অভিনেত্রী কাণ্ড ও ‘অসতর্ক মুহূর্ত’ কী!

মতামত

05 August, 2021, 06:30 pm
Last modified: 05 August, 2021, 06:56 pm
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে, ‘অসংলগ্ন মুহূর্ত’ বলতে কী বোঝায়- তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। ওই ‘অসংলগ্ন মুহূর্তে’ কারা আটকা পড়েছেন?- সেটাও জানা দরকার। এটাও সত্য, এ তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবে না। ধারণা করা হয়, এসব ‘অসংলগ্ন মুহুর্তে’ এমনসব ‘কীর্তিমান’ পুরুষরা রয়েছেন- যা প্রকাশ পেলে দেশ ও জাতির বিরাট ‘ক্ষতি’ হয়ে যাবে। তাদের আড়াল করতে এমন অভিযান নয় তো?- এমন প্রশ্ন সচেতন জনতার।

দেশ যখন মহামারিতে ভয়ঙ্কর রকম আক্রান্ত, মানুষ যখন জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত, অর্থনীতি যখন এক সর্বনাশা ঝুঁকির সম্মুখীন, তেমনি এক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গনে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করছে। 

মাস দুয়েক আগে প্রথম হঠাৎ করে গণমাধ্যমে ভেসে ওঠে এক অভিনেত্রীর চেহারা, দেশের প্রধান গণমাধ্যম তার অভিযোগ নিয়ে হৈচৈ ফেলে দেয়। অভিনেত্রীর অভিযোগ ছিল, তাকে ধর্ষণ এবং হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনাস্থল দেশের একটি বিখ্যাত অভিজাত ক্লাব, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ওই ক্লাবসহ দেশের আরেকটি অন্যতম অভিজাত ক্লাবের এক সময়কার সভাপতি। 

খবরটি প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তির বাসভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্তের  বাড়ি থেকে বিদেশি মদসহ মাদক উদ্ধার করেন। এ ঘটনার ভিডিও চিত্র প্রকাশ করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুরু হয় কাহিনীর দ্বিতীয় অংশ। 

কয়েক দিনের মাথায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগকারী অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে নানা তথ্য সামনে আসতে থাকে। আবার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের চেষ্টা, মাদক ও বিদেশি মদ রাখা অনেকগুলো ধারায় মামলা দায়ের হওয়ার পরও তিনি বিস্ময়করভাবে দ্রুততম সময়ে জামিনে বের হয়ে আসেন। 

অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন পাবেন, এটাই স্বাভাবিক। এটাই আইনের শাসন। আইনের শাসন প্রধান যে নীতির উপর দাঁড়িয়ে তা হলো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আইনের চোখে সকলে সমান। প্রশ্ন হলো, এই ধরনের মামলায় আটককৃত অন্যরা জামিন পান কিনা? 

মাদক মামলায় আটককৃতদের জামিন নিম্ন আদালতে হয় না। আমাদের মনে আছে, বছরাধিককাল আগে ফেসবুকে দেয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম সুনামগঞ্জের এক গ্রামে বিশাল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করেছিল। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়ি ঘর। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত সংখ্যালঘু ব্যক্তিটি আজও জামিন পায়নি। তার পরিবার আদালতের এক দরজা থেকে অন্য দরজায় ঘুরছে।

ফিরে আসা যাক বর্তমানে। আলোচিত-সমালোচিত এই অভিনেত্রীর উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে আজ অবধি কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন গণমাধ্যম তুলে ধরেনি। জানা সম্ভব হয়নি, ওই রাতে আসলে কী ঘটেছিল? এরপরই ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়, আরো একই ধরনের গ্রেপ্তারির ঘটনা। প্রতিটি গ্রেপ্তারের ঘটনাতেই 'মাদক ও বিদেশি মদ উদ্ধার' একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিদেশি মদ ঢাকা শহরে এত ব্যাপকভাবে কারা সরবরাহ করে? কী করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদেশি মদ উদ্ধার হচ্ছে? 

সেই অভিনেত্রীর উত্থাপিত অভিযোগের সময় অভিজাত একটি ক্লাব থেকে বিদেশি মদ সংগ্রহ করার ঘটনাটাও ছিল। যতদূর জানা যায়, দেশের প্রচলিত আইনে এ ধরনের অভিজাত ক্লাবগুলোতে বিদেশি মদ আমদানি করার কোন সুযোগ নাই। ক্লাবগুলোর সদস্যদের জন্য এক ধরনের লাইসেন্স প্রদান করা হয়; শারীরিক কারণে মদ পান করার জন্য। সেই লাইসেন্সে উল্লেখ থাকে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মদের কথা। এই অভিজাত ক্লাবগুলোর কোন সুযোগ নাই বিদেশি মদ সরবরাহ করার। 

