অকাস চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কাকে চোখ রাঙাচ্ছে?

মতামত

21 September, 2021, 09:30 pm
Last modified: 21 September, 2021, 09:30 pm
বাইডেন প্রশাসন মোক্ষম সময়ে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করে নিলো। চীনকে তো তারা মোকাবেলা করছেই সাথে সাথে জোটের জন্য অন্য ইইউ সদস্যদের বাদ দিয়ে যুক্তরাজ্যকে বেছে নিয়ে তারা জানান দেওয়ার চেষ্টা করলো তাদেরকে বাইরে রেখে ইইউর কোন উদ্যোগ সফল হবে না।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন অকাস (AUKUS) নামের নতুন এক জোটের ঘোষণা দেন। তাদের ভাষ্যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোয় স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে এই জোটটি সামরিক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পারষ্পরিক সহযোগিতার জন্য কাজ করবে। যার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু চালিত সাবমেরিন তৈরিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিবে। যদিও বিবৃতিতে সরাসরি চীনের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয় নি তথাপি পরিস্থিতি বলছে এটা মূলত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বৃহৎ পরিকল্পনা তারই একটি নমুনা মাত্র।

প্রচলিত আছে যাদের নিয়ন্ত্রণে সমুদ্র থাকবে তারাই পৃথিবী শাসন করবে। চীন ২১ শতকে এসে মূলত এই নীতিকে সামনে রেখেই চলতে চাচ্ছে। তবে এখানে তাদের বড় বাধা স্থলবেষ্টিত বৃহৎ সীমানা। পাশাপাশি তাদের যে বিশাল অর্থনীতি তা সচল রাখতেও সমুদ্রে নিয়ন্ত্রণ দরকার অথচ তাদের বেশিরভাগ বাণিজ্যের জন্য নির্ভর করতে হয় মালাক্কা প্রণালীর উপর যেখানে আবার সরাসরি তাদের আধিপত্য নেই, প্রতিবেশীদের সাথে দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়েও তাদের রয়েছে মতবিরোধ। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যই চীন বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্প বাস্তবায়নে এত মরিয়া আবার তারা দক্ষিণ চীন সাগর নিয়েও বসে নাই, অন্যদের বাধা তোয়াক্কা না করেই তারা সেখানে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করে সামরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বছরে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক বাণিজ্য সম্পাদিত হওয়া এই রুটের একক নিয়ন্ত্রণ  চীনের কাছে চলে যাওয়াটা মোটেই সুখকর হবে না আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য, সে কারনেই আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতিতে এই অঞ্চল এত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিভিন্ন সময়েই তাই এই অঞ্চলের মিত্রদের নিয়ে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের সবচে আলোচিত ও প্রভাবশালী জোট হল কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত)। 

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই অঞ্চলের ক্ষমতা কাঠামোয় ভারসাম্য তৈরির জন্য যদি চীনকে ঠেকিয়ে রাখতেই হয় এবং এর জন্য যদি কোয়াড এর মত একটি কার্যকর জোট থেকেই থাকে, তাহলে নতুন করে অকাসের মত আরেকটি জোটের কী আবশ্যকতা? আবার এই জোটে কোয়াডের সদস্যদের মধ্যে জাপান, ভারত কেন বাদ পড়লো, কেন অস্ট্রেলিয়া প্রাধান্য পেল বা যুক্তরাজ্য এই অঞ্চলের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয়েও অকাসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল, কেনইবা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য ইউরোপীয় মিত্ররা এখানে অংশীদার হওয়ার সুযোগ হারালো?  এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দু'টি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। 

কোয়াডের অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতা

যুক্তরাষ্ট্রের চীন বিরোধী ভূমিকার পেছনে আগে কাজ করত তার আঞ্চলিক মিত্রদের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসন, কিন্তু ক্রমান্বয়ে চীনের অর্থনৈতিক পরাক্রমশালী হয়ে ওঠা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে একক আধিপত্য বিস্তার এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্বার্থের জন্যই হুমকিস্বরূপ। এই নিরাপত্তা ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চালিত সাবমেরিন এর উপর জোর দিচ্ছে যা সাধারণ সাবমেরিনের তুলনায় অধিক কার্যক্ষমতা সম্পন্ন এবং একে রাডারে সনাক্ত করাও কঠিন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৬টি দেশের কাছে আছে এই প্রযুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রও গত ৫০ বছরে প্রথমবারের মত কারো কাছে এই প্রযুক্তি হস্তান্তর করছে।

কোয়াডের মধ্যে জাপানের বাদ পড়ার কারণ হিসেবে ধরা হয় তাদের অভ্যন্তরীণ পরমাণু অস্ত্র বিরোধী আইন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এই প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষত যখন ভারত এবং জাপানের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাদের বিস্তর ফারাক আছে মিত্রতা থাকার পরেও তাই কোয়াডের ভিতরে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই ঝুঁকি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়।

