তর্জাতিক বা জাতীয় গণমাধ্যমের দলিল কিংবা মুজিবনগর দলিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে এগুলো ছিল খুব সীমিতসংখ্যক মানুষের প্রকাশ।

অথচ আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু ওই দলিলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকলেও ,বাদ পড়ে গেছে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত বিষয়। আর যে বিষয় সবচেয়ে বেশি বাদ পড়ে গেছে, তা হলো সাধারণ মানুষের কথা। 

দুই বছর সাংবাদিকতা করার বদৌলতে আমাকে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে, সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। আর তখনই বুঝতে পারি, একাত্তরে আমাদের নারীদের ইতিহাস এবং তাদের অভিজ্ঞতা বাদ পড়ে গেছে ইতিহাস থেকে।

তার কারণ, বিষয়গুলো যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে আমাদের সামনে এসেছে, সেই সময়ে নারীদের পক্ষে সেভাবে প্রকাশ্যে আসা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ, যেভাবে আমরা একাত্তরের যুদ্ধকে দেখছি, সেখানে সাধারণ মানুষের কথাই যেখানে আসেনি, সেখানে নারীর তো বটেই।

আমি তখন বুঝতে পারি, এই সাধারণ মানুষের কথা আসা সম্ভব হবে না, যদি না আমরা তাদের সাক্ষাৎকার নিই। তখনকার যে সাক্ষাৎকারগুলো আমি দেখেছিলাম, সেগুলো ছিল বাংলা একাডেমির সাক্ষাৎকার (১৯৭২-৭৫)। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারগুলো যে পদ্ধতিতে এবং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেখানে ছিল না কোনো নিরিখ, পরীক্ষা কিংবা যাছাই-বাছাই। যে যা বলেছে, তাই তুলে ধরা হয়েছে। এজন্য আমার মনে হয়েছিল, আমাদের ইতিহাস বোধ হয় ভীষণভাবে অসম্পূর্ণ এবং এই অসম্পূর্ণতাকে কাটানোর কোনো চেষ্টা আমরা করছি না।

এ তো গেল আমাদের কাঠামোগত সমস্যা। অন্যটি হলো ক্ষমতাগত সমস্যা। অর্থাৎ, যারা নিজেদের কথা, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস তুলে ধরছেন, তারা প্রত্যেকেই ক্ষমতাবান শ্রেণির। বড়লোক বা উচ্চবিত্তদের কথা বলছি না আমি। বলছি সেনাবাহিনী, আমলা, রাজনীতিবিদদের কথা। ইতিহাস নিয়ে পড়লে জানা যায়, যাদের কথা উঠে এসেছে তারা সবাই ওপরতলার মানুষ। 

এখন  কথা হচ্ছে, স্বাধীনতার সময় আমাদের মানুষজন তো লিখতে-পড়তেই জানতেন না। যারা জানতেন, তাদের কয়জনই-বা লিখতেন? 

তাই সেই স্বল্প কয়েকজন মানুষই লিখে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। হ্যাঁ, তাদের ভালো ভালো, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বই হয়তো আছে, কিন্তু বয়ানটা খুব সীমিত।

৯৯ ভাগ মানুষই তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাননি বা জানাতে পারেননি। কিন্তু স্বাধীনতার সঙ্গে তো ওই গুটিকয়েক নামই জড়িত নেই শুধু। তাহলে বাকিদের কথা আমরা জানব কী করে? এই দেশবাসী কি তাহলে দেশের অসম্পূর্ণ ইতিহাস আঁকড়ে ধরেই বাঁচবে?

