ব্যক্তিগত জীবনে নেই কোনো গোপনীয়তা, কে-পপ তারকারা চলেন সুপার ফ্যানদের কথায় 

বিনোদন

বিবিসি
25 March, 2024, 09:20 am
Last modified: 25 March, 2024, 12:48 pm
কে-পপ কলামিস্ট জেফ বেঞ্জামিন বেঞ্জামিন বলেন, ‘এটি অদ্ভুত যে কে-পপ তারকারা প্রেমের গান গাইলেও নিজেরা প্রেম করতে পারেন না’। 

এ বছরের মার্চে কে-পপ তারকা কারিনা ভক্তদের উদ্দেশ্য ইনস্টাগ্রামে একটি চিঠি পোস্ট করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। পোস্টে লেখেন, 'আপনাদের কাছে আচমকা বিষয়টি উপস্থাপন হওয়ায় আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি'।

তবে কারিনার অপরাধটা কোথায়?

মূলত অভিনেতা লি জে উকের সাথে সম্পর্কে জড়ান কারিনা। এই খবর জনসম্মুখে আসতেই তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন তার ভক্তরা। তার প্রেমের খবরকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি তারা। অনেকে তাকে বিশ্বাসঘাতক বলেও অভিহিত করেছিলেন। 

ভালোবাসার প্রতিদান

কারিনার প্রেমের সম্পর্ক যখন জনসম্মুখে আসে তখন ক্ষোভে কারিনার এজেন্সি বরাবর একটি ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়েছিল তার ভক্তরা। সেই ট্রাকে আবার বড় ডিজিটাল সাইনবোর্ডে লেখা ছিল—'ভক্তদের দেওয়া ভালোবাসা আপনার জন্য কি যথেষ্ট নয়?' 

বিশ্বের অন্য জায়গায় তারকাদের ব্যক্তিগত রোমান্টিক জীবন প্রকাশ্যে উদ্‌যাপিত হলেও কে-পপ তারকাদের ক্ষেত্রে তা হয় উলটো। টেইলর সুইফট যেখানে তার প্রেমিক ট্র্যাভিস কেলসের সাথে সুপার বোলে অংশ নিচ্ছেন, সেখানে কারিনার মতো কে-পপ আইডলদের তাদের প্রেমের সম্পর্কের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। 

সুপার বোলে প্রেমিক ট্র্যাভিস কেলসকে সমর্থনের জন্য টেইলরের উপস্থিতি গেমটির টিভি ভিউয়ারশিপ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। ১৯৬৯ সালের চাঁদে অবতরণের দৃশ্যের পর সুপার বোলের এই এপিসোড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক দেখা সম্প্রচারে পরিণত হয়েছে।

জরিপে দেখা গেছে, শুধু মাত্র কেলসের সাথে পপ তারকার সম্পর্কের কারণে সুপার বোলের প্রতি পাঁচজন দর্শকের মধ্যে একজন কানসাস সিটি চিফসকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তারা শেষ পর্যন্ত বার্ষিক লিগও জিতেছিল। 

তাহলে কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিতে তারকাদের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে মনোভাব ভিন্ন কেন?

মিথ্যা ঘনিষ্ঠতা

কোরিয়ান মিডিয়া কলামিস্ট জিয়ং দেওক-হিয়ন বলেন, 'ভক্তরা বিরক্ত বোধ করে'। কারণ কে-পপ ভক্তরা প্রায়শই তাদের তারকা বা আদর্শের সাথে প্যারাসোশ্যাল সম্পর্ক কল্পনা করেন। এই এক তরফা সম্পর্কে ভক্তরা তাদের পছন্দের তারকাদের ওপর সময়, অর্থ এবং আবেগ ব্যয় করেন, অথচ সেই তারকা হয়ত তাকে চেনেনই না। 

মি. জিয়ং বিবিসিকে বলেন, কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিতে ভক্তরা তাদের তারকাদের সমর্থন জানাতে তাদের মার্চেন্ডাইজ বা পণ্য কেনেন। অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করে ভক্তদের সমর্থন জানালেও বিনিময়ে ভক্তদেরও কিছু আশা প্রত্যাশা থাকে, কিন্তু যখন এই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয় না তখনই ভক্তরা বিরক্ত হয়ে পড়েন, তাদের মধ্যে তৈরি হয় হতাশা ও ক্ষোভ।  কেউ কেউ মনে করেন যে শিল্পী এবং তাদের ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিগুলো তারকা এবং ভক্তদের মধ্যে একটি 'মিথ্যা ঘনিষ্ঠতা' তৈরি করেছে। ১০ বছর আগেও, কে-পপ এজেন্সিগুলো  তারকাদের প্রেম করতে বা ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন রাখতে নিষেধ করত। 

এখন কে-পপ এজেন্সিগুলো তাদের শিল্পীদের জন্য আলাদা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে। এসব অ্যাপের মাধ্যমে ভক্তরা তাদের প্রিয় তারকাদের দৈনন্দিন জীবনে কী ঘটছে তা সম্পর্কে নিয়মিত জানতে পারেন। ২০২০ সালে এসএম নামের কে-পপ সংস্থা ব্যক্তিগত মেসেঞ্জারের অনুরূপ একটি অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে। এটি আসলে একটি গ্রুপ চ্যাট যেখানে কে-পপ তারকারা একসাথে হাজার হাজার ভক্তদের বার্তা পাঠাতে পারে।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কোরিয়ান সংস্কৃতি নিয়ে লেকচারার আরিয়াম জিয়ং বলেন, 'কে-পপ এজেন্সিগুলো ভক্তদের বলে আসছে যে তারা নতুন তারকা তৈরির ক্ষমতা রাখে।'

পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিডারবফ সায়েজি কারিনার ঘটনাকে উদাহরণ টেনে বলেন, ভক্তরা এখন তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনকে 'শৃঙ্খলাবদ্ধ' করার চেষ্টা করে। 

কোরিয়ান এবং পূর্ব এশিয়ান স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক সায়েজি বলেন, 'তারা কারিনার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল এবং তারপরে তারা রেগে গিয়েছিল যে তিনি ভুল উপায়ে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। কিছু ভক্ত মনে করেন কারিনার উচিত ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিবর্তে কেবল ভক্তদের ফোরামে তার ক্ষমা প্রার্থনা পোস্ট করা।' 

ছোট্ট দেশে বাস করা, ব্যাপকভাবে স্বীকৃত কে-পপ তারকাদের গোপনীয়তা বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব বলে জানান তিনি। 

মিসেস জিয়ং, যিনি নিজেকে একজন নিবেদিত কে-পপ ভক্ত হিসেবে দাবি করেন, তার প্রিয় বয়ব্যান্ড এনসিটি ১২৭-এর গান অনলাইনে স্ট্রিম করেন এবং নিজের অর্থ খরচ করে বিভিন্ন পুরস্কার শোতে তাদের ভোট প্রদান করেন। 

কে-পপের জন্য অসংখ্য ডিজিটাল সংগীত প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যার প্রত্যেকটির স্ট্রিমিং এবং ডাউনলোডের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব শীর্ষ ১০০ গানের তালিকা রয়েছে। সুপার ফ্যানরা তাদের প্রিয় গ্রুপের সাফল্য নিশ্চিত করতে প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের নিয়মগুলো বোঝার জন্য দলগতভাবে সংগঠিত হয়। তারা তাদের প্রিয় তারকা এক ধরনের পণ্য হিসেবে দেখে এবং তাদের সমর্থন করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে।

মিস জিয়ং ব্যাখ্যা করেন কে-পপ তারকাদের সফল রাখতে শিল্পী, ভক্ত এবং ম্যানেজমেন্ট সবাই অধ্যবসায়ের সাথে কাজ করে। 

বিবিসির হাতে বয়ব্যান্ড সেভেনটিনের ভক্তদের তৈরি একটি 'স্ট্রিমিং গাইড' এসেছে। এতে নির্দেশাবলি দেওয়া, 'কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ মিনিটের মোট দুটি বা তিনটি মিউজিক ভিডিও দেখুন। তারপরে প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করুন। নির্দেশাবলি আরও লেখা  'বিরতি দেবেন না, দ্রুত এগিয়ে যাবেন না বা রিওয়াইন্ড করবেন না।'

বয়ব্যান্ড বিটিএসকে সমর্থনকারী বিশাল ফ্যান কমিউনিটি ব্যান্ডটিকে সমর্থন ও প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমে অংশ নেয়। বিটিএসের হয়ে বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করে তারা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তারা অনুবাদকৃত বিটিএস দলের গানের কথা এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেয়। 

মিজ জিয়ং বলেন, "এখানে শুধু টাকা আর সময়ের খেলা। এ থেকে ইন্ডাস্ট্রি লাভবান হয়।' 

কে-পপ ফ্যানডমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল তাদের আইডলদের ঘটা করে জন্মদিন পালন করা, অথচ যার জন্মদিন তিনি নিজেই সেখানে উপস্থিত থাকেন না। কিছু কিছু ভক্ত আছেন যারা পুরো একটি ক্যাফে ভাড়া নিয়ে তাদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন করেন। 

মনোভাবের পরিবর্তন 

কে-পপ কলামিস্ট জেফ বেঞ্জামিন ব্যাখ্যা করেন, যেহেতু কে-পপ তারকাদের ক্যারিয়ার প্রায়শই সংক্ষিপ্ত হয়, মোটামুটি চার থেকে পাঁচ বছর স্থায়ী হয়, তাই তারা তাদের ক্যারিয়ার সুরক্ষিত রাখতে ভক্তদের খুশিকে আগে প্রাধান্য দেয়। এজন্যই কারিনা ভক্তদের আশ্বস্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন যে তিনি তার সংগীতে মনোনিবেশ করেছেন।

বেঞ্জামিন আরও বলেন, 'এটি অদ্ভুত যে কে-পপ তারকারা প্রেমের গান গাইলেও নিজেরা প্রেম করতে পারেন না'। 

তবে কে-পপ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে এ মনোভাবে পরিবর্তন আসতে পারে। কারিনার আন্তর্জাতিক ভক্তদের অনেকেই তাকে প্রেমের সম্পর্কে থাকার জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছে দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। 
তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের হতাশা প্রকাশ করে বলেন, কাউকে পছন্দ করার মতো স্বাভাবিক কিছুর জন্য কেন ক্ষমা চাইতে হবে!

এক্সে (পূর্বে টুইটার) একটি মন্তব্যে লেখা হয়েছে, "কারিনা এই ধরনের আচরণ আশা করেন না।' অন্য একজন লিখেছেন, 'কাউকে পছন্দ করার জন্য কারিনার ক্ষমা চাওয়ার মতো পাগলাটে জিনিস আর কিছু হতে পারে না।' 


অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.