অপরদিকে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটা সময় চীনের দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও হুয়াওয়ে ইস্যু থেকে করোনার উৎস সন্ধানে অস্ট্রেলিয়ার চীন বিরোধী ভূমিকা, বিপরীতে চীনের অস্ট্রেলিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ বিষিয়ে তুলেছে দুই দেশের সম্পর্ক। এমন পরিস্থিতিতে সুযোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের "ডিটারেন্স পলিসি" বাস্তবায়নের জন্য, বিশ্লেষকেরা বলছেন তাদের এই সহযোগিতা হয়ত একটা সময় সরাসরি পরমাণু শক্তির সক্ষমতা অর্জনের দিকে ধাবিত হবে যদিও অস্ট্রেলিয়া বলেছে তাদের সেরকম কোন আগ্রহ নেই। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে ক্রমবর্ধমান দুরত্ব

বিভিন্ন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দুরত্ব বাড়ছে সত্য, তবে মনে হতে পারে অকাসের সাথে হয়ত এই বিরোধের কোনো লেনদেন নাই। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা, অকাস জোট গঠনের উদ্দেশ্য হয়ত চীনকে প্রতিরোধ করা তবে আসল হিসাবে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে ফ্রান্সের। অস্ট্রেলিয়া ২০১৬ সালে তার ইতিহাসের অন্যতম বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি ($৩৭ বিলিয়ন ডলার) করে ফ্রান্সের সাথে ১২ টি সাধারণ সাবমেরিন নির্মাণের জন্য, অকাস চুক্তির কারণে যা এখন বাতিল। ফ্রান্স যে যারপরনাই ক্ষুব্ধ তা আচ করা যায় যখন তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এই চুক্তিকে "পেছন থেকে ছুরি মারা" বলে অভিহিত করেন। ফ্রান্স এতেও ক্ষান্ত হয়নি তারা অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের দূতকে জরুরি তলব করেছে যা তাদের সমসাময়িক ইতিহাসে আর ঘটেনি। আবার লাভবান হয়েছে যুক্তরাজ্য, ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে তারা বিশ্ব রাজনীতিতে আবার ভূমিকা রাখার সুযোগ পেল। এ যেন ঠিক "কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ", দুটি দেশই যুক্তরাষ্ট্রের কাছের ঐতিহ্যবাহী মিত্র, তারপরেও যা ঘটল তা স্রেফ কাকতালীয় ঘটনা নয়।

ইইউতে অনেকদিন ধরেই গুঞ্জন আছে ন্যাটোর বাইরে গিয়ে নিজেদের আলাদা সামরিক জোট গঠনের, কারণ ইতোমধ্যে তারা হালের আফগানিস্তান সংকট থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যে হোঁচট খেয়েছে তার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নিজেদের নির্ভরতা কমানোর দাবি বারবার জোরালো হয়েছে। মের্কেলের সময় এসব সিদ্ধান্ত চেপে থাকলেও সামনের দিনে ম্যাক্রোঁর সময়ে তা আর হচ্ছে না যেহেতু তিনিই ইইউতে এসব দাবি এতদিন করে আসছিলেন।

বাইডেন প্রশাসন এসব টের পেয়ে মোক্ষম সময়ে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করে নিলো, চীনকে তো তারা মোকাবেলা করছেই সাথে সাথে জোটের জন্য অন্য ইইউ সদস্যদের বাদ দিয়ে যুক্তরাজ্যকে বেছে নিয়ে তারা জানান দেওয়ার চেষ্টা করলো তাদেরকে বাইরে রেখে ইইউর কোন উদ্যোগ সফল হবে না। ফ্রান্স বলছে চুক্তি বাতিল হওয়ার চেয়েও তাদের জন্য বেশি দুঃখের বিষয় হল অকাস গঠনের আগে তাদের কিছু জানানো হয় নি একই দাবি ইইউরও।

এই মুহুর্তে অকাস সবদিক দিয়েই ওয়াশিংটনের জন্য বিজয় হলেও ইউরোপ থেকে ইন্দো-প্যাসিফিকের মিত্রদের মনস্তত্ত্বে ফাটল ধরিয়ে তারা কতদূর আগাবে তা নির্ভর করবে তারা এই সৃষ্ট মতানৈক্য নিরসন করতে পারবে কিনা তার উপর। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাউ লিজিয়ান বিবৃতিতে এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের 'স্নায়ু যুদ্ধের মানসিকতা' বলে দাবি করলেও এর বাইরে তাদের কাছ থেকে তেমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের এই দূরে ঠেলে দেওয়া, তাদের আরো চীনের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। যা হবে যুক্তরাষ্ট্রের এই জোটের বিরুদ্ধে চীনের পাল্টা ব্যালেন্সিং।

  • লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.