চিকিৎসক হলে কফি হাউসের মতো কালজয়ী গান হতো না: সুপর্ণকান্তি ঘোষ

বিনোদন

26 May, 2022, 02:05 pm
Last modified: 26 May, 2022, 02:42 pm
বাংলা সঙ্গীতের কালজয়ী গান ‘কফি হাউসের সেই আড্ডা’। এই গানের সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ ক'দিন আগে এসেছিলেন বাংলাদেশে। টিবিএসের পাঠকদের জন্য আরেকবার গল্পের ঝাঁপি খুলে বলেছেন গানটির নেপথ্য কাহিনী।

২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকা করা হয়। সেই তালিকায় চার নম্বরে আছে সংগীতশিল্পী মান্না দের গাওয়া 'কফি হাউসের সেই আড্ডা' শিরোনামের গানটি। গানটির বয়স প্রায় চার দশক। কিন্তু এখনও একই রকম আবেদন তৈরি করে শ্রোতাদের মাঝে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেননি এমন নিরস মানুষও নস্টালজিক হয়ে যান গানটি শুনলে। আর আড্ডাপ্রিয়দের বেলায় তো কথাই নেই। এই গানেই যেন তারা নিজেকে ফিরে পান, ফিরে পান বন্ধুদের। 

গানটির শিল্পী মান্না দে প্রয়াত হয়েছেন তাও প্রায় ৯ বছর হতে চললো। গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার গত হয়েছেন আরও আগেই। সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ এখনও আছেন, থাকেন কলকাতায়। ক'দিন আগে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে। কফি হাউস তো বটেই আরও বেশ কিছু কালজয়ী গান এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশে আসার কারণ নিয়ে কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে। 

গুলশানের এক বাসায় বসে আলাপ হয় তার সঙ্গে। শুরুতেই জানান বাংলাদেশে আসার কারণ দুটি গানে সুর রেকর্ডিং। একটি মার্চ মাসকে কেন্দ্র করে, আরেকটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন সামনে রেখে করা। গান দুটি লিখেছেন বাংলাদেশের গীতিকার পান্নালাল দত্ত। আর গেয়েছেন দুই তরুণ শিল্পী ইউসুফ খান ও প্রিয়াংকা বিশ্বাস। গান দুটিতে সুর ও রেকর্ডিং করে দারুণ লেগেছে তার। বেশি ভালো লেগেছে বাংলাদেশি তরুণ দুই শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে পেরে। কথায় কথায় জানালেন সেই উচ্ছ্বাস প্রসঙ্গে।

কফি হাউস গানটির তৈরির গল্প শোনার জন্য, মুখিয়ে রয়েছি শুনে বললেন, 'এই গান নিয়ে নিয়ে এতো কথা বলেছি যে নতুন করে আর কিছু বলার নেই।

কিন্তু তাতে আমাদের আগ্রহ কমে না, আর সেটা বুঝেই সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে গল্প শুরু করেন। পাঠকদের সুবিধার জন্য তার কথাগুলো সরাসরি তুলে ধরা হলো।

'ছোট একটা ট্যুরে গিয়েছিলাম প্যারিসে। সেখানে মোমার্ত নামে একটা জায়গায় টিলার মতো একটি জায়গা আছে। সেখানে বেশ কয়েকটা কফিশপ ছিলো। আমাদের গাইড ওই কফিশপগুলো দেখিয়ে বলছিলেন, এখানে বসে সালভাদোর দালি, পিকাসো, স্প্যানিশ কবি পাবলো নেরুদারা আড্ডা দিতেন আর কফি খেতেন। আমি কয়েক মিনিটের জন্য যেন তাদের আড্ডার মধ্যে চলে গেলাম। মনে হলো তাদের দেখছি, তারা আড্ডা দিচ্ছেন আর কফি খাচ্ছেন। মাথায় ওই বিষয়টা রয়ে গেলো। ১৯৮২ সালের শেষের দিকে এম.কম পরীক্ষা দিচ্ছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কঠিন পরীক্ষা, এর মধ্যে আমার বাবা নচিকেতা দত্ত চলে গেছেন। একরকম স্ট্রাগল করেই জীবনযাপন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি পড়াশোনা চালাতে হচ্ছে। টুকটাক গানে সুর করি।'

