'হৃদয় ছুঁয়ে যায় এমন ছবি বানাতে চাই'

বিনোদন

টিবিএস রিপোর্ট
18 January, 2022, 08:20 pm
Last modified: 18 January, 2022, 08:44 pm
রাজধানীতে চলছে ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এবারের উৎসবে আগত তিন নারী চলচ্চিত্র নির্মাতার মুখোমুখি হয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। আজ থাকছে বুলগেরিয়ার নির্মাতা ইয়ানা লেকারস্কার সঙ্গে কথোপকথন।

রাজধানীর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে চলছে ২০তম ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসব। আট দিনব্যাপী এ উৎসব শুরু হয়েছে ১৫ জানুয়ারি। ১৯৯২ সাল থেকে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি এ উৎসবের আয়োজন করে চলেছে। প্রথম দিকে প্রতি বছর একবার তারপর দুই বছরে একবার আর ২০১৬ থেকে ফের প্রতিবছরে একবার করে হচ্ছে এই উৎসব। আমাদের দেশে একসময় বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হতো। কোনো কোনোটি দীর্ঘ কালব্যাপী নিয়মিত আয়োজিত হতো। কিন্তু এখন ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়া আর কোনোটিই আয়োজিত হচ্ছে না। যদিও উৎসবে আগত চলচ্চিত্রের মান নিয়ে অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত, কিন্তু দেশে এইসময় এটিই সবেধন নীলমনি। তাই আনন্দিত হওয়ার সুযোগ আছে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এবারের উৎসবে ৭০টি দেশের মোট ২২০টি চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে। এবার থাকছে এশিয়ান সিনেমা কম্পিটিশন, রেট্রস্পেকটিভ, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, ট্রিবিউট, বাংলাদেশ প্যানারমা, সিনেমা অব দ্য ওয়ারল্ড, চিল্ড্রেন ফিল্মস, ওম্যান ফিল্মমেকারস, শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মস এবং স্পিরিচুয়াল ফিল্মস নামের ১০টি সেকশন। বেস্ট ফিল্ম, বেস্ট ডিরেকটর, বেস্ট অ্যাকটর, বেস্ট অ্যাকট্রেস, বেস্ট স্ক্রিপ্ট এবং বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফার পুরস্কার দেওয়া হয় এই উৎসব থেকে। নতুন অনেক নির্মাতার জন্যই এ উৎসবের পুরস্কার আকর্ষণীয়।

করোনার ধাক্কা সামলে নিয়ে এবারও উৎসব প্রাঙ্গণ (শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরি, জাতীয় জাদুঘর, আলিয়ঁস ফ্রসেজ) বিদেশী অতিথিদের কোলাহলে মুখর। উৎসবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী নির্মাতারা যেমন আছেন, তেমনি আবার আছেন সংগঠক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র সমালোচক, ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক বা পরিচালক। করোনার কারণেই হয়তো খুব নামকরা কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতা উৎসবে অংশ নেননি। তবে যে ৫০ জন এসেছেন তাদের মধ্যে তিন নারী চলচ্চিত্র নির্মাতার মুখোমুখি হয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। আজ থাকছে বুলগেরিয়ার নির্মাতা ইয়ানা লেকারস্কার সঙ্গে কথোপকথন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টিবিএস প্রতিবেদক মাহবুব আলম পল্লব।

কোরিয়া থেকে এসেছেন বুলগেরিয়ার ইয়ানা

পরিচয়: বুলগেরিয়ার সোফিয়াতে জন্ম ইয়ানা লেকারস্কার। তবে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনায় এমএফএ করেছেন সিউলের চাং-অ্যাং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সিউলের পাইনহাউজ ফিল্ম কোম্পানি এবং সোফিয়ার চুচকভ ব্রাদারসে তিনি ইন্টার্ন ছিলেন।  ২০২০ সালে বারনিনেল ট্যালেন্টস, ২০১৮ সালে সারায়েভো ট্যালেন্টস এবং ২০১৭ সালে টোকিও ট্যালেন্টসে অংশ নিয়েছেন। তিনি মিয়ানমার-দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ প্রযোজনার ছবি মামার (২০১৯) সহযোগী প্রযোজক ছিলেন। বুলগেরিয়ার চলচ্চিত্র সূর্যের মুখে ছাইয়ের নির্বাহী প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেন। ২০১৯ সালে সালে ক্যান্টন শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে বিচারক দলের সদস্য ছিলেন ইয়ানা। তার ছবি ব্রিজ পুরস্কার জিতেছে।

ইয়ানা লেকারস্কার

টিবিএস: কেমন দেখলেন বাংলাদেশ?