প্রথমত, এই বিদেশি মদ আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক মানের হোটেলগুলো আমদানি করার বৈধতা পায়। আমদানিকৃত বিদেশি মদের উপর উচ্চহারে শুল্কারোপের কারণে অতি উচ্চমূল্যেই বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। সাধারণভাবে দেশীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করার সুযোগ নেই। কিন্তু এ সমস্ত আইনী ব্যাখ্যা তল্লাশি করবে কে? এ বিষয়ে কখনো কোন প্রশ্ন করা হয় না। অভিজাত ক্লাবগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, তারা বছরে কত টাকার মদ বিক্রি করছে? সেই মদ এর উৎস কোথায়? যদিও এ ক্লাবেরগুলোর সদস্যরা দেশের অভিজাত শ্রেণিরই মানুষ।

কিন্তু, গত কয়েকদিন যাবত নতুন ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। মডেল-অভিনেত্রী ইত্যাদি পেশার সঙ্গে জড়িত কিছু নারীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার করে বলা হচ্ছে, যে তারা নিজ বাসভবনে এক ধরনের সামাজিক অনাচারের লিপ্ত হয়েছে। তারা নাকি বাসায় মদের আসর জমিয়ে সমাজের বিত্তশালী মানুষদেরকে একত্রিত করে তাদের "অসংলগ্ন মুহূর্তের" ছবি তুলে সেগুলো দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছেন- এনিয়ে জনমনে এখন অনেক প্রশ্ন। 

যেমন; যারা ওই আসরগুলোতে যান তারা কারা? আরও প্রশ্ন হলো; তাদের পরিচয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনো প্রকাশ করছে না কেন? 

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে, 'অসংলগ্ন মুহূর্ত' বলতে কী বোঝায়- তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। ওই 'অসংলগ্ন মুহূর্তে' কারা আটকা পড়েছেন?- সেটাও জানা দরকার। 

এটাও সত্য, এ তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবে না। ধারণা করা হয়, এসব 'অসংলগ্ন মুহুর্তে'  এমনসব 'কীর্তিমান' পুরুষরা রয়েছেন- যা প্রকাশ পেলে দেশ জাতির বিরাট 'ক্ষতি' হয়ে যাবে। তাদের আড়াল করতে এমন অভিযান নয় তো?- এমন প্রশ্ন সচেতন জনতার। 

গতকাল সারাদিন আবার নতুন করে সেই অভিজাত ক্লাবের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগ উত্থাপনকারী অভিনেত্রীকে নিয়ে ঘন্টা চারেক দৃশ্যকাব্য মঞ্চস্থ হলো। তাকে গ্রেপ্তার, তার ফেসবুকের লাইফ আসা এবং শেষপর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃক উত্থাপিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। 

সারাদেশে যখন মাদক ও গ্রেফতার নিয়ে এতো হৈচৈ। অভিনেত্রী এবং মডেল গ্রেফতার হচ্ছেন। তারপরও গতকালকে এই অভিনেত্রীর বাসায় এত বিদেশি মদ কীভাবে সংরক্ষিত থাকে। এই অভিনেত্রী এতোটা বেপরোয়া হলো কীভাবে? নিজ বাড়িতে কীভাবে এত পরিমাণ বিদেশি মদ সংরক্ষণ করছিল? - এ প্রশ্নগুলো দেশের গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম সর্বত্রই সৃষ্টি হচ্ছে।

আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, মেজর সিনহার মৃত্যুর আগপর্যন্ত সকল ক্রসফায়ারে অস্ত্র পাওয়া যেতো। অস্ত্র উদ্ধার এবং অস্ত্র আবিষ্কারের ঘটনার সংখ্যা আমরা জানি না। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো কী করা হয় বা কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়- তাও জানা যায় না। 

মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর থেকে 'ক্রসফায়ার' শব্দটি স্থগিত হয়েছে। এখন আর ক্রসফায়ার শব্দটি শোনা যাচ্ছে না। যে কারণে আর বেআইনি অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। 

বিভিন্ন দেশে নানান ঘটনা আমরা আজ দেখতে পাই। যে সমস্ত দেশগুলোতে গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দুর্বল; সেখানে প্রায়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণ তথা সমাজের আস্থা অর্জনের জন্য বিভিন্ন বিতর্কিত কার্যকালাপে জড়িত হয়ে পড়ে। 

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে যখন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হলো; তার আগে এক সন্ত্রাসী হামলায় বহু ভারতীয় সেনা সদস্য নিহত হয়েছিল। তা ছিল ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে। ওই হামলার ফলেই নির্বাচনে বিজেপি সরকারের ব্যাপক উত্থান ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। 

এমনই ঘটনা পাকিস্তানের রাষ্ট্রটির মধ্যেও আছে, আছে মিয়ানমারের, মধ্যপ্রাচ্যের এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে। প্রশ্ন হলো; আমাদের গণমাধ্যমের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব পূর্ববর্তী সরকারের আমলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন ব্যাপকভাবে উত্থাপন করতেন এবং সে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন সামনে রেখেই তারা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। দেশের মানুষ তাদেরকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই এখন গণমাধ্যমের মালিক। গণমাধ্যম আজকে যে অবস্থানে দাঁড়িয়েছে তাতে মানুষের কাছে এদের গ্রহণযোগ্যতা আগের তুলনায় অনেকটাই স্তিমিত। আর মধ্যরাতের যে টকশোগুলোর বিকল্প নেই- বিধায় মানুষ কিছু মাত্রায় তাতে অংশ নেয়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.