সুরের খেলায় মাতিয়ে বিদায় নিলেন কবীর সুমন 

বিনোদন

22 October, 2022, 12:35 pm
Last modified: 22 October, 2022, 11:00 pm
"কলকাতায় আমাকে নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস নেই শ্রোতাদের। তবে বাংলাদেশের শ্রোতারা যে আমাকে অসম্ভব পছন্দ করেন তা আমি জীবন সায়াহ্নে এসে আবারও দেখে যেতে পারলাম। তাই শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার পরেও আমি ঢাকায় গান গাইতে আসার সাহস করেছি। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে আবারও উপলদ্ধি করলাম যে গান নিয়ে আমার জার্নিটা হয়তো ঠিকঠাকই ছিল।"

শুক্রবার (২১ অক্টোবর) বিকাল থেকেই রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে বিভিন্ন বয়স-পেশার সঙ্গীতপিপাসু শ্রোতার ঢল নামে। ছুটির দিন হওয়ায় সবার মধ্যে ছিল আনন্দমুখর অভিব্যক্তি। উপলক্ষ কবীর সুমনের গান।

অন্য দিনের চাইতে শুক্রবারের গানের আসরের আমেজটা ছিল আলাদা। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় অবস্থান করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন। এ সময়টায় মিডিয়া থেকে শুরু করে সঙ্গীতাঙ্গনের সবচেয়ে বড় খবর হয়ে ছিলেন তিনিই। বলা যায়, সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশে অবস্থান করে ভক্তদের গানের সুরে বেঁধে রেখেছিলেন বর্ষীয়ান এই গায়ক। সুরের এক ইন্দ্রজাল কিংবা সম্মোহনী শক্তি দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রেখেছিলেন বাংলা সঙ্গীতের এই বরপুত্র।

শুধু বাংলাদেশের শ্রোতারাই নন, ভারত থেকেও তার গান শোনার জন্য দর্শকদের উপস্থিতি চোখে পড়েছে। তবে ভারতের শ্রোতাদের নিয়ে কবীর সুমনের বিস্তর অভিযোগ, যা তিনি পাশ কাটিয়ে যাননি। বরং সেই বিরক্তির অনেকটাই ঢাকার শ্রোতাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন কবীর সুমন।

অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'কলকাতায় আমাকে নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস নেই শ্রোতাদের। তবে বাংলাদেশের শ্রোতারা যে আমাকে অসম্ভব পছন্দ করেন , তা আমি জীবন সায়াহ্নে এসে আবারও নিজে দেখে যেতে পারলাম। তাই শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার পরেও আমি ঢাকায় গান গাইতে আসার সাহস করেছি। কারন আমার একটা পরিবর্তন দরকার ছিল। আপনারা আমাকে এই সময়ে এসে যে আনন্দ দিলেন , তা আমাকে আরও কিছুদিন নির্বিঘ্নে সঙ্গীতসাধনা করার প্রেরণা যোগাবে।"

কথাগুলো বলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সুমন। তবে নিজের স্বভাবসুলভ রসিকতা একটুও ছাড়েননি তিনি। বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে মঞ্চে উঠার পর প্রথম আধা ঘন্টায় কোনো গান করেননি সুমন। যন্ত্র সংগীতের সঙ্গীতকারীদেরও মঞ্চে আনেননি এসময়। বরং স্মৃতিকাতরতাই বারবার ধরা পড়ছিল সুমনের কথায়। তিনি বলছিলেন তার বয়সের কথা, অসহায়ত্বেরও কথা। কথা বলতে বলতে চোখজোড়াও ভিজে আসে তার!