'সেইরকম একসময় একদিন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আমাদের বাসায় এসেছিলেন শক্তি ঠাকুরের গান সুর করাতে। আজকের জনপ্রিয় শিল্পী মোনালি ঠাকুরের বাবা শক্তি ঠাকুর। আরও একটা বিষয় বলে রাখি, আমার বাবার সঙ্গে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ছিলো দারুণ বন্ধুত্ব। সেই সূত্রেই আমাদের বাসায় অবাধ যাতায়াত তার। সেদিন গৌরী কাকার গলায় ব্যথা। চা পান করছেন। তখনও আমি তার সামনে আসিনি। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "কী রে খোকা, তুই কি তোর বাবার চেয়ে বড় সুরকার হয়ে গেছিস। আমাকে বসিয়ে রেখেছিস।"

আমি বেরিয়ে এসে বললাম, তুমি এসেছো, এটা তো জানতাম না কাকা।'  

উনি আরও দ্বিগুণ জোরে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "নাকি ভেতরে বসে আড্ডা দিচ্ছিস। বিড়ি-সিগারেট খাওয়া হচ্ছে?'' তার আড্ডার কথা শুনে আমার প্যারিসের সেই কফিশপের আড্ডার কথা মনে পড়ে গেলো। আমি বললাম, আড্ডার কথা যখন বললে, আড্ডা নিয়ে একটা গান লেখো না। উনি আরও রেগে গেলেন। তুই কী অক্সফোর্ডের এম.এ? আমাকে গান লেখার জন্য সাবজেক্ট বলে দিচ্ছিস। আড্ডা নিয়ে গান হয় কখনো? তোর বাবা কোনোদিন আমাকে বলেনি, তুই বলছিস।'

`আমি বললাম পারবে না তাই বলো। এটা যদি অন্য কাউকে বলতাম সাথে সাথে লিখে দিতো। তখন উনি বললেন, তাই নাকি। তা বলো শুনি তোমার আইডিয়াটা কী?' বললাম, 'এই যে কফি হাউসে সবাই আড্ডা দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেনরা আড্ডা দেন, সিনেমা নিয়ে আলোচনা করেন, তর্ক করেন। কথার ঝড় ওঠে। তাদের নিয়ে তো একটা গান লিখতে পারো।'

উনি একটু ভাবলেন। তারপর আমাকে বললেন, "আইডিয়াটা খারাপ বলিসনি। নে লেখ। আমি লিখতে পারবো না আমার গলায় ব্যথা।" 

আমি কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লাম। তিনি সাথে সাথে বলা শুরু করলেন, "কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই।'' 

এই দুটো লাইনই লিখলেন। তারপর শক্তিদার গান শেষ করে বাড়ি চলে গেলেন।' তারপর? গানটা শেষ হলো কী করে? আমাদের আগ্রহ বাড়ে। আবার শুরু করেন সুপর্ণ কান্তি ঘোষ।

বলেন, 'তারপর বাড়ি গিয়ে দু-তিন দিনের মধ্যে পুরো গানটা কমপ্লিট করে ফেলেন। কিন্ত সমস্যা হলো তিনি শেষ অন্তরা লিখতে চাননি। কিন্তু আমি তো জানি গানে একটা ক্লাইমেক্স লাগে। এন্ডিং লাগে। এটা নিয়ে তুমুল বাদানুবাদ হলো আমাদের দুজনের। উনি আমাকে ধমকালেন। কিন্তু এটাও জানেন আমি নাছোড়বান্দা। তাই চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটা সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের সাদা কাগজের ওপর লিখে দিলেন শেষ অন্তরাটুকু। তারপর স্টেশনের একজনকে ডেকে বললেন, আমার নাম গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এই লেখাটা সুপর্ণকান্তি ঘোষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। পূর্ব আলিপুর পেট্রোল পাম্পের ওখানে বাসা। পুরো ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, "ঠিকানা জানি না।'' পরে একদিন এক ভদ্রলোক এসে আমাকে ওই কাগজটা দিয়ে যান।" কাগজটা পেয়ে, পড়ে দারুণ লাগে আমার। এবার গানটা শেষ করা যাবে। কিন্তু আমার চারদিন পর বোম্মে (মুম্বাই) যাওয়ার কথা ছিল। কী করে করবো। হাতে অনেকগুলো কাজ। পরে সেই কাগজ নিয়ে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে ট্রেনে শুয়ে কামরার নীল আলোতে সেই কাগজটা মেলে ধরে সুর করা শুরু করলাম। তারপর তো মান্না দে গাইলেন। গানটা সুপারডুপার হিট হলো।' গানের কথা প্রসঙ্গে সুপর্ণকান্তি ঘোষ জানান, গানের চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। সবই কল্পনা। অনেকেই মনে করেই সুজাতা কিংবা অন্য কোনো চরিত্র আছে। আসলে তাদের কেউই কখনো ছিল না এখনও নেই।' 

