উত্তম কুমারে কতটা অনুপ্রাণিত সৃজিত মুখার্জি?

বিনোদন

শান্তনু রায় চৌধুরী
30 January, 2022, 05:20 pm
Last modified: 30 January, 2022, 07:49 pm
সৃজিতের চারটি ছবি — 'অটোগ্রাফ' (২০১০), 'জাতিস্মর' (২০১৪), 'এক যে ছিল রাজা' (২০১৮) ও 'শাহ জাহান রিজেন্সি' (২০১৯)-এর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ রয়েছে উত্তম কুমার অভিনীত চার ছবির : যথাক্রমে 'নায়ক' (১৯৬৬), 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' (১৯৬৭), 'সন্ন্যাসী রাজা' (১৯৭৫) ও 'চৌরঙ্গী' (১৯৬৮)।

কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু চরিত্রকে নিয়ে 'মিশর রহস্য' (২০১৩) ও 'ইয়েতি অভিযান' (২০১৭)-এর পর সৃজিত মুখার্জির তৃতীয় ছবি। তবে বাংলা সিনেমা, বিশেষত মহানায়ক উত্তম কুমারের ফিল্মোগ্রাফির ব্যাপারে যাদের ভালো ধারণা রয়েছে, তারা ইতোমধ্যেই নিশ্চয়ই অন্য কিছুর ইঙ্গিতও পেয়ে গেছেন! 

কারণ শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসা সৃজিত তার নতুন এই ছবির নামকরণেও তার পানিং-প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। 'কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' নামটা স্পষ্টতই মিলে যায় মহানায়কের জনপ্রিয় ছবি 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' (১৯৬১)-এর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একই নামের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল সেই ছবিটি। 

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, সৃজিতের আরো চারটি ছবি — 'অটোগ্রাফ' (২০১০), 'জাতিস্মর' (২০১৪), 'এক যে ছিল রাজা' (২০১৮) ও 'শাহ জাহান রিজেন্সি' (২০১৯)-এর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ রয়েছে উত্তম কুমার অভিনীত চার ছবির : যথাক্রমে 'নায়ক' (১৯৬৬), 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' (১৯৬৭), 'সন্ন্যাসী রাজা' (১৯৭৫) ও 'চৌরঙ্গী' (১৯৬৮)। এবং সৃজিত যেহেতু ঘোষণা দিয়েছেন তার আসন্ন ছবি 'অতি উত্তম'-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যাবে উত্তম কুমারকে, তাই সময় এসেছে উত্তম কুমারের সঙ্গে তার এতদিনের যোগাযোগকে একটু আতশকাচের নিচে রেখে দেখবার। 

শুরুতেই বলে রাখা দরকার, উপরের চারটি ছবির কোনোটিই কিন্তু 'রিমেক' নয়। বরং বলা যেতে পারে, সৃজিত একই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বা সাহিত্যকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন তার ছবিগুলোতে। সেগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে তার স্বকীয় চিন্তা ও নিজস্ব আদর্শ। কিন্তু তারপরও কৌতূহলী মনে প্রশ্নের অবকাশ রয়েই যায় : মহানায়কের ছবিগুলোর সঙ্গে এসব সাদৃশ্য কি সৃজিতের পূর্বপরিকল্পিত 'ট্রিবিউট'?

"আমি কখনোই চাইনি মহানায়কের কোনো ছবিকে বদলে দিতে। ছবিগুলোর কাহিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গড়ে উঠেছে। থিমগুলোই এত বেশি ইন্টারেস্টিং যে সম্ভবত যেকোনো প্রজন্মের ফিল্মমেকারদের ওগুলোর ব্যাপারে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে," সৃজিত বলেন। 

