‘এক বয়স্ক ফরাসি মহিলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন’

বিনোদন

টিবিএস ডেস্ক
13 July, 2021, 10:15 pm
Last modified: 13 July, 2021, 10:26 pm
কানের সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা আমাকে আজমেরী নামে ডাকছেন, কিন্তু বাকি সবাই ডাকছেন রেহানা নামে।

কানে ছবিটির প্রিমিয়ার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় প্রশংসার জোয়ার। উপস্থিত দর্শকরা স্ট্যান্ডিং ওভেশনের মাধ্যমে সম্মান জানান প্রথম বাংলাদেশি ছবি রেহানা মরিয়ম নূরকে, কান চলচ্চিত্র উৎসবে  আঁ সার্তে রেগার বিভাগে এটিই প্রথম মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশি ছবি। ছবিটিতে একটি মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া। তার অনুবাদ প্রকাশ করা হলো টিবিএস-এর পাঠকদের জন্য।
 
প্রধান চরিত্রটিতে অভিনয় করা আপনার জন্য কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

এই চরিত্রে অভিনয় করা আমার জন্য খুব যন্ত্রণাদায়ক ছিল। আমি  ক্রনিক ডিপ্রেশনের রোগী, অভিনয়ও করেছি এমন একটি ডিপ্রেশনের রোগীর চরিত্রে। ১৯ বছর বয়স থেকেই আমি তীব্র ডিপ্রেশনে ভুগছি। সত্যি বলতে কী, আমাদের ছবিটি কানের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমি আবার অ্যান্টি-ডিপ্রেশননের ওষুধ নিতে শুরু করেছিলাম। থেরাপিও নিচ্ছি...আমাকে প্রতিনিয়ত ডিপ্রেশনের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। আমার জীবনটাই লড়াইয়ের জীবন। আমি একজন সিঙ্গেল মা। আমি একজন নারীবাদী। আমি প্রতিনিয়ত আমার অধিকারের জন্য লড়াই করছি... আর চরিত্র আমাকে আবার নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে। আমার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তা আবার এই ছবির মাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। এই ব্যাপারটা সত্যিই দারুণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই যন্ত্রণা আজও আমার মধ্যে রয়েছে। আমি প্রশিক্ষণ পাওয়া অভিনেত্রী নই যে এমন একটি চরিত্র করার পর অনায়াসে সেই আবেগ থেকে বের হয়ে আসতে পারব। 


 
পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

বোধহয় বলে বুঝাতে পারব না, ও আমার জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে...কিংবা আমার জীবনকে কিভাবে বদলে দিয়েছে। আমার বাবার পর ও-ই দ্বিতীয় পুরুষ, যে আমার ওপর এত বড় প্রভাব ফেলতে পেরেছে। আমার জীবনের খুব কম পুরুষই, আমার বাবা ও ভাইয়েরা ছাড়া, সত্যিকার অর্থে আমাকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে। বহু পুরুষ আমাকে নানাভাবে আঘাত দিয়েছে, কিন্তু সাদ আমাকে একজন মানুষ হিসেবে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। 

ওর ব্যক্তিগত জীবন, ওর লক্ষ্য ও দর্শন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ওর মধ্যে আমি সততা ও সরলতা দেখতে পেয়েছি। ও এতদূর আসতে পেরেছে স্রেফ মেধা, সততা এবং একাগ্রতার জোরে। সাদের সঙ্গে এই ভ্রমণটা আমি আজীবন মনে রাখব। এই ভ্রমণ আমার জীবন ও জীবনদর্শন সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। ওর কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। ও আমার উপর বিশ্বাস রেখেছে। আমার সঙ্গে মানিয়ে চলা সহজ নয়। চিত্রনাট্য হাতে পাওয়ার পরও ওকে বলেছিলাম যে চরিত্রটা হয়তো আমি করতে পারব না। কিন্তু ও বলেছিল এই চরিত্রটা একমাত্র আমিই করতে পারব। আমার ওপর ওর এই বিশ্বাস আজ আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। 
 
রেহানা মরিয়ম নূরের প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর যখন দেখলেন স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেওয়া হচ্ছে, তখন আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?

