‘হাওয়া’-সূত্রে মনে পড়ল...

বিনোদন

30 July, 2022, 03:20 pm
Last modified: 30 July, 2022, 03:20 pm
বাংলায় জলকেন্দ্রিক সব উপন্যাসই নদীমুখী আর এই উপন্যাসের গন্তব্য সমুদ্রের দিকে৷ 'হাওয়া' বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের প্রথম সমুদ্র গমনের গল্প বলে।

আমাদের চট্টগ্রাম শহরে তিরিশ বছর আগে অনেকগুলো সিনেমা হল ছিল। আমাদের কোতোয়ালীর বাসার আশেপাশেই ছিলো রঙ্গম সিনেমা, রঙ্গম সিনেমার গা লাগোয়া আব্দুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার। উবে গেছে। লালদীঘির মাঠ পেরিয়ে গেলেই খুরশিদ মহল, দুই মিনিট হাঁটলে সিনেমা প্যালেস, তার দরজা থেকে বিভাগীয় গ্রন্থাগারের পেছন দিকটা দেখা যায়। নিউ মার্কেটের উল্টোদিকে কারেন্ট বুক সেন্টারের পাশেই জলসা সিনেমা হল, সেই সময়ের অভিজাত হলের একটা। 

স্টেশন রোডে ঢুকে পড়লে প্রথমে নুপুর আর মেলোডি, পাশাপাশি- মেলোডিতে এক টিকিটে দুই ছবি চলতো, নুপুরে বাংলা সিনেমা। চট্টগ্রাম রেল স্টেশন পেরিয়ে বটতলী স্টেশনের দিকে যেতে বিখ্যাত মাসুদ রানার ক্ষণিকের আশ্রয় মিশকা হোটেল আর উজালা সিনেমা হল কাছাকাছি। সদরঘাটের দিকে গেলে লায়ন সিনেমা, একেবারে কাছেই ডায়মন্ড রেস্টুরেন্টে চায়ে পরটা চুবিয়ে খেয়ে মনে পড়ে রুবেলের 'ডন' দেখতে গিয়েছিলাম। 

কাজীর দেউড়ি মোড়ের গা লাগোয়া আলমাস দিনার যেন দুই ভাই, একই হিসেবে চলতো, একটাতে বাংলা অন্যটিতে ইংরেজি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের হল।  অনেক পরের দিকে ভুতুড়ে বাড়ি, ভ্রাম্যমাণ নিশিপদ্ম দিবালোকের আবির্ভাব ও বক্স আসনে নিশ্চিত আনন্দ প্রদানের চেষ্টা। আবার কাঁচা বাজারের ঝুমুর৷ আগ্রাবাদের বনানী কমপ্লেক্সে 'টাইটানিক' রিলিজের স্মৃতি আজো মনে আছে। 

শুরুর অল্প পরে জলের নিচে গ্র্যান্ড পিয়ানো দেখে একজন চেঁচিয়ে উঠেছিলো, 'দেইক্কো না কত্তর হারমোনিয়াম!' (দেখেছো কতো বড়ো হারমোনিয়াম!) বনানীর বিপরীত রাস্তায় গোঁসাইলডাঙার দিকেও সিনেমা হল। ফকিরহাটের দিকে গেলে সানাই৷ এমন আরো অন্তত পাঁচটা হল।

সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলন, বিকল্প ধারার আন্দোলন, সৎ চলচ্চিত্রের প্রসার, অনুদানের ছবি না গণ অর্থায়ন, প্রলেতারিয়েতের কথা নেই কেন, শুধুই ধনী গরিবের প্রেম কি বাস্তবতা দেখায়, পোস্টের কালি লেপে অশ্লীলতা দূর করতে হবে- এইসব প্রগতিশীল বা বামপন্থী, রুচিশীল কচকচির মধ্যে কয়েক কোটি মানুষের শহরে সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলো, মাত্র চারটে টিকে আছে কোনোরকম। এটির কারণ একটাই- আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সব সময় আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকে গৌণ শিল্পমাধ্যম ভেবেছেন। এমন যে বদরুদ্দিন উমর, নব্বই বছরের জীবনে সিনেমা নিয়ে লিখেছেন মাত্র সাড়ে তিন পাতার একটি রচনা!