"কেবল একটি ছবিতেই আমি সচেতনভাবে ট্রিবিউট দিতে চেয়েছিলাম, সেটি 'নায়ক'। কিন্তু সেটি ঠিক ততটাই সত্যজিৎ রায়ের ছবি, যতটা উত্তম কুমারের। এটি এমন একটি ছবি, যেটি আমাকে সিনেমা সম্পর্কে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে চরিত্রায়ণ, চিত্রনাট্য রচনা, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনেতাদের সামলানো... তাই এই ছবিটির কাছে আমার অনেক ঋণ। 'অটোগ্রাফ' বাংলা সিনেমার শ্রেষ্ঠতম যুগলবন্দির প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য। তারা একদমই ভিন্নধর্মী, কিন্তু একইসঙ্গে বাংলা সিনেমার সমান গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। একদিকে উত্তম কুমার প্রতিনিধিত্ব করেন জনপ্রিয় ঘরানার চলচ্চিত্রের। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায় হলেন সেই ব্যক্তি, যার মাধ্যমে এসেছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আর্টহাউজ সিনেমার সুন্দরতম সব নিদর্শন।"

'অটোগ্রাফ' ছবিতে প্রসেনজিৎ।

বাংলায় এমন কয়েকজন আইকন রয়েছেন, যাদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কাজ করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ আর কিছু হতেই পারে না। সৃজিত ঠিক সেই কাজটিই করেছেন তার একদম অভিষেক ছবিতে। এবং গোটা ব্যাপারটিকে তিনি এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন রূপালী পর্দায়, যেখানে দেখা যায় এক নবীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী নির্মাতা 'নায়ক' ছবিরই রিমেক করতে চাইছে!

'নায়ক' উত্তম কুমারের ক্যারিয়ারের বাঁকবদলকারী ছবি। শর্মিলা ঠাকুর যেমন বলেছেন, এই ছবির মাধ্যমেই মহানায়কের বিবর্তন ঘটে একজন অভিনেতা হিসেবে। তিনি আরো বেশি সচেতন হয়ে ওঠেন নিজের শিল্পসত্তার ব্যাপারে। ঠিক তেমনই, 'অটোগ্রাফ' সমসাময়িক বাংলা ছবির গতিপথ পাল্টে দেয়। শুধু যে পরিচালকের নির্মাণশৈলীর কারণেই ছবিটি আলোড়ন সৃষ্টি করে, তা কিন্তু নয়। এ ছবিতে গানের যে ধরনের ব্যবহার দেখা যায়, তা-ও বাংলা ছবির ব্যাপারে তরুণ প্রজন্মকে নতুন করে আকৃষ্ট করার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। বাংলা চলচ্চিত্র সঙ্গীতও তাই আজ চরমভাবে ঋণী সৃজিত ছাড়াও অনুপম রায়, শ্রীজাত, রুপম ইসলামের মতো তার অন্যান্য সহযোদ্ধাদের কাছে।   

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সৃজিত এর পরেও আরো ভালো ভালো ছবি বানিয়েছেন। সেরকম দুটি ছবির উল্লেখ তো এ লেখাতেই রয়েছে। তারপর, এক দশকেরও বেশি সময় আগে 'অটোগ্রাফ'-এর আবির্ভাব বাংলা চলচ্চিত্রে যে ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। 

সত্যজিতের 'নায়ক'-কে টপকানো যদি প্রায় অসম্ভব ব্যাপারও হয়, পরবর্তীতে 'জাতিস্মর' ও 'এক যে ছিল রাজা', এবং কিছু ক্ষেত্রে 'শাহ জাহান রিজেন্সি'-র মাধ্যমে সৃজিত আমাদেরকে এমন কিছু উপহার দিয়েছেন, যেগুলো নানা দিক থেকেই অরিজিনালগুলোর চেয়ে অনেক বেশি জটিল ও বহুমাত্রিক। 

"এন্টনী কবিয়াল ও ভাওয়াল সন্ন্যাসী বাংলার ইতিহাসের অসাধারণ কিছু অধ্যায়। বাংলার ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ব্যাপারে আমার গভীর আগ্রহ রয়েছে, তাই এই বিষয়গুলো একদম স্বতন্ত্রভাবেই আমার মনকে নাড়া দিয়েছে। এসব বিষয়ে আগে থেকেই ছবি নির্মিত হয়ে আছে, সে ব্যাপারটির কোনো ভূমিকা এখানে ছিল না। এদিকে 'চৌরঙ্গী' আমার পড়া একদম প্রথম দিককার উপন্যাসগুলোর একটি। এই উপন্যাসটি পড়েই আমি আমার শহরের প্রেমে পড়েছিলাম। সৌভাগ্যজনকভাবেই হোক বা দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনটি ছবির সঙ্গেই উত্তম কুমারের যোগসূত্র ছিল। কিন্তু এটুকুই। এটি কেবলই ভাগ্যের পরিহাস, নিছক কাকতাল।"

