চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২৪ : কাকে বলে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব?

বিনোদন

সৈকত দে
12 February, 2024, 07:10 pm
Last modified: 12 February, 2024, 09:01 pm
আমরা আমাদের অঞ্চলের ইতিহাস, পুরাণ ও  ভূগোলের গল্প সারা পৃথিবীর আগ্রহীদের কাছে পৌঁছে দেবো, আর পাশাপাশি নানা ভাষার উৎসুক, অণ্বেষক মানুষেরাও আমাদের কাছে আসবেন তাদের কাজ নিয়ে। পারস্পরিক বিনিময় ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে তৈরি হতে পারে কোনো একটা উৎসবের প্রকৃত আন্তর্জাতিক সুর।

কাকে বলে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব? 

পরিচালকদের অনুমতি ছাড়াই খান পাঁচেক ডাউনলোড করা ছবি দেখিয়ে, সারা দেশেই দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র চর্চার একটি ইতিহাস আমাদের আছে।

বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের একত্র সন্নিবেশ থাকলেই কি তা আন্তর্জাতিক হবে?  কেমন করে নির্ধারিত হয় প্রকৃত আন্তর্জাতিকতার সংজ্ঞা? এর একটি উত্তর হতে পারে সম্ভবত সমন্বয়।

আমরা আমাদের অঞ্চলের ইতিহাস, পুরাণ ও  ভূগোলের গল্প সারা পৃথিবীর আগ্রহীদের কাছে পৌঁছে দেবো, আর পাশাপাশি নানা ভাষার উৎসুক, অণ্বেষক মানুষেরাও আমাদের কাছে আসবেন তাদের কাজ নিয়ে। পারস্পরিক বিনিময় ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে তৈরি হতে পারে কোনো একটা উৎসবের প্রকৃত আন্তর্জাতিক সুর।

চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রথম আসরে এই সুর আবহ ব্যাপ্ত করেছিল। 

এমন নয় যে ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্ট আগে হয়নি, কিন্তু সেটি ছিল আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত নেপালি চলচ্চিত্র সংগঠন ফিল্ম সাউথ এশিয়ার দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রিক দ্বিবার্ষিক ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীর উৎসব। যেটির ছবি সংগ্রহ, ছবি বাছাই ও পরিচালকদের সঙ্গে

যোগাযোগ সব কিছুই করে তারা। বিস্তার: চট্টগ্রাম আর্টস কমপ্লেক্সের উদ্যোগে এটি চট্টগ্রামে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দুইটি উৎসবের আয়োজন করে।

অন্যদিকে, ২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে তিনদিনের  'লিবারেশন ডক ফেস্ট-২০২২' দেখেছে চট্টগ্রাম। 

ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানোর একটি ঐতিহ্য ছিল আমাদের শহরে। নতুন শিল্প সংগঠন 'বিষুব' এর আয়োজনে ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চট্টগ্রাম, চিত্রভাষা আর্ট গ্যালারি, ঢাকা ডকল্যাবের সহযোগিতায় তিন দিন ধরে যে চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হয়েছে, তা অনন্য নানা দিক থেকে।

বলছি শুরু থেকে।

৮ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালক ব্রুনো ল্যাক্রাম্প উৎসবের  উদ্বোধন করেন। এতে সর্বজন পরিচিত চিত্রশিল্পী ও অধ্যাপক ঢালী আল মামুন জানান স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ডকুমেন্টারির প্রয়োজনীয়তার কথা। 

ঢাকা ডকল্যাবের পরিচালক তারেক আহমেদ সুচিন্তিত ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন৷ চিত্রভাষার পক্ষে মইনুল আলম সবাইকে নিয়ে আরও কাজ করতে চাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন৷

ফেস্টিভ্যাল কমিউনিকেশন হেড ও তরুণ নির্মাতা তানিম ইবনে ইউসুফ তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে উৎসবটি সকলের ভালো লাগবে, এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন৷ উৎসব উপদেষ্টা রফিকুল আনোয়ার রাসেল চট্টগ্রামের ডকুমেন্টারি প্রদর্শনের একটি ছোটো ইতিহাস তুলে ধরেন। অনুবাদক আলম খোরশেদ ডকুমেন্টারির বাংলায়ন করতে চান সত্যচিত্র।

