বলিউডের তিন খানের সূত্র ধরে ভারতের একাল-সেকাল
নানবিধ পরিবর্তনের মধ্যে যাওয়ার ৩০ বছর পরেও বলিউডের তিন খানের জনপ্রিয়তা কী করে বজায় রইল? তারা মূলত তাদের দর্শকদের সাহায্যে একটি কল্পজগত তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে সহজেই দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণে হয়েছেন সফল। এইসব কল্পকাহিনি ছিল তাদেরই করা সিনেমার ফলাফল।
'মধ্যবিত্ত নায়ক'
'কেয়ামত সে কেয়ামত তাক'-এ অভিনয় করা 'পাশের বাড়ির ছেলেটি'ই সময়ের পরিক্রমায় হয়ে ওঠেন একজন মধ্যবিত্ত নায়ক। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে আমির খান বরাবরই নিজেকে নতুনভাবে উদঘাটন করেছেন। নিজেকে নানারূপে প্রকাশের তার এই যাত্রা শুরু হয় ২০০১ থেকে। একদিকে বাউণ্ডুলে ও তারুণ্যদীপ্ত 'দিল চাহতা হ্যায়', অপরদিকে মহাকাব্যিক 'লগন'-এর মাধ্যমে সহজেই অভিনয়ে আমির খানের বহুমুখী দিক ফুটে ওঠে।
'দিল চাহতা হ্যায়' সিনেমায় তিনি ধনী বাবার টাকায় চলা এক তরুণ হিসেবে অভিনয় করেছেন। পরবর্তীকালে ভালোবাসার মোহে পড়ে এবং পরিবার থেকে দূরে থেকে জীবনকে আলাদাভাবে আবিষ্কার করে আকাশ (আমিরের চরিত্র)। এই সিনেমায় মূলত ভারতের সেইসব তরুণের প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়েছে, যারা পড়াশোনা অথবা চাকরির বদৌলতে পরিবার ছেড়ে দূরে চলে আসেন। 'দিল চাহতা হ্যায়' তাদেরই প্রাণোচ্ছল জীবনের আকুতির সচিত্র।
অপরদিকে, ১৮৯৩ সময়কালের প্রেক্ষাপটে তৈরি 'লগন' সিনেমায় আমির কেন্দ্রীয় চরিত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকদের সামনে বুক উঁচু করে দাঁড়ানো একদল গ্রামের সহজ-সরল মানুষের গল্প পরিবেশন করেন। এই সিনেমায় শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও উল্লেখ করা হয়েছে। সিনেমাতে দেখানো হয়, লগনের নেতৃত্বে গ্রামের লোকেরা ক্রিকেট দল গঠন করে এবং ব্রিটিশদের হারিয়ে তবেই তারা ক্ষান্ত হয়। লগন মূলত একজন হার না মানা দেশপ্রেমিক। তার এই চরিত্র আদতেই মানুষের মনে দেশপ্রেমের উদ্রেক ঘটায়।
এই দুটি ভিন্নধর্মী সিনেমার মাধ্যমে চিন্তাশীল এবং বিশ্লেষণধর্মী দর্শকের কাছে আমির খান একজন 'সুপারস্টার' হিসেবে জায়গা করে নেন। তার অন্যান্য সিনেমাও জীবন ও সমাজের কোনো না কোনো বিষয় ফুটিয়ে তোলে।
আমিরের দর্শকপ্রিয় কিছু সিনেমা ও সেগুলোর মূল গল্প: 'তারে জামিন পার' (২০০৭) ডিসলেক্সিক শিশুদের নিয়ে; 'থ্রি ইডিয়টস' (২০০৯) শিক্ষাব্যবস্থার অসঙ্গতি নিয়ে; 'দাঙ্গাল' (২০১৬) নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে। এছাড়া, 'সত্যমেভ জয়তে' (২০১২) নামে টেলিভিশন শোয়ের মাধ্যমে তিনি বরাবরই সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্যে কাজ করা দূরদর্শিতাসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছেন।