অনেকের মতে এখন পর্যন্ত সৃজিতের সেরা কাজ 'জাতিস্মর'।

'জাতিস্মর' ছবিতে এন্টনী হেনসম্যানের জীবনকে সৃজিত যেভাবে দেখিয়েছেন, তা চিত্রনাট্য রচনার এক অনন্য নিদর্শন। 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' ছবিতে যেমন এক বিখ্যাত কবি-গায়ক-সুরকারের সোজাসাপটা জীবনী দেখানো হয়েছে, 'জাতিস্মর' কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। অনেকগুলো দিক থেকে কাহিনি সাজানোর মাধ্যমে এ ছবিতে একটি বহুমাত্রিক ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বাংলা গানের বিবর্তনকে তুলে ধরার পাশাপাশি দুই শতক ধরে ব্যাপ্ত এক প্রেমকাহিনির কথাও বলা হয়েছে। এরই মধ্যে আবার পুনর্জন্মের চরম নাটকীয় এক দৃশ্যপটও তৈরি করা হয়েছে। 

একদিকে রয়েছে একটি গুজরাটি ছেলে রোহিত (যীশু সেনগুপ্ত), যার প্রেম অভিজাত নাকউঁচু বাঙালি মহামায়ার (স্বস্তিকা মুখার্জি) সঙ্গে। মহামায়া রোহিতকে নিয়ে প্রায়ই মজা নেয় তার দুর্বল বাংলার জন্য। এই উপহাসই রোহিতকে অনুপ্রাণিত করে বাংলা ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করতে, বাংলা গানের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে। ক্রমে চন্দননগরের এক লাইব্রেরিয়ান, কুশল হাজরার (প্রসেনজিত চ্যাটার্জি) মাধ্যমে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে এন্টনী হেনসম্যানের ব্যাপারে। কুশল হাজরা দাবি করে, আগের জন্মে সে-ই ছিল এন্টনী। এরপর কুশল ও রোহিতের গবেষণাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে কবি ও সময়ের কাহিনী। কবিগানের ইতিহাস, নান্দনিকতাসহ সামগ্রিকভাবে বাংলার গানের ঐতিহ্য উঠে আসে এ ছবিতে, যা উত্তম কুমার অভিনীত 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' ছবিতে ছিল অনুপস্থিত। 

সৃজিত নিজেই যেমন বলেন, "এটা আমার বানানো সবচেয়ে জটিল ছবিগুলোর একটি। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনেকগুলো দিকের মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। এন্টনীর আয়ুষ্কালের আগে-পড়ে আড়াইশো বছরের বেশি সময় ধরে বাংলা গানের যে বিবর্তন ঘটেছে, তার উপর আমাকে দীর্ঘ গবেষণা করতে হয়েছে। এরপর সেগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপন করতে হয়েছে সমসাময়িক রক ব্যান্ডগুলোর। আমার এই ছবি নির্মাণের পেছনে উত্তম কুমারের প্রভাব খুব কমই ছিল। বরং যে বিষয়টি আমাকে আসলেই অনুপ্রাণিত করেছিল, তা হলো কবীর সুমনের 'জাতিস্মর' গানটি।"

আলোচনার এই সূত্র ধরেই আমরা আবারো আসতে পারি গানের প্রসঙ্গে। বাংলা চলচ্চিত্র সঙ্গীতের ইতিহাসে 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' নিঃসন্দেহে ক্লাসিক অ্যালবামগুলোর একটি। কিন্তু কবীর সুমনের দুই সৃষ্টি, 'খুদার কসম জান' ও 'জাতিস্মর' গান দুটির কল্যাণে সৃজিতের 'জাতিস্মর'-ও কোনো অংশে কম নয়। তাছাড়া উদাহরণস্বরূপ ধরতে পারেন 'জাতিস্মর' ছবির আরো দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জনরার গানের কথাও। একটি শ্রীকান্ত আচার্যের কণ্ঠে এন্টনীর আগমনী গান 'জয় যোগেন্দ্র জায়া মহামায়া' ও রূপঙ্কর বাগচীর হৃদয়স্পর্শী গান 'এ তুমি কেমন তুমি'।