অসাধারণ অনুভূতি...আসলে সেই মুহূর্তে আমার মধ্যে যে আবেগ কাজ করছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ, দারুণ আনন্দ হচ্ছিল, গর্ব হচ্ছিল...আমার দেশের জন্য। আমাদের মনে হচ্ছিল, স্ট্যান্ডিং ওভেশনটা আমাদের দেশই পাচ্ছে। এ কারণে আমি কান্না আটকাতে পারিনি। 

প্রদর্শনীর পর ঠিক কী হয়েছিল?

এন্ড ক্রেডিট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা করতালিতে ফেটে পড়েন...সবাই দাঁড়িয়ে যান। প্রদর্শনীতে প্রায় ৯৫০ জন মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে করতালি দেন তারা। এক বয়স্ক ফরাসি মহিলা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। আমার দুগাল বেয়েও অশ্রুর বন্যা নামে। 

আপনারা কি ওখানে এরকম প্রতিক্রিয়া পাওয়ার কথা ভেবেছিলেন?

আমি ভাবতেই পারিনি সিনেমাটা এত বড় সম্মান পাবে। এই ছবির শুটিং করার সময় আমার শুধু মনে হচ্ছিল আমি এমন একটা কাজ করছি যা আগে কখনো বাংলাদেশে হয়নি। কানের জন্য নির্বাচিত হওয়াই ছবিটির জন্য বিশাল সম্মানের ব্যাপার। তারওপরে এখানে প্রিমিয়ার...কিন্তু হুট করে যখন ব্যাপারটা ঘটে গেল, কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল সবকিছু। স্বপ্নেও এমনটা ভাবতে পারিনি। আমাদের পরিচালক দারুণ মেধাবী। আর আমার বিশ্বাস, এই ছবিটা বাংলাদেশের জন্য অস্কারও নিয়ে আসবে। সাদের ব্যাপারে আমি সত্যিই খুব আত্মবিশ্বাসী...কিন্তু নিজের কাছ থেকে আমার খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না। মনে হচ্ছে, স্বপ্ন সত্যি হলো যেন। 
 
ছবিটি কানের দর্শকদের একাত্ম করতে পারল কীভাবে? কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন আপনারা?

ছবিটি দেখার পর অনেকের চোখের পানি এসেছে। কেউ কেউ লাঞ্চ করার সময় আমাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে গেছেন। ডিনারের পর আমি হোটেলে যাচ্ছিলাম...সে সময় দুর্ঘটনাবশত এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। তাকে 'দুঃখিত' বললাম, কিন্তু তিনি আমার কণ্ঠ চিনে ফেললেন। আমার মুখে মাস্ক ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি রেহানা? আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি?' আমি নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে কিছুটা নিজের ভাষায়, কিছুটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ছবিটি সম্পর্কে তার অনুভূতি এবং আবেগ প্রকাশ করতে লাগলেন। ছবিটির সঙ্গে তিনি কেন একাত্মবোধ করতে পেরেছেন, তা বললেন। রেহানার গভীর যন্ত্রণা তিনি নিজে কেন অনুভব করতে পেরেছেন, তা-ও জানালেন। 


 
কানের সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা আমাকে আজমেরী নামে ডাকছেন, কিন্তু বাকি সবাই ডাকছেন রেহানা নামে। কানের জুরি বোর্ডের সদস্যরা এবং কানের সভাপতি আমাদের সঙ্গে খুব আন্তরিকভাবে কথা বলেছেন। সবাই আমাদেরকে চিনতে পারছেন এবং আমাদের জন্য, আমাদের ছবির জন্য আনন্দ প্রকাশ করছেন। এটা আমাদের জন্য খুব বড় অর্জন। মানুষ আমাদেরকে চিনছে, আমাদের কাজের মাধ্যমে আমাদেরকে নিয়ে আলোচনা করছে। এটা আমাদের জন্য বড় গর্ব। 

বাংলাদেশি ব্র্যান্ড আড়ং-এর জামদানি শাড়ি পড়ে ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেটে আপনার হাঁটার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আপনার সাজ-সজ্জার ব্যাপারে কিছু বলুন। 