২.
একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে মানুষ যখন সিনেমা হলে গাঁটের পয়সা খরচ করে যায়, তখন বুঝতে হবে ছবিটিতে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে, যে কারণে বুদ্ধিজীবীরা যাকে ইংরেজিতে 'মাস পিপল' বলেন, সেসব সাধারণ মানুষ যাচ্ছেন, অনেক সময় পরিবার নিয়ে৷ 

আমরা, জনগণতান্ত্রিক ফেসবুক রাষ্ট্রের অধিবাসীরা শুরুর দিন থেকেই শুরু করে দিই ছবিটি কত খারাপ তা নিয়ে কাটাকুটি। আমরা তখন সিনেমাটোগ্রাফি বুঝি, বুঝি গল্পের অন্দরমহল। একটা বই বা সিনেমা নিয়ে মন্তব্য করবার আগে আমাদের ভেবে দেখতে হয়, কে কোথায় বসে কি ভাববেন! স্বচ্ছ মনে দেশের একজন সাধারণ শিল্প উপভোক্তা হিসেবে সৎ আলোচনা আমাদের হাজারো প্রতিবন্ধকতা। 

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের এই অর্ধমৃত দশার পেছনে এই বিজ্ঞ ক্রিটিকদের ভূমিকাও অল্প নয়। ভেবে দেখুন, সুদূর প্রাচীন কালে কেবল গল্পের সারল্যের জোরে 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না' বাংলার আপামর গ্রামশহর কেমন করে নিজের করে নিয়েছিল! সালমান শাহের আত্মহত্যা বা হত্যার তর্কযুদ্ধ শেষ হতে হতে মুক্তি পেল তাঁর শেষ পূর্ণাঙ্গ ছবি 'সত্যের মৃত্যু নেই'। 

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম ছবি 'আগুনের পরশমণি' মুক্তি পেলে প্রায় দেড় ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যারা টিকেট কেটেছিল, বিনীত মস্তকে স্বীকার করি আমি তাঁদের একজন কেন না আমরা বাংলাদেশের সিনেমাকে ভালোবাসি৷ একটা 'মাটির ময়না', একটা 'মনপুরা' কিংবা 'আয়নাবাজি' কখনো আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের রেজারেকশনে ভূমিকা রাখতে পারবে না। তবে প্রতিনিয়ত যদি ভালো ছবির পেছনে জনসাধারণ আর সরকারের যৌথ সমর্থন থাকে, তাহলে পরিস্থিতি বদলাতে বেশি সময় লাগবে না।

৩. 
জুলাই ২৯, মুক্তির প্রথম দিনে প্রথম শোতে বন্ধু রাব্বানীর সাথে দেখে ফেলেছিলাম 'হাওয়া', নগরীর সুগন্ধা সিনেমা হলে। এই হলটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত নস্টালজিয়া আছে,পুনর্নির্মাণের আগে এটাই ছিলো ঝুমুর। স্কুল বা কোচিং পলাতক একাধিক দুপুরের স্মৃতি এই হলের চেয়ারে গচ্ছিত আছে৷

সকাল সাড়ে দশটার শোতেও অসংখ্য মানুষ, অধিকাংশ তরুণ সমাজ যারা কি না ছুটির দিনের সকালে খানিকটা দেরিতে ওঠেন বলে প্রবাদসমর্থিত; অসামান্য লাগলো মানুষের এই একত্রিত হওয়া। সুগন্ধা হলের প্রজেকশন এবং ভেতরের পরিবেশ মধ্যবিত্তবান্ধব।

কি আছে 'হাওয়া'-তে? একটি সমুদ্রগামী জেলে জাহাজ, আটজন জেলে এবং এক রহস্যময় নারী৷ আমার মনে আছে, ২০০৬ সালে হালের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, তখনকার কলেজ শিক্ষক হরিশংকর জলদাস প্রথম উপন্যাস 'জলপুত্র'- এ বেশ খানিকটা হইচই ফেলে দিয়েছিলেন৷

'কালি ও কলম'-এর জন্যে রিভিউ করেছিলাম কচি বয়সে, দেখেছিলাম বাংলায় জলকেন্দ্রিক সব উপন্যাসই নদীমুখী আর এই উপন্যাসের গন্তব্য সমুদ্রের দিকে৷ 'হাওয়া' বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের প্রথম সমুদ্র গমনের গল্প বলে।