একটুও বিস্ময়কর নয় যে, এই ছবিটি সেরা সঙ্গীত পরিচালনা (কবীর সুমন) ও সেরা পুরুষ প্লেব্যাক সঙ্গীতের (রূপঙ্কর বাগচী) জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। তাছাড়া এই ছবিতে এত অসাধারণ একটি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও রয়েছে, যেটি পুরো ছবিটিতে এক নতুন আবেগীয় মাত্রা যোগ করে। 

যদি উত্তম কুমারের পারফরম্যান্স ও গানের সুবাদে 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' একটি বায়োপিক হিসেবে উতরে যেতে পারেও, একই ধরনের শক্তিমত্তা সত্ত্বেও 'সন্ন্যাসী রাজা' ইতিহাস ও ঐতিহাসিক চরিত্র দুটোরই সাড়ে সর্বনাশ করে ছাড়ে।

'সন্ন্যাসী রাজা'-র মূল কাহিনি ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারের চাঞ্চল্যকর মামলাকে কেন্দ্র করে। ১৯০৯ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই কাহিনির সময়কাল। এক উদার কিন্তু ভ্রষ্টচরিত্রের সেই জমিদারকে মৃত ভেবে 'দাহ' করা হলেও, বেশ কয়েক বছর পর তার 'প্রত্যাবর্তন' ঘটে। কিন্তু অনেকেই তাকে সত্যিকারের জমিদার বলে মানতে রাজি না হলে, ভারতীয় আদালতের ইতিহাসের অবিশ্বাস্যতম এক নাটকীয় ঘটনার অবতারণা ঘটে। কী ছিল না এই মামলায়? জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, স্বায়ত্ত্বশাসন, পরিচয় অনুসন্ধান, লিঙ্গভিত্তিক ইস্যু, কোর্টরুম ড্রামা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আচরণগত বিজ্ঞান, খুনের ইঙ্গিত, পরকীয়া ও ইনসেস্ট... এক উত্তরাধিকারের ফিরে আসার থিমের মাঝে উপস্থিত ছিল এই সবগুলো উপাদানই। 

কিন্তু 'সন্ন্যাসী রাজা' ছবিতে এসব উপাদানের কিছুই ছিল না। উত্তম কুমারের একক তারকাখ্যাতির উপর ভর করে এটি নিছকই একটি মেলোড্রামার বেশি আর কিছু হয়ে উঠতে পারেনি। 

"ভাওয়াল রাজার জীবনকাহিনি যেকোনো চিত্রনাট্যকারের জন্যই স্বপ্নের মতো," সৃজিত বলেন। "এতসব নাটকীয়তার ঘনঘটা নিয়ে যে ফিল্মমেকারই কাজ করুন না কেন, তিনি হয়তো বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্টের জন্য সমালোচিত হতেন। দারুণ সুর ও গান, এবং উত্তম কুমারের ক্যারিশমা থাকলেও, 'সন্ন্যাসী রাজা' সত্যের বিকৃতি ঘটিয়েছে লজ্জাজনকভাবে। কিন্তু ইতিহাস ও গবেষণার উপর ভিত্তি করে নির্মিত 'এক যে ছিল রাজা' প্রকৃত বাস্তবতাকে তুলে এনেছে।"

'এক যে ছিল রাজা'য় যীশু সেনগুপ্ত ও জয়া আহসান।

তাছাড়া যীশু সেনগুপ্তও বাংলা সিনেমার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন। সোমনাথ কুণ্ডুর চমৎকার মেক-আপের কাজ, গৈরিক সরকারের সিনেমাটোগ্রাফি, সূক্ষ্ম প্রোডাকশন ডিজাইন ইত্যাদি তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে যীশু তার সমগ্র সত্তায় যেভাবে চরিত্রটিকে ধারণ করেছেন, তাতে করে 'এক যে ছিল রাজা' হয়ে উঠেছে একটি মডার্ন-ডে এপিক। বলাই বাহুল্য, উত্তম কুমারের 'সন্ন্যাসী রাজা'-র চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে সৃজিতের এই নির্মাণ। 