'এনআরআই নায়ক'
ব্যাপক জনপ্রিয় 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে' (১৯৯৫) ও তূলনামূলক কম পরিচিত 'পরদেশ'-এর (১৯৯৭) মাধ্যমে শাহরুখ খানের এনআরআই নায়ক হওয়ার যাত্রা শুরু। এর আগে ১৯৯৩ সালে তার অভিনীত 'বাজিগর' ও 'ডর' চলচ্চিত্র দুটি তাকে বাস্তবিকভাবে একজন মানুষ হিসেবে পরিবর্তিত হতে বাধ্য করে। নব্বইয়ের দশকের এই দুটি সিনেমার মাধ্যমেই মূলত ভারতীয় সিনেমা অঙ্গনে মূল চরিত্র হিসেবে একজন 'মানসিকভাবে বিকারগস্ত' লোককে দেখানো হয়। সেখান থেকেই ভারতীয় সিনেমা নতুনভাবে গড়ে ওঠা শুরু করে।
দিল্লি থেকে ১০ হাজার রুপি পকেটে নিয়ে মুম্বাই আসা শাহরুখ ছিলেন এই পরিবর্তনের মূল নায়ক। বিভিন্নভাবেই তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেটি সিনেমায় ফুটিয়ে তুলেছেন। পশ্চিমা দেশে থেকেও যে নিজের শেকড় ধারণ করা যায়, তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ তার 'স্বদেশ' (২০০৪)। এই সিনেমায় তিনি নাসার একজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর চরিত্রে অভিনয় করেন। আয়া কাভেরি আম্মার গ্রামে হাইড্রোইলেক্ট্রিক শক্তি চালিত ইউনিট স্থাপনের জন্যে আসা ওই চরিত্র পশ্চিমা দুনিয়ায় বসবাস সত্ত্বেও নিজের মাতৃভূমিকে ভালোবাসারই প্রতিচ্ছবি।
১৯৭০ সালে মনোজ ভারত কুমারের তৈরি 'পুরব ঔর পাশ্চিম' সিনেমায় পশ্চিমা জগতকে ভারতীয়দের ধ্বংস করার বিরাট এক মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়। ধূমপান, মদ্যপান ও স্বর্ণকেশীদের অনৈতিক হিসেবে দেখানো হয় সায়রা বানু অভিনীত প্রীতি চরিত্রের মাধ্যমে। যদিও এনআরআই নায়কের বেড়ে ওঠা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, এই নায়কের সফলতাই দর্শকদের দেখানো হয়েছে। তবে শাহরুখ খানের ভাষ্যমতে তিনি 'শাহরুখ খান কল্পকাহিনির' একজন কর্মচারী মাত্র। তিনি বলেন, 'আমি গরিব ছিলাম এবং জানি, এতে কোনো রোমাঞ্চকর অনুভূতি নেই।'
'শ্রমিক শ্রেণির নায়ক'
'তেরে নাম' (২০০৩) সিনেমার মাধ্যমে সালমান খান বলিউডে আবারও শ্রমিক শ্রেণির নায়কের চরিত্র নিয়ে আসেন। এই সিনেমাটি ১৯৯৯ সালের তামিল সিনেমা 'সেঠু'র রিমেক। সিনেমায় সালমানকে কলেজপড়ুয়া এক উচ্ছৃঙ্খলের চরিত্রে (রাধে) দেখা যায়, যে তার এলাকার পণ্ডিতের মেয়ের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
২০০৯ সালের সিনেমা 'ওয়ান্টেড'-এও তার চরিত্রের নাম রাধে। এই সিনেমায় তিনি এমন একটি রহস্যজনক ঘাতকের চরিত্রে অভিনয় করেন যার কাজ নিজের পছন্দের নারীদের পিছু নেওয়া এবং পুলিশকে তটস্থ রাখা। পরবর্তীকালে তিনি 'দাবাং' (২০১০) ