‘শোগান’: জাপানের ‘সেনগোকু’ সময়ের নৃশংস ইতিহাস কেন বারবার চলচ্চিত্রের বিষয়!

বিনোদন

বিবিসি
03 April, 2024, 06:15 pm
Last modified: 04 April, 2024, 04:06 am
জাপান ঐ সময়ে একটি দীর্ঘ ও বিশৃঙ্খল অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময়কার এসব উত্তেজনাময় ঘটনাবহুল গল্পই চিত্রিত হয়েছে ‘শোগান’ মিনিসিরিজটিতে।

ডিজনি+-এর 'শোগান' নামের ছোট ধারাবাহিক সিরিজটির এখন পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত পর্বগুলোয় তুলে ধরা হয়েছে জাপানের বীভৎস সময়ের কিছু মুহূর্ত। এ থেকেই ধারণা পাওয়া যায়, ধারাবাহিকটিতে আরও কী ধরনের ভয়ংকর বর্বরতার কাহিনি অপেক্ষা করছে দর্শকদের জন্য।

শোগান-এ অনাহার, স্কার্ভি ও একজন ক্যাপ্টেনের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সামুদ্রিক ঝড়ে বিধ্বস্ত এক ডাচ বাণিজ্য জাহাজের। পাইলট মেজর জন ব্ল্যাকথর্ন (কসমো জার্ভিস) এবং বেঁচে যাওয়া আরো কিছু ক্রু সদস্যসহ বিধ্বস্ত সেই জাহাজ ভেসে আসে আঞ্জিরোর উপকূলে।

তবে সেখানে তাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছিল তলোয়ারধারী সৈন্যরা। সেখানেই বন্দি করে একটি গর্তে ফেলে দেওয়া হয় তাদের। ব্ল্যাকথর্ন নিজের মৃত্যুকে এড়াতে পারলেও তারই দলের একজনের ভাগ্য এতটাও সুপ্রসন্ন ছিল না। তাকে হাত পা বেঁধে কলড্রনে ফেলে দেওয়া হয়; সেদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে।

না, এটা ওয়েস্টেরসের কোনো কল্পকাহিনি নয়। বরং ১৬০০ সালের জাপানে দুই শতাব্দীর গৃহযুদ্ধের পর চলতে থাকা এক ভয়ংকর অস্থিরতার সময়।

নাট্যধর্মী এই ধারাবাহিকের অন্যতম ব্ল্যাকথর্ন চরিত্রটি বাস্তবের সমুদ্র অভিযাত্রী উইলিয়াম অ্যাডামসের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। জাপানে পৌঁছানো প্রথম ইংরেজ উইলিয়াম অ্যাডামসকে যেতে হয়েছিল নৃশংস এক বৈদেশিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে।

ছবি: এফএক্স

মূলত বিশ্বখ্যাত বেস্টসেলার বই 'শোগান' এর আগেই তার ছোট পর্দার সম্ভাবনা দেখিয়েছে। ১৯৭৫ সালে বের হওয়া জেমস ক্ল্যাভেলের ইতিহাসভিত্তিক এই উপন্যাসটি ১৯৯০ সালের মধ্যে প্রায় ১৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।

১৯৮০ সালে এনবিসি উপন্যাসটি অবলম্বনে নয় ঘণ্টার একটি মিনিসিরিজ তৈরি করে। তাতে অভিনয় করেছিলেন রিচার্ড চেম্বারলেইন, জন রিস-ডেভিস, জাপানি আইকন তোশিরো মিফুনে এবং বর্ণনাকারী হিসেবে ছিলেন অরসন ওয়েলেস।

মার্কিন টেলিভিশনের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর্শকরেটিং অর্জন ছাড়াও তিনটি প্রাইমটাইম এমি ও তিনটি গোল্ডেন গ্লোব জিতেছিল এই ধারাবাহিকটি। এই জনপ্রিয়তা দশকটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'সুশি' রেস্তোরাঁর উত্থানে ব্যাপক অবদান রাখে।

২০২৪ সালে র‍্যাচেল কন্ডো ও জাস্টিন মার্কস অবশ্য তাদের নতুন সিরিজটির জন্য বড় নামগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছেন। বরং তিনি এতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই বেশি জোর দিতে চেয়েছিল। তুলে ধরতে চেয়েছিল সামন্ত জাপানের ভয়ংকর সব মহিমান্বিত চিত্র।