এবার যা বলব তা যথেষ্ট প্যারাডক্সিকাল লাগতে পারে। 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' ও 'সন্ন্যাসী রাজা'-য় অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে উত্তম কুমারের উপর অতিনির্ভরশীলতার কারণেই সৃজিত নির্মিত একই চরিত্রগুলো আমার বেশি ভালো লেগেছিল। কিন্তু 'চৌরঙ্গী'-তে সেই অতি উত্তম নির্ভরশীলতাই বরং আমাকে বেশি টেনেছে। ১৯৬৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির গুণগতমান নিয়ে আমার মনে কোনো ভ্রম নেই। কিন্তু তারপর আমি বলব, যদি কোনো একটি ছবি আমার সামনে উত্তম কুমারের ক্যারিশমার সর্বোচ্চটা তুলে ধরে, তাহলে সেটি 'চৌরঙ্গী'।

শংকরের একই নামের প্রায় আত্মজৈবনিক উপন্যাস থেকে নির্মিত ছবিটিতে স্যাটা বোস চরিত্রে উত্তম কুমার যে চার্ম দেখিয়েছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। অবশ্য এ কথা মানতেই হবে যে পর্দায় যতটা না মূল উপন্যাসটি প্রাধান্য পেয়েছিল, তারচেয়ে বেশি পেয়েছিল উত্তম কুমারের করা স্যাটা বোস চরিত্রটি। 

সৃজিত বলেন, "আমার জীবনে 'চৌরঙ্গী' প্রথমে এসেছিল একটি উপন্যাস হিসেবে, এবং তারও অনেক পরে ফিল্ম হিসেবে। আমি উপন্যাসের মূল ভাবটাকেই তুলে ধরতে পেরেছি। এবং সেই মূল ভাবটা স্যাটা বোস নয়, সেটি হলো একটি হোটেল ও শহর কলকাতা।"

আর সত্যিও, সৃজিতের ছবির শুরুতেই পরমব্রত চ্যাটার্জির (রুদ্র চরিত্রে, শংকরের আদলে গড়ে উঠে যে চরিত্র) ভয়েসওভারের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সৃজিত গল্পটিকে কীভাবে দেখেছেন। "শংকরের 'চৌরঙ্গী' পড়েছেন? আরে বাবা হ্যাঁ হ্যাঁ, উত্তম কুমার যেটায় স্যাটা বোসের পার্ট করেছেন। সেটা সিনেমা হওয়ার আগে, একটা কালজয়ী উপন্যাস ছিল। বই পড়ার অভ্যেস গেছে তো? (হাসি) তা আমার গল্পটা সেরকমই। মানে ওই 'চৌরঙ্গী'-র মতো। প্রেক্ষাপট, এই শহর... যদিও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন, তাহলে ধরে নিন, ২০১৭ সালে আমার গল্পটা 'চৌরঙ্গী'-র জাতিস্মর।"

এরপর 'শাহ জাহান রিজেন্সি' হয়ে ওঠে উপন্যাসটির আরো বেশি সাম্যবাদী একটি রূপান্তর। সৃজিত এখানে ক্যানভাস প্রসারিত করেন সেইসব চরিত্রদের মেলে ধরার জন্য, যারা উত্তম কুমারের ছবিতে খুব কমই গুরুত্ব পেয়েছিল। যেমন : সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী 'এসকর্ট' কমলিনী (স্বস্তিকা মুখার্জী), হোটেলের মালিক মকরন্দ পাল (অঞ্জন দত্ত), সমাজের উঁচু শ্রেণীর এনজিও চালানো সম্মানী মহিলা মিসেস সরকার (মমতা শঙ্কর), তার ছেলে অর্ণব (অনির্বাণ ভট্টাচার্য), গোয়েন্দা বরুণ রাহা (রুদ্রনীল ঘোষ) এবং সমকামী হাউজকিপিং হেড নিতাই ব্যানার্জি (সুজয় প্রসাদ চ্যাটার্জি)।