শেষ দিনের সংগীত সন্ধ্যায় সুমনের বন্ধুরাও মঞ্চে এসে তাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মুবিন চৌধুরী। পুরো অনুষ্ঠানজুড়েই গানের পাশাপাশি গল্পের মধ্যে শমসের মুবিনকে উদ্বৃত করছিলেন। কবীর সুমন বলেন, ' শমসের আমার অনেক পুরনো বন্ধু। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় ১৯৮০ সালে। তবে আরেকজনও আছেন, তিনি আসাদুজ্জামান নূর। বয়সে তিনি আমার বড় হলেও আমরা বন্ধু। বন্ধু ছাড়া কি জীবন চলে? চলে না। এই বড় বয়সেও তারা আমাকে মানসিকভাবে যে সাপোর্ট দিয়ে গেলেন, তা আমার স্মৃতির ভান্ডারে সংরক্ষিত থাকবে।'

উপস্থিত শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো, কবীর সুমনের কথাগুলো যেন গোগ্রাসে গিলছিলেন শ্রোতারা! সুমন যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, যিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে জানেন গান-কথা-সুরের জাদুতে!

একটা সময় মনে হচ্ছিলো, শ্রোতারা হয়তো গান শোনার কথা ভুলেই গিয়েছেন! তবে সুমন কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছিলেন শ্রোতাদের মনের কথা, তাই তো শুরু করেন গান। তবে অনেকটা দেরীতে। 'আজ জানালার কাছে ডেকে গেছে পাখির মতো সকাল' দিয়েই শেষদিনের পরিবেশনা শুরু করেন তিনি। এরপর 'খোদার কসম জান' গানটি গেয়ে শোনান এক নিমিষে।

এরপরে আবার কলকাতার প্রসঙ্গ। সুমন বলেন, "কলকাতায় তো আমি এখন অনেকটা ঘরবন্দি থাকি। কারন শরীরের জোড় কমে গেছে। আমার তো সংসার নেই। তাই সেবা করার জন্য এক দল লোক থাকে আমার চারপাশ ঘিরে। তারা হয়তোবা মনে করে, আমার কোনো গুরুত্বই নেই এখন। তবে বাংলাদেশে আসার পর থেকে গণমাধ্যমগুলো আমাকে নিয়ে যেভাবে লিখছে, তাতে আমি অভিভূত তো বটেই; পাশাপাশি কলকাতার অনেকেই আবেগে কাদছেন। বাংলাদেশের শ্রোতারা আমাকে এতো সম্মান দিচ্ছেন, তা গণমাধ্যমের বরাতে কলকাতার সবাই দেখতে পারছেন। আমি জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে আবারও উপলদ্ধি করলাম যে হয়ত গান নিয়ে আমার জার্নিটা ঠিকঠাকই ছিল।' বলেই আবারও গানের দিকে মনোনিবেশ করলেন।

এরপর একে একে গাইলেন 'জাতিস্বর', 'দিনটা আজকে অন্য রকম ছিল' , ' চেনা দু:খ' , 'হাল ছেড়োনা বন্ধু' , ' তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা', ' হারিয়ে যেওনা' , ' আমি চাই' গানগুলো। এরপর আবারও অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে কথা শুরু করেন।' পুরো অনুষ্ঠানে ২৪টি গান গেয়ে শুনিয়েছেন সুমন।

'হঠাৎ ফেরারী কোনো স্মৃতি কাঁদাবেই' শিরোনামে কবীর সুমনের একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের শেষদিনের আয়োজনটির ইতি টানেন তিনি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'তোমাকে চাই' দিয়ে। গানটি গাওয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রোতারা তার সঙ্গে গলা মেলান, সুরের মূর্ছনায় অন্যরকম মায়া ছড়িয়ে পড়ে হলরুমজুড়ে! গান শেষ করার পরপরই কবীর সুমন উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সম্মান জানান সবাইকে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় কবীর সুমন হয়তো কিছুটা মানসিক প্রশান্তি অর্জনের জন্যই ঢাকায় গেয়ে গেলেন। বাংলা গানের এই কালজয়ী, বহুমাত্রিক প্রতিভার শিল্পীকে মনের মণিকোঠায় স্থান করে সঙ্গীতপিপাসুরাও ঘরেন ফিরে গেলেন হেমন্তের সন্ধ্যায়। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.