মান্না দের গাওয়া ৫৬টি গানের সুর করেছেন সুপর্ণকান্তি ঘোষ। এরমধ্যে পাঁচ-ছয়টি রিলিজ করেনি। মান্না দের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তার সঙ্গে আমার বাবার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। অনেকটাই বন্ধুর মতো। বাবার মৃত্যুর পর আমার সঙ্গেও সেরকম হয়ে যায়। তার যাবতীয় বিষয় আমি জানতাম। তিনিও জানতেন। গান তো বটেই আরও নানা বিষয় নিয়ে আমাদের আলাপ হতো।'   

প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। জানতে চাই, এই দেশ বা দেশের শিল্পীদের সঙ্গে কতটা যোগাযোগ তার? বলেন, 'বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা বা স্মৃতি নেই। এবারই প্রথম আসা এ দেশে। তবে একটা স্মৃতি আমার মনে আছে, ১৯৭১ সালে আমার বাবা নচিকেতা ঘোষ বেঁচে ছিলেন। যখন যুদ্ধ শুরু হয় বাংলাদেশে, তখন ব্ল্যাকআউট হতো কলকাতায়। ট্রানজিস্টারে বাবা বসে খবর শুনতেন বাংলাদেশের। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন ঘোষক ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর। তিনি যুদ্ধের সব খবর দিতেন। পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ের খবর শুনে বাবা খুব উচ্ছ্বসিত হতেন। বাবার উচ্ছ্বাস দেখে আমাদেরও ভালো লাগতো।'  

এদেশের শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে বলেন, 'রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান ভালো লাগে। তার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছি। দেখা হয়েছিল। আরেকজন সাবিনা ইয়াসমিন। মান্না দে ও তার মেয়েকে নিয়ে একটা অ্যালবাম করেছিলাম। সেই অ্যালবামের রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে এসেছিলেন তিনি। সেখানে আলাপ হয়েছিল।' 

সুপর্ণকান্তি ঘোষের পরিবারের সবাই চাইতেন তিনি চিকিৎসক হবেন। কারণ পরিবারের সবাই তখন চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সেটা হননি তিনি, হয়েছেন সুরকার। চিকিৎসক না হওয়ার জন্য কোনো আক্ষেপ আছে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'চিকিৎসক হলে 'কফি হাউস' কিংবা 'ছোট বোন'' এর মতো অনেক কালজয়ী গান হতো না। তখন ছুরি, কাঁচি নিয়ে একটা জীবন পার করে দিতে হতো। আমি তো সেটা চাইনি। যা হওয়ার সেটাই হয়েছি এবং আমি সেটা নিয়েই আনন্দিত।'

এমন কোনো গান আছে যেটা খুব আগ্রহ নিয়ে করেছেন কিন্তু মানুষ পছন্দ করেনি বা শোনেনি, এমন প্রশ্নের উত্তরে একটু ভাবেন তিনি। বলেন, 'এটি একটি ভালো প্রশ্ন। যতদূর মনে পড়ে ১৯৯১ সালে 'কফি হাউস-পার্ট ২' নামে একটা গান করেছিলাম। 'কফি হাউস ফিরে এলো' শিরোনামে। কিন্তু গানটার ঠিকমতো মার্কেটিং হয়নি। কেউ ঠিকমতো জানেও না। মান্না দের গলাতেও আগের মতো ধার ছিল না। সব মিলিয়ে গানটা আর মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।'  

কথা শেষ করতে হয়। 

ফেরার সময় তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমি আপ্লুত। সুযোগ হলে আবার আসবো।'     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.