কানের লাল গালিচায় হাঁটা প্রথম বাংলাদেশি অভিনেত্রী আমি। কাজেই আমার ওপর বড় দায়িত্ব ছিল। আমি আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি...আমার মনে হয়েছিল আমি আমার দেশকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছি। সুতরাং, কোন পোশাক পরে লালগালিচায় হাঁটব, তা নিয়ে যখন ভাবতে বসলাম, তখন আড়ঙের জামদানির কথাটাই সবার আগে মাথায় এল। 

ব্লাউজের ডিজাইনটাও ওরা দারুণ করেছে। আমি মুগ্ধ। এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন একটা অনন্য শাড়ি বানিয়ে দেওয়ার জন্য আড়ঙের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

রেড কার্পেটে হাঁটার অনুভূতিটা কেমন? 

সেদিন আমাদের ছবির প্রিমিয়ার ছিল, তাই আমি একটু নার্ভাস ছিলাম। পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে যেরকম টেনশন হয়, ঠিক সেরকম। আগের রাতে ঘুমাতে পারিনি। সকালে তৈরি হয়ে নিই। উত্তেজনা, চাপা অস্থিরতা এবং নার্ভাসনেস—সব একসঙ্গে কাজ করছিল আমার ভেতরে। ছবির প্রিমিয়ারের পর লালগালিচায় হাঁটা খুব উপভোগ করেছি, কারণ ততক্ষণে আন্তর্জাতিক মিডিয়া আমাদের নাম জেনে গেছে। ফটোগ্রাফাররা আমাকে আলাদাভাবে চিনতে পারছে, আমার ছবি তুলছে। ব্যাপারটা আমাকে সত্যি খুব খুশি করেছিল।


 
কানে এখন আপনাদের প্রতিদিনের রুটিন কী? ছবি দেখছেন, লোকজনের সঙ্গে দেখা করছেন, ওখানকার পরিবেশ উপভোগ করছেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো মুখোমুখি হচ্ছেন?

এখানে আমাদের খুব ব্যস্ত শিডিউল। একের পর এক অনুষ্ঠানে যেতে হচ্ছে...একের পর এক প্রেস মিট করছি, সাক্ষাৎকার দিচ্ছি...এই তো একটা ছবি দেখলাম...সামনে আরো দেখার প্ল্যান করছি। প্রতিদিন একটা-দুটো ছবি দেখছি। এই সুযোগ জীবনে আর কখনো পাবো কিনা জানি না। অবশ্য আমাদের পরিচালক এখানে আবার আসবে, কারণ ও দারুণ মেধাবী। আশা করছি ভবিষ্যতে আমি আরো চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পাব। ওসব চরিত্রের সুবাদে বিশ্বমঞ্চে হাজির হতে পারব। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমি এই অসাধারণ পরিবেশ উপভোগ করছি। কানের দর্শকদের সঙ্গে বসে ছবি দেখার অনুভূতিই আলাদা। এখানকার দর্শকদের ব্যাপারে দু-একটা কথা বলতে চাই। তারা দারুণ আবেগি, ভদ্র এবং সংবেদনশীল...তাই এমন দর্শকদের সাথে ছবি দেখাটা একটা বিশেষ অনুভূতি। 

এখন পর্যন্ত আপনার কান সফর কেমন কাটল? স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে কি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। পুরো ব্যাপারটাই একটা জীবন্ত স্বপ্নের মতো। এমন স্বপ্ন আমি জীবনেও দেখার সাহস পাইনি। আমার পরিচালকের এমন স্বপ্ন ছিল এবং সেই স্বপ্নকে ও বাস্তবে রূপ দিয়েছে। আমাকে রেহানা চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার জন্যে ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। 

কানের কোন অনুষ্ঠান দেখার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছেন? অথবা ওখানে কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে চান?

১৬ জুলাইয়ের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করছি। আমি সত্যিই আশাবাদী... এবং বিশ্বাস করি যে আমার পরিচালক পুরস্কার পাবে। এই ছবিটার জন্য সে অনেক পরিশ্রম করেছে। আমাদের ছবি কানে কোনো পুরস্কার জিততে পারলে সেটা দারুণ অর্জন হবে। এর চেয়ে বড় কোনো অর্জন হতে পারে না।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.