প্রথমার্ধে একজন ঘাটপারের ক্যানভাসার এক ধরনের সূত্রধরের কাজ করেন। ইশারা ভাষায় গল্পটিই বলে দেন। জাহাজের প্রধান মাঝি চান মাঝির চরিত্রটি বাংলা ভাষায় আনপ্যারালাল। কাম, হিংস্রতা, উদাসীনতা-এইরকম নানা পৃথক পৃথক ভাবের খেলা দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফলেই সম্ভব। চঞ্চল চৌধুরী, আমরা জানি চিত্রনাট্য বেছে কাজ করায় বিশ্বাসী৷

আমাদের শহরের গুণী মঞ্চাভিনেতা নাসির উদ্দিন খান আমাদের অতি আপনজন। অভিনয়ের জন্যে তাঁর নিষ্ঠা দেখার বয়স আর আমার বেড়ে ওঠা সমান্তরাল৷ তিনি একেকটি চরিত্রে যেমন করে নিজেকে চূর্ণ করেন, সেই চরিত্রের ভেতর বাস করেন তাতে আমাদেরই অবাক লাগে এই কি সেই নাসির ভাই যিনি আমাদের নিঃশ্বাস দূরত্বে বসে কোনো একটি কৌতুক নিজে আমাদের উপহার দিয়েছেন কিংবা সম্মিলিত হাসিতে যুক্ত হয়েছেন!

এক কন্যা জেলেদের জালে উঠে আসে৷ রহিতশ্বাস সেই কন্যা জাদুবাস্তবের গুণেই প্রাণ ফিরে পায়। মাত্র একজন বাদে, প্রায় সকলেই তাকে, রহস্যময়ী নারীকে পেতে চায়। ছেলেটির সাথেই তার প্রেম।

গুলতি, মেয়েটির নাম, নাজিফা তুষি-তিনি কি পুরাণপ্রতিমা অধুনা বাংলা চলচ্চিত্রের? না আদতে মাছের দেশের মেয়ে? বাংলার মাতৃমূর্তি সুডৌল, স্বাস্থ্যল, তিনি স্নেহবতী তাঁর চারপাশের প্রাণেদের প্রতি। গুলতি দেখা যায় রান্না করে দিচ্ছে,জেলেদের সাথে সহজাত সারল্যে মজা করছে। এই আমাদের বাঙালী নারী, সরল ও উচ্ছ্বল, মিশুক ও আতিথ্যপরায়ণ। কিন্তু পুরাণমতে, যিনি দেবী দুর্গা তিনিই চন্ডী। স্নেহের আদর ও বরাভয় হয়ে উঠতে পারে রক্তাক্ত ত্রিশূল ও মৃত্যুর ঠিকানা।

হাওয়া-র গল্প দেশজ। বাংলার পুরাণের শৈল্পিক ব্যবহার এই চলচ্চিত্রের প্রাণ। গল্প বয়ানের দু একটি দুর্বলতা ঢেকে দেয় জাদুবাস্তবের দুরন্ত প্রয়োগসাফল্য। সমুদ্রগামীদের জেলেদের জীবনের যে যৌথতা তা পর্দায় চোখের স্বস্তি দেয়। কোথাও আরোপিত মনে হয়নি৷

গুলতি চরিত্রের যে ওজন গল্পের স্বার্থে তার তুলনায় তাঁর সাজসজ্জা যে অধিকতর গ্ল্যামারাস হলো, বেশ লাস্য ছড়ালো-;এই বিষয়টি জাগিয়ে দিতে পারে রায় বাবুর 'অশনি সংকেত' চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যে দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার এক সাধারণ গৃহবধূ'র চরিত্রে ববিতার ভেজা শরীরে জলতল থেকে আবির্ভূত হবার স্মৃতিসূত্রে পুরনো বিতর্ক- ক্ষুধা ও গ্ল্যামারের বিরোধ আছে না নেই!

নারী পৃথিবীর প্রথম বীজ আবিষ্কারক। তিনি প্রাণ ও নদীর মত বহতা, স্নেহে পূর্ণ এবং ক্রোধে নৃমুন্ডমালিনী৷ তাঁকে প্রণাম।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.