১৬০০ সালে বিশ্বশক্তির চিত্র আজকের দিন থেকে ছিল বেশ আলাদা। ১৫৮৮ সালে প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডকে প্রথম এলিজাবেথের সিংহাসন রক্ষা করতে ক্যাথলিক ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এবং স্পেন থেকে ডাচদের স্বাধীনতা অর্জনে ইংরেজদের সমর্থন বন্ধ করার শর্তে স্প্যানিশ আরমাডার সাথে জোট বাধতে বাধ্য হয়।

এই সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড ও পর্তুগালের রাজবংশ জোট গঠন করে। সে সময় নতুন দেশ বা ভূমির খোঁজে চলছিল সারাবিশ্বে। তাদেরই মধ্যে এগিয়ে থাকা দেশ হিসেবে পর্তুগাল ১৫৪৩ সালে আবিষ্কার করে জাপান। তাদের সাথে ম্যাচলক আগ্নেয়াস্ত্রের মতো আরো অনেক পশ্চিমা পণ্যের ব্যবসা শুরু করে পর্তুগিজরা। এদিকে একইসাথে জেসুইট মিশনারি প্রবর্তনের মাধ্যমে ক্যাথলিক বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে থাকে জাপানিদের মধ্যে। এই বিষয়টি 'শোগান' সিরিজটিতে ব্ল্যাকথর্নের সমুদ্রযাত্রার পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ ও ইতিহাসের অধ্যাপক এবং 'সামুরাই অ্যান্ড দ্য ওয়ারিয়র কালচার অব জাপান, ৪৭১-১৮৭৭: এ সোর্সবুক'-এর লেখক টমাস ডি কোনলান বলেন, "পর্তুগিজ ও স্প্যানিশদের লক্ষ্য ছিল দুটি। প্রথমটি ছিল জাপানিদের খ্রিষ্টধর্মে রূপান্তর করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের খ্রিষ্টধর্মে রূপান্তরিত করে জাপানকে পুরোপুরি দখল করে নেয়া। সামরিকভাবে পর্তুগিজরা জাপানি শক্তির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টিকতে পারেনি।"

'নিষ্ঠুর সময়'

জাপান ঐ সময় একটি দীর্ঘ ও বিশৃঙ্খল অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময়কার এসব উত্তেজনাময় ঘটনাবহুল গল্পই চিত্রিত হয়েছে 'শোগান' মিনিসিরিজটিতে। ১৪৬৭-১৬১৫ সালের সময় 'সেনগোকু জিদাই' বা 'যুদ্ধবর্তী সময়' নামে পরিচিত।

সামন্ত শাসক দেশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় জাপানকে সে সময় এক দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ১৬০০ শতকের গোড়ার দিকে দেশকে একত্রিত করার সাথে সাথে টোয়োটোমি হিদেয়োশি, 'শোগান'-এর চরিত্র তাইকো এবং তার শেষ উত্তরসূরি তোকুগাওয়া ইয়েয়াসু; এই তিনজন যুদ্ধবাজ শাসকের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন।

কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে যেতে হয় সহিংসতা, বলপ্রয়োগ এবং রক্তক্ষয়ী এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। তাদের সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল 'বুশি' নামের সামুরাই যোদ্ধাদের।

তলোয়ার বহনকারী এসব সামুরাই যোদ্ধারা আদর্শিকভাবে কঠোর নৈতিকতা মেনে চলে। 'সেনগোকু জিদাই'-এর লেখক ড্যানি চ্যাপলিন 'নোবুনাগা, হিদেয়োশি এন্ড ইয়েয়াসু: থ্রি ইউনিফায়ার অব জাপান'-এ সামুরাইদের বিভিন্ন উৎস থেকে আসা বিশ্বাস এবং নৈতিক অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।

সেখানে বলা হয়, "বৌদ্ধধর্ম থেকে সামুরাইরা মৃত্যুকে ভয় না করতে শিখেছিলেন। কারণ আত্মা শেষ পর্যন্ত একটা ভ্রম। শিন্টো থেকে সামুরাইরা শিখেছিলেন তাদের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা করতে। শিখেছিলেন আনুগত্য ও ধারাবাহিকতার গভীর অনুভূতি। কনফুসিয়াসের জ্ঞান থেকে নিয়েছিলেন কঠোরভাবে শ্রেণিবদ্ধ সমাজের আচার-আচরণ।"

কিন্তু এসব গুণ থাকা সত্ত্বেও তারা শৃঙ্খলা রক্ষায় ছিলেন নির্মম ও নিষ্ঠুর। উদাহরণস্বরূপ, সম্মান বজায় রাখতে নিম্নশ্রেণীর মানুষদের যেকোনো ধরনের সমস্যাপ্রবণ আচরণের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তাৎক্ষণিক শাস্তি দেয়ার অনুমতি ছিল সামুরাই সদস্যদের।