এই প্রশ্নটিই আমার মধ্যে এক ধরনের অস্তিত্ববাদী সংকট তৈরি করেছিল। তাই আমি অনুসন্ধান শুরু করে দিলাম। এ ছাড়া তো আর কোনো পদ্ধতি বাকি ছিল না। পিএইচডি করছিলাম, সেটাও ছেড়ে দিলাম। কারণ ওই প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চার মধ্যে আমি থাকতে পারব না। 

১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে জাতিসংঘে কাজ করতাম। যেহেতু বিভিন্ন কাজে অনেক গ্রামে-গঞ্জে যেতে হতো, তাই অনুসন্ধানী প্রক্রিয়া চালানো আমার জন্য সহজতর হয়ে উঠল। 

একজনের সাক্ষাৎকার আমার মনে খুব আঁচড় কেটেছিল সেবার। কাজের জন্য আমি তখন দিনাজপুরে একটি রেস্টহাউসে উঠেছিলাম। ওই রেস্টহাউসের কর্মচারী ছিলেন তিনি। অনেক দরিদ্র পরিবারের। আমি বিছানায় বসে আছি আর তিনি মেঝেতে। ওপরে বসতেও ভাবতে হচ্ছে তাকে, এতটাই অসহায়। তিনি প্রায়ই এসে আমার সঙ্গে গল্প করতেন।

এ রকম একদিন গল্প করার সময় লোকটি বললেন, পাকিস্তানিরা তাদের পুরো গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। তিনি তখন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। যখন ফিরে আসেন, দেখেন তার স্ত্রী ও মেয়ে নেই। দু-তিনদিন পর তাদের খুঁজে পেয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা তো শুধু ঝাঁপিয়ে পড়েই ধর্ষণযজ্ঞ চালাত না। নারীদের কিছুদিন ক্যাম্পে রেখে ধর্ষণসহ আরও অমানুষিক নির্যাতন চালাত। সেই  নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি লোকটির স্ত্রী ও ছোট প্রতিবন্ধী  মেয়েটিও! 

যাহোক, পরদিন যখন আমি চলে যাবার জন্য গাড়িতে উঠি, তখন দেখি লোকটি আমাকে পেছন থেকে ডাকছেন। অবাক হয়ে পেছনে ফিরে দেখি, তিনি কাঁদছেন আর বলছেন, তার মেয়েকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কতটা অসহায় হলে একজন মানুষ তার সন্তানকে নিয়ে যেতে বলেন?

কিন্তু এই গল্পগুলো স্থান পায়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। এ রকম আরও অসংখ্য গল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু কেন? আমরা কি সচেষ্টভাবেই এই তথ্যগুলো আড়ালে রাখি?

সে উত্তর দিতে গেলে বলতে হয়, ইতিহাস চর্চা এখানে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে হয়। যেসব ইতিহাসবিদ আছেন, তাদের মাঝেও দেখা যায় রাজনীতি সচেতন হয়ে তথ্য উপস্থাপন করার প্রবণতা।

আর আমাদের দেশের রাজনীতির এমনই হাল, সরকার বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় এ দেশের ইতিহাসও। একে অনেকটা 'ইতিহাসের সরকারিকরণ' বলা যায়।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চা শুধু  বয়স্কদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। কারণ আমরা বয়স্করা ইতিহাসচর্চা করি নিজেদের সুবিধা, রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা ব্যক্তিক জায়গা থেকে।

এটি একটি সমস্যা। আরেকটি সমস্যা হলো, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, তাদের অনেকেই আজ মৃত কিংবা বয়স্ক। তাই ইতিহাসচর্চা যদি শুধু এদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়, তাহলে তরুণ প্রজন্ম তাদের দেশকে জানবে কী করে? তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রকৃত ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে হলে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। আর তরুণদের মধ্যে এই আগ্রহ জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের।

আরেকটি সমস্যা হলো, তাল মিলিয়ে চলা। আমরা অনেকেই অনেক বইপত্র লিখেছি, সিনেমাও বানিয়েছি। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে, বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের অডিও বা ভিজুয়ালি পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে, যেন তরুণরা আকৃষ্ট হয়।

শুধু তাই নয়, কাজও  করতে হবে তরুণদের নিয়ে। যেন বর্তমান সময়ের মতো রাজনৈতিক লালসার কাছে হেরে তারা মুক্তিযুদ্ধ বিমুখ না হয়ে পড়ে। 

বই তো আছেই। বই থাকবে সংরক্ষণের জন্য, আর ইন্টারনেট হবে প্রচারের জন্য। যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কোনোরূপ বিকৃতি ছাড়াই সঠিক ইতিহাস টিকে থাকে।

  • লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কলাম লেখক
    অনুলিখন: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.