পারিবারিক-সামাজিক বাধা পেরিয়ে মিতু গাইলেন কোক স্টুডিওতে
বিশ্ব সংগীত দিবসে কোক স্টুডিও বাংলা প্রকাশ করেছে নতুন গান। লালনের সেই বিখ্যাত গান 'সব লোকে কয়' উঠে এসেছে তরুণ শিল্পী কানিজ খন্দকার মিতুর কন্ঠে। এরইধ্যে গানটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক সংগীত বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তিনি। তার আগে অনার্স শেষ করেছেন সংগীতে।
দর্শকদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তিনি বললেন, "সবাই গানটা খুব পছন্দ করছেন। আমার কাছে খুব ভালো লাগছে। এই গান নিয়ে আমি খুব ভয়ে ছিলাম। একে তো কোক স্টুডিওর মতো এত বড় একটা প্লাটফর্মে যাচ্ছে আবার লালনের গান। যদিও গানটা গাওয়ার সময় আমরা প্রচলিত ও অপ্রচলিত দুইরকম সুরেই গেয়েছিলাম। পরে প্রচলিত সুরেই গানটি প্রকাশ করা হয়েছে।"
কোক স্টুডিও'র মঞ্চে কীভাবে এলেন, সে প্রসঙ্গে জানালেন, প্রায় মাস ছয়েক আগে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র কোক স্টুডিওর আরেক সংগীতশিল্পী অনিমেষ রায় তাকে একটা গান পাঠিয়ে সেটা রেকর্ড করে পাঠাতে বলেন। ত্রিশ মিনিটের মধ্যে গানটি রেকর্ড করে পাঠান তিনি। পরদিন তাকে বলা হয়, গানটি সংগীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব শুনেছেন। তাকে ঢাকায় যেতে বলেছেন।
তার পরদিন ঢাকায় রওনা দেন মিতু। দেখা হয় অর্ণবের সাথে। গান গেয়ে শোনাতে হয়। তখনও জানতেন না কোক স্টুডিওর জন্যে এত আয়োজন। তাকে সে দফা ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু উত্তরা অবধি যেতেই আবার ফোন করে নিয়ে গিয়ে আরেকটা গান গাওয়ানো হয়। এভাবে কয়েক দফা গান গাওয়ানো শেষে জানানো হয় তিনি কোক স্টুডিওতে গান গাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। শুরু হয় শুটিং।
এই বিরাট কর্মযজ্ঞ শেষে অবশেষে দর্শকের সামনে মিতুর গান।
অবশ্য এর আগে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যাানেলে গান করেছেন মিতু। কিন্তু এত বড় জায়গায় এবারই প্রথম। তাই ভয়টা কাজ করেছিল শুরু থেকেই। অবশেষে সেটা জয় করেছেন বলেই জানালেন তিনি। সামনে প্রকাশ পাবে আরও কয়েকটি মৌলিক গান। এখন নিচ্ছেন সে সবের প্রস্তুতি।
তবে সারাক্ষণ গানের মধ্যে থাকলেও আজকের অবস্থানে আসা মোটেও সহজ ছিল না তার জন্য।
মিতু বলেন, আমার জন্ম টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে গোবিন্দাসী গ্রামে। যমুনা নদীর কোল ঘেঁষে বাড়ি। এমন পরিবেশ হলে কী হবে, পবিবার কিংবা গ্রামে একবারেই গানের পরিবেশ ছিল না। নানামুখী বাধার সম্মুখীন হয়েছেন একসময়।
সেই স্মৃতি মনে করে কানিজ খন্দকার মিতু বলেন, 'আমার পরিবার একটু রক্ষণশীল। তারা চাইতো না আমি গান করি। এমন কি গ্রামের মানুষজনও গান গাওয়ার বিষয়টা পছন্দ করতো না। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় গান গাওয়ার জন্য আমার পরিবারকে এক ঘরে করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল গ্রামের সবাই। সেটা এখনো আমার মনে আছে।'
তবে গান গাওয়ার বিষয়ে সবসময় তাকে পরামর্শ, সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তার শিক্ষক ও গানের গুরু গোলাম রাব্বানী রতন। মিতুর পুরো পরিবারকে যখন একঘরে করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সবাই, তখন মিতুর পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে মিতু বলেন, ওই দিন তিনি এসে বলেন, মিতু আমার মেয়ে। ওকে আমি বড় করবো। তারপর থেকে আমি তাকে গুরু বাবা হিসেবেই জানি। এখনো আমার যে কোনো বিষয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন গুরু বাবা।'
জীবনের প্রথম হারমোনিয়াম কেনার গল্পটাও জানালেন মিতু। বলেন, ছোটবেলায় আমার গান শুনে আমার প্রবাসী এক নানু আমাকে একশ ডলার উপহার দিয়েছিলেন। সেই ডলার ভেঙে জীবনের প্রথম হারমোনিয়াম কিনেছিলাম। সেটা এখনো আছে।'
অবশ্য এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। গ্রামের সবাই তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। ২০১১ সালে মিতু অংশ নিয়েছিলেন এটিএন বাংলা আয়োজিত 'ব্রাক ব্যাংক মেঘে ঢাকা তারা' নামের রিয়েলিটি শোতে। সেখানে হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নও। তারপর থেকেই গ্রামের সবার ধারণা পাল্টে গেছে। একঘরে হতে যাওয়া মেয়েটি হয়ে উঠেছেন গ্রামের সবার মেয়ে। গর্বের মেয়ে।
সামনে পরিকল্পনা কী মিতুর সে প্রসঙ্গে বললেন, আমার লোকসংগীত নিয়ে পড়াশোনা। তাই সামনে লোকসংগীত নিয়ে কাজ করতে চাই। মানুষ যেন আমাকে মনে রাখেন সেটাই ইচ্ছা আমার।'