'কিরি-সুটে গোমেন' বা তাৎক্ষণিক কেটে ফেলার অনুমোদনের মতো নৃশংসতা নতুন এই সিরিজটির শুরুর দিকে একজন কৃষকের আক্ষরিক এবং রূপক দু'ভাবেই মাথা কাটা যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রদর্শিত হয়।

নিজের ও একমাত্র শাসকের প্রতি আনুগত্যই ছিল সামুরাই মূল্যবোধের মূল বিষয়। একইসাথে তার সেবায় মৃত্যুবরণ করা তাদের জন্য ছিল সর্বোচ্চ সম্মানের। শত্রুর হাতে ধরা পড়া কিংবা নিয়তির পরিহাসে আত্মহত্যা বরণ করে নেয়া ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে বড় অপমানের।

আধুনিক যুগেও এই আদর্শের উদাহরণ দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের 'কামিকাজি পাইলটদের' মধ্যে। 'সেপপুকু' বা সাধারণত ছোট এক ধরনের ছুরি দিয়ে নিজের পেট চিড়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতেন সামুরাইরা।

'শোগান' সিরিজে কাশিগি ইয়াবুশিগে (অভিনয়ে তাদানোবু আসানো) সমুদ্রে পড়ে গেলে অপমানজনক এই মৃত্যু থেকে নিজেকে রক্ষা করতে নিজের তলোয়ার দিয়েই 'সেপপুকু' আচার সম্পাদন করেন তিনি।

চ্যাপলি্নের ভাষ্যমতে, "এসব নৃশংস সময়ের গল্প। নিন্দিত বন্দিদের উপর প্রায়শই 'কাটানা' তলোয়ারগুলো পরীক্ষা করা হতো। যুদ্ধের সময় পুরস্কার হিসেবে হাজার হাজার মাথা কেটে নেয়া সামুরাইদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।"

ছবি: এফএক্স

'শোগান' সিরিজে দেখানো আরেকটি বিখ্যাত ঘটনা হলো ১৫৯৭ সালে জাপানে ব্ল্যাকথর্ন ও তার ক্রুদের আগমন। একটি বিধ্বস্ত স্প্যানিশ গ্যালিয়নের পাইলটের অনুপ্রবেশের বিষয়টি থেকে 'তাইকো'ই প্রথম স্প্যানিশদের মিশনারিজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে জাপান দখল নেয়ার উদ্দেশ্য ধারণা করেছিলেন।

হিদেয়োশি এর প্রতিক্রিয়ায় খ্রিষ্টধর্মের ২৬ ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিলেন। জাপানিরা নিষ্ঠুর সব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে। কিংবদন্তি দস্যু ইশিকাওয়া গোয়েমনকে ১৫৯৪ সালে কিয়োটোর কামো নদীর তীরে জীবন্ত সেদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছিল।

কোনলান বলেন, "সহিংস ও ভয়ংকর এসব শাস্তি ইচ্ছা করেই দেয়া হতো জনসম্মুখে, যাতে সকলের মাঝে আইনের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা যায়।" 

হিদেয়োশি তার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছিল। তাদের মধ্যে ছিল ৩৯ জন পুরুষ, নারী; এমনকি বাদ যায়নি শিশুও। নিষ্ঠুরতার এ ধরনের ঘটনা জাপানিদের নিয়ে পশ্চিমা ধারণার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল।

কোনলান বলেন, "হিদেয়োশি তার কাছের মানুষদের সাথে এমন কিছু করতে পারে দেখে ইউরোপীয়রা হতবাক হয়ে গিয়েছিল।"

১৬০০ সালে সেকিগাহারার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হয় জাপানের সামন্ত ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ 'সেনগোকু' সময়ের। এই যুদ্ধে একদিনে প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ নিহত কিংবা গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

এর মধ্য দিয়ে জাপান একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে। স্পেন ও পর্তুগালের ঔপনিবেশিক ও ধর্মীয় প্রভাব অপসারণ করার উদ্দেশ্যে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি সময়ের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় 'এডো' যুগে। তবে এই সময়টি খ্রিস্টানদের উপর নানা নিষেধাজ্ঞা ও নিপীড়নের জন্যও সুপরিচিত। ব্ল্যাকথর্ন হয়ত এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। তবে প্রথমেই তাকে যেতে হবে এক ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে।


অনুবাদ: জেনিফার এহসান 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.