স্যাটা বোস চরিত্রে উত্তম কুমার।

তবে, উত্তম কুমার অভিনীত ছবিটির চেয়ে সৃজিতের সংস্করণটির অনেক দিক থেকে এগিয়ে থাকার সুযোগ থাকলেও, আমি কখনোই এমন ভাবনা মন থেকে দূর করতে পারিনি যে সব চরিত্রকে সমান গুরুত্ব দিতে গিয়ে সৃজিত কাহিনির মূল গভীরেই প্রবেশ করতে পারেননি, যেটি সবগুলো চরিত্রকে এক সুতোয় বেঁধে রাখতে পারত (যা 'চৌরঙ্গী'-তে উত্তম কুমারের চরিত্রটি করতে পেরেছিল)। তবে আমার মনে হয় এই ব্যাপারটি আসলে হয়েছে মূল উপন্যাসটির কারণে। উপন্যাসটিতে প্রচুর পরিমাণে নাটকীয় গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও, চরিত্রদের বিস্তৃত ক্যানভাসের কারণে এটি সম্ভবত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পুরোপুরি উপযোগী নয়। বরং ওটিটি সিরিজ হিসেবেই 'চৌরঙ্গী' হতে পারত শ্রেষ্ঠ নির্বাচন। 

তাহলে, সৃজিতের নির্মাণগুলোতে অরিজিনাল ছবিগুলো কতটুকু অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে সৃজিত বলেন, "অনুপ্রেরণা তো পরের কথা, যখনই দৃশ্যপটে উত্তম কুমারের প্রবেশ ঘটে, বাঙালি মনস্তত্ত্বের জন্য যেকোনো ঘটনা, চরিত্র বা জায়গার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ হওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি যতটা প্রভাবিত করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। তাই এই ম্যাটিনি আইডলের প্রভাব থেকে সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে আলাদা করতে পারা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সিনেমা যেহেতু এতটা শক্তিশালী মাধ্যম, তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গড়পড়তা বাঙালির কাছে অ্যান্টনী বা ভাওয়াল রাজা বা স্যাটা বোস মানে কেবলই উত্তম কুমার।"

কিন্তু তা সত্ত্বেও, সৃজিত তার নতুন ছবি 'অতি উত্তম'-এ অন্যান্য তারকাদের সঙ্গে উত্তম কুমারকে 'কাস্ট' না করে পারেননি। সৃজিতের মতে, এটি হতে চলেছে একটি 'টেকনিক্যাল মার্ভেল'।

সৃজিতের নতুন ছবি 'অতি উত্তম'-এর পোস্টার।

"আমি উত্তম কুমারের ব্যবহৃত ফুটেজগুলোর মাধ্যমে উত্তম কুমার চরিত্রটিকে তৈরি করছি। আমি ৫৩ বার স্ক্রিপ্ট লিখেছি। প্রথমে শুরু করেছিলাম একটি শর্তহীন স্ক্রিপ্ট নিয়ে। তারপর ব্যাক-ক্যালকুলেট করতে হয়েছে, ডায়লগগুলো ঠিক করতে হয়েছে। তার বিভিন্ন ছবি থেকে মুভমেন্ট বের করে, সেগুলোর ভিত্তিতে একেকটা নতুন শট সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ছবির প্লট খুব সহজ। একটি প্রেমের কাহিনি। কীভাবে উত্তম কুমার তার এক ভক্তকে সাহায্য করেছিলেন ভালোবাসার মানুষের মন জয় করতে। এর মাধ্যমে মহানায়কের ক্যারিশমা ও অসাধারণত্ব এক নতুন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছে। এটি খুবই ইউনিক একটা কাজ হতে চলেছে। সম্ভবত প্রথম কোনো ছবি, যেখানে পূর্বে বিদ্যমান ফুটেজের সাহায্যে একটি সক্রিয় চরিত্র তৈরি করা হচ্ছে।"

সেই 'অটোগ্রাফ'-এর দিনগুলো থেকেই সৃজিত কখনো দর্শককে চমকে দেওয়ার মতো কাজে পিছপা হননি। সেই সূত্রে বদলে দিয়েছেন সমসাময়িক বাংলা সিনেমার চেহারাও। এই আলাপচারিতাও তিনি শেষ করেন সেই কথার মাধ্যমেই, "আমি যেভাবে চাই, সেভাবেই আমাকে আমার গল্পগুলো বলতে হবে।"


  • লেখক: প্রকাশক, সম্পাদক, সমালোচক
  • সূত্র: টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.