ডকুমেন্টারি নির্মাতার 'সত্য' হয়ে ওঠার দায় নেই। আমি মনে করি 'সত্য' একমাত্রিক বিষয় নয়৷ বহুস্তরীয় ও বহুমাত্রিক, স্থান কাল পাত্র সাপেক্ষ৷ ফলে, কেউ যদি ডকুমেন্টারির বাঙলায়ন করতে চান 'সত্য' ঠিকঠাক লাগে না৷ 

হুমায়রা বিলকিসকে দেখে শান্তি পেলাম। তার পরিচালিত ও সহপ্রযোজিত চলচ্চিত্র দিয়েই আমাদের উৎসব শুরু হয়েছে। থিংস আই কুড নেভার টেল মাই মাদার।

মায়ের সঙ্গে মেয়ের নানা মাত্রার সম্পর্কের গল্প৷ ধর্ম প্রশ্ন, প্রেম, ছেলেবেলা- এসব অত্যন্ত ব্যক্তিস্তর থেকে উঠে এসে সমষ্টিতে প্রসারিত হয়ে যেতে চায়৷ মায়ের কবিতা, সেকালের কাব্যভাষায় আন্তরিক।

তিনি যখন কবিতা পড়েন আর পাশেই শুয়ে থাকেন বাবা, মেয়ে শুনছে- চমৎকার একপারিবারিক আবহ ফোটে৷ প্রগতির প্রশ্নটিকে হুমায়রা কেবল ধর্ম দিয়ে মোকাবিলা করতে চান না, এটিই এই ডকুমেন্টারির শক্তি৷ প্রদর্শনীর পর পরিচালকের সঙ্গে আলাপের সেশনটি উপভোগ্য ঠেকেছে।

তবে অতিথিকে আরেকটু কথা বলতে দিলে ভালো হতো৷ আমরা অনেকেই কথা বেশি বলে তাকে যথেষ্ট বলতে দেইনি।

৯ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) চারটি চলচ্চিত্রের আয়োজন ছিল। প্যারিসের একজন বৃদ্ধ নারী এথনোলজিস্ট। দারফুর অঞ্চল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। দুই হাজার তিন থেকে চলে আসা জেনোসাইডে পলাতক বিধ্বস্ত মানুষ তার কাছ থেকে সাহায্য চাইতে আসে। 

তিনি তাদের ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে কাগজপত্র তৈরি করে। মারি হোসে তুবিয়ানা, কাজ শিখেছেন কিংবদন্তী পরিচালক জঁ রোশের কাছ থেকে। দারফুরে দুই হাজার তিন থেকে চলে আসা
গণহত্যা থেকে প্রাণসম্বল ফিরে আসা মানুষকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে সাহায্য করেন তিনি।

তার তোলা ষোলো মিলিমিটারের ফুটেজ আর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ক্যামিল পঁসে নির্মাণ করেছেন 'লা কমবাতন্ত' অর্থাৎ দ্য ফাইটার। এই ৯৪ মিনিটের ছবি দিয়েই দ্বিতীয় দিনের উৎসব শুরু। 

প্রতিটি মানুষের থাকতে পারে ব্যক্তিগত জাদুঘর। কুন্দেরা যেমন বলেন, আমাদের আসল লড়াই তো বিস্মরণের বিরুদ্ধে।

খন্দকার ওহিদা নির্মিত ১৮ মিনিটের চলচ্চিত্রটি এই উৎসবের সবচেয়ে কাব্যময় সৃজন। উপনিবেশোত্তর স্মৃতি সংরক্ষণের পদ্ধতি এবং গ্রামীণ ভারতে একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির অতি ব্যক্তিগত মহাবিশ্বের দ্বৈরথ এই ছবির রেখাসীমানা।

একজন বয়সী পুরুষ আর তার ভ্রাতৃষ্পুত্রীর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে স্বপ্নবাস্তবপ্রতিম চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে 'ড্রিম ইওর মিউজিয়াম'। সত্যিই তো, জাদুঘর স্বপ্নেও তৈরি হতে পারে। 

চিত্রা নদীর পাড়ে, এক প্রত্যন্ত গ্রামে পোষা ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করেন কিছু মৎস্যজীবী৷ একাধিক পুরস্কারজয়ী নির্মাতা শামছুল ইসলাম স্বপনের আধ ঘন্টার কাজ 'লতিকা'র বিষয় এটি।

পর্দায় আবহাওয়া পরিবর্তন, তাদের যাপন সত্য হয়েই আসে৷ ম্রো আদিবাসীদের জীবন দেখায় কবি ও নির্মাতা আসমা বীথির 'দপ্রুঝির'। সে জীবন কেমন করে বিপর্যস্ত হয়, পরিবেশ বিধ্বস্ত হওয়ার আগে তা কতোখানি জুড়ে আছে, ২৮ মিনিটের শ্রমসাধ্য চিত্রভাষ্য নির্মাণ তার নিদর্শন।

তৃতীয় দিন, ১০ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) ছবি ছিল দুটি। ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে পরিচিত মুখ, নির্মাতা আমিরুল আরহাম আমাদের কালের জরুরি মানুষ ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবন ও কাজ নিয়ে বানিয়েছিলেন 'জাফরুল্লাহ অ্যা পিপলস ডক্টর' ৪০ মিনিটের কাজ।

দীর্ঘ আলাপ করেছিলেন নির্মাতা, আগ্রহীদের উপকার হয়েছে৷ তবে এটি খসড়া, মূল কাজের পোস্ট প্রোডাকশন চলছে। 

তথ্যটি আরেকটি তথ্যচিত্র দেখবার আগ্রহ জাগায়। ডকুমেন্টারিতে তথ্যের সাথে কাব্যভাষা থাকলে আনন্দ হয়। এখানে তা অনুপস্থিত থাকলেও একজন রক্তমাংসের যোদ্ধাকে তার প্রতিবেশসহ পাওয়া কম উপার্জন নয়৷ আমাদের শহরেরই চিন্তক সুপিক আনোয়ার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করলেন৷ জানা গেলো, আমাদের স্বপনদা ঐ পরিবারের একজন। এইদিনের এসব আলাপ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিল। 

ফরাসী নির্মাতা জুলি ক্ল্যাভিয়েরের 'ল্য লিয়েম্ব' উৎসবের সমাপনী ছবি৷

দুনিয়ার সবচেয়ে পুরনো জাহাজ নিয়ে এই ডকুমেন্টারি। আমাদের সঙ্গে আলাপে জুলি জানান, তার বাবার তানজানিয়াতে কাজের সূত্রে তিনি একাধিকবার গিয়েছেন৷ তখনই এই জাহাজ তাকে টানে। আমি, এই নিবন্ধের লেখক বেড়ে উঠেছে অন্তত ১২শ' বছরের পুরনো বন্দর শহর চট্টগ্রামে।

জলাশয়, জলযান যেন আমার আর আমাদের অনেকের আত্মার সাথে মিশে আছে, ভেদচিহ্নরহিত। নানা গোত্র, ধর্ম আর আচরণের মানুষের সহাবস্থান চলচ্চিত্রটিকে অত্যন্ত রঙিন এক চিত্রপটের মর্যাদা দিয়েছে।

এই কথাগুলো গত সন্ধ্যায় (১০ ফেব্রুয়ারি) বলতে ইচ্ছে করেছিল একহারা গড়নের বিদেশি মেধাবী নির্মাতাকে। পারিনি ভাষা দূরত্বে।

উল্লেখ্য, জুলি ক্ল্যাভিয়ের দুইদিন ব্যাপী কর্মশালা করান আগ্রহী নিবন্ধিতদের। শিরোনাম ছিল ফিল্মমেকার : হাউ টু বি ইওর ওন ক্যামেরাম্যান।

সর্বশেষ ছবি শুরুর পূর্বে উৎসবের সমাপনী বক্তব্য রাখেন আয়োজক বিষুব আর্ট অর্গানাইজেশনের এর মামুনুর রশীদ।

শুরুতে যা বলেছিলাম, চলচ্চিত্র উৎসব আন্তর্জাতিক হওয়ার আরেকটি সূত্র বোধ করি, প্রতিটি চলচ্চিত্রের কোনো না কোনো বহির্দেশীয় সংযোগ থাকা। এই উৎসবের পাঁচটি বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি সে সংযোগ আবশ্যিকভাবে আছে। শারদ দাশ পোস্টার অঙ্কনের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন৷ পোস্টারে উৎসবের আত্মা ফুটে উঠেছে। সুমুদ্রিত স্মরণিকাটি সংগ্রহযোগ্য। 

উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শেষে উপস্থিত পাঁচজন নির্মাতার সঙ্গে আলাপে আগ্রহী আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আর সন্ধ্যা অতি ধীরে রাতের দিকে গড়ায়।

আমাদের মা-বাবারা আমাদের ঘরে ফেরার তাড়া দিতে শুরু করেন। আমরা এইভাবে চকিত বিশ্বদর্শন ছেড়ে চিরকালীন ছোটো ঘরে ফিরি আবার কোনোদিন বেরিয়ে পড়বার আশায়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.