ইয়ানা: মাত্র তিনদিন হলো এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, কারওয়ানবাজার, নীলখেতের বই আর শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোয় ঘুরেছি। এখানে অনেক মানুষ হলেও তারা উদার এবং সাহায্য করতে প্রস্তুত। আমি তাদের বেশ ভালো বলব। তারা জানতে চায় আমি কোথা থেকে এসেছি, কয়দিন হলো, কেমন লাগছে, কিছু লাগবে কিনা ইত্যাদি।

প্রথম এলেন বাংলাদেশে। দক্ষিণ এশিয়ায় কি আগে এসেছেন ?

আমি কিন্তু কোরিয়ায় থাকি। চার বছর হলো সিউলে আছি। দুই বছর পড়াশোনা করেছি আর দুই বছর ধরে কাজকর্ম করছি। একবার আমার এক সহকর্মী ফিচার ফিল্ম বানাতে চাইল। ওর বাড়ি মিয়ানমার। আমাকে বলল আমি যেন তার সঙ্গে মিয়ানমার যাই আর ছবিটির সহযোগী প্রযোজকের দায়িত্ব নিই। তারপর আমরা এক মাস মিয়ানমার ছিলাম। এছাড়া হ্যানয় ফিল্ম ফেস্টিভালে ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম। এশীয় মানুষদের সম্পর্কে একটি কথা সাধারণভাবেই খাটে যে তারা বেশ 'কোঅপারেটিভ'।

আপনি নিজেকে কী বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন? নারী অধিকার কর্মী না চলচ্চিত্রনির্মাতা?

দেখুন নারী অধিকারকর্মী আসলে হওয়ার বিষয় নয়। আপনি যখন নারী, তখন পদে পদে বৈষম্যের শিকার হবেন। তা আমেরিকায় হোক বা ইউরোপে। তখন আপনার কষ্ট হবে, প্রতিবাদী হতে ইচ্ছে হবে অথবা লুকিয়ে থাকবেন। আমরা নারী অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার সেটা বলতে পারেন। অনেকে হয়তো কথা বলার সুযোগ বা প্ল্যাটফর্ম পায় না। আমরা তা পাই। এখানেও আমরা নারী চলচ্চিত্রকার বা নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলছি, বলতে পারেনর এটিও আমার আসার একটি কারণ। আর চলচ্চিত্র তো আমার নেশা, পেশা, ঘুম-জাগরণ সবই।

কেন চলচ্চিত্রকার হতে চাইলেন?

ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে গল্প ভর করে। অনেকে ভাবত, বানিয়ে বানিয়ে বলছি। আসলেই তো বানানো। পরে যখন বড় হলাম তখন বুঝলাম এটাই আমি পারি আর এটা আমাকে ছেড়ে যায় না। তারপর আমার এক চাচা ছিলেন প্রোডাকশন ডিজাইনার। তার সঙ্গে আমি সেটে গিয়েছি। তখন মনে হলো আমি তো গল্পগুলো এভাবেও বলতে পারি মানে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এর কিছু সময় পর আমি কয়েকজন পরিচিত ও স্বজনদের হারাই। তখন ভাবলাম চলচ্চিত্রকারই হব, তাতে অন্তত আমি স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে পারব। 

কী ধরনের ছবি বানাতে চান বা পছন্দ করেন?

খুব সহজ ধরনের ছবি যেগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যেগুলো মানুষের গল্প বলে, মানবিক গল্প। এককথায় বলা যায় আন্তরিক, হৃদ্যতাপূর্ণ, আরোপিত নয় এমন ছবি আমার পছন্দ। আমি প্রকৃতি খুব পছন্দ করি। বিশেষ করে নদী। আমাদের বাড়ির ধারে নদী নেই, তবে খাল আছে। আমার প্রথম ছবির নাম ব্রিজ, যা সিউলের একটি নদীর ধারের জীবনের গল্প নিয়ে সাজানো। আমার কাছে নদী হলো গতি যেটি সদা প্রবহমান। কোনো দূষণ জমতে দেয় না। আমার মনে হয় জমে গেলে, মানে স্থির হয়ে গেলেই জং ধরে।   

আপনার পছন্দের চলচ্চিত্রকার কে?

লি চেং দং, কোরীয় চলচ্চিত্রকার। খুব নামকরা কেউ নন। তবে তার গল্প আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার কয়েকটি ছবি হলো ওয়েসিস, পোয়েট্রি, পেপারমিন্ট ক্যান্ডি, বারনিং ইত্যাদি। জনরা ধরে বললে ড্রামা, রোম্যান্টিক কমেডি আমি পছন্দ করি। সাই-ফাই ফিল্মও পছন্দ করি। তবে ছবি যে ধারারই হোক তা ভালোভাবে নির্মিত হলেই ভালো লাগে।

আপনার পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বলুন।

আমার বয়স এখন বিয়াল্লিশ। আমার আর কোনো ভাই বোন নেই। আমার মা সাংবাদিক আর বাবা প্রকৌশলী।

আপনি বাংলাদেশের কোনো ছবি দেখেছেন?

দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমি দেখিনি। তবে ইচ্ছে আছে। এবারই হয়তো সুযোগ হয়ে যাবে।

আহা, সত্যি দুঃখজনক কারণ আমাদের দেশে অনেক হৃদয়ছোঁয়া ছবি হয়।

আমি দেখব নিশ্চয়ই।

নতুন ছবি বানাচ্ছেন? কী ধরনের ছবি হবে সেটি?

ড্রামা মুভি বানাচ্ছি, বুলগেরিয়াতে। দুটি লোক জীবন পথের এমন এক বাঁকে এসে দাড়িয়েছে যে বুঝতে পারছে না এবার কোন পথে যাবে। দেখুন অনেক লোক যাদের বয়স হয়ে গেছে চল্লিশ, ভাবে আর কিছু করার নেই। আমি তাদের বলতে চাই, ইটস নেভার টু লেট টু ফলো ইওর ড্রিম। যেকোনো দিনই সুখী হওয়া যায় আর তার জন্য বেশি কিছু করতেও হয় না। সুখী হতে চাইলে কেউ অসুখী হতে পারে না।

দ্য ব্রিজের দৃশ্য

পরিচালনাই বেশি পছন্দ করেন বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কেন?

পরিচালনার বিষয়টি আমার কাছে সৃষ্টি করার মতো মনে হয়। এটা মালা বোনার মতো ব্যাপার। একটার পর একটা ফুল গেঁথে মালাটা বুনে ফেললে দারুণ আনন্দ হয়। অনেকটা জটিল কোনো অঙ্ক সমাধান করার মতো।

আমাদের দেশে ১৭ কোটি মানুষ। প্রতিদিন ১৭ কোটি গল্প বুনে যাচ্ছে। আপনাদের বুলগেরিয়ায় তো তত লোক নেই, গল্পও নেই বেশি। তাহলে?

হ্যাঁ বেশি গল্প নেই, তবে আমাদের দেশেও উদ্বাস্তু আছে, আদিবাসী আছে, পুরোনো আর নতুন সংস্কৃতির সংকট আছে। এই যে দেখুন ত্রিশ বছর আগে আমরা কমিউনিজমের মধ্যে ছিলাম। যখন সোভিয়েত ভেঙে গেল আমরা হঠাৎই যেন নিজেদের খাদের কিনারায় আবিষ্কার করলাম। তখন আমরা চাইলাম নিজস্বতা খুঁজে খুঁজে বের করতে। কী সংকট বলুন তো। কত মানুষ, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী মারা গেলেন নিজেদের কিছু না দিয়ে বা না নিয়ে। আমরা নতুন প্রজন্ম এরপর খুঁজতে বের হলাম- আমাদের কোথায় কী লুকিয়ে আছে। কেমন করে সেগুলোর পুনরুদ্ধার সম্ভব? গল্প নেই বলছেন? অনেক গল্প আমাদেরও আছে।

আপনি সংগীত পছন্দ করেন?

হ্যাঁ পপ অ্যান্ড রক। বুলগেরীয় ফোক মিউজিক কিন্তু দারুণ ভালো।

চিত্রকলা পছন্দ করেন?

আমার ভালো লাগে শিশুদের আঁকা ছবি। আমি বিশ্বাস করি, শিশুরাই গ্রেট আর্ট তৈরি করে থাকে। আরোপিত কিছুই আমার ভালো লাগে না।

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে

ঢাকায় কি খেলেন?

মিষ্টি দই।

আপনার নায়ক কে?

আমার বাবা ও মা।

আবার আসবেন তো?

বারবার আসতে চাই।

ধন্যবাদ ভালো থাকবেন।

আপনাকেও ধন্যবাদ, আপনিও ভালো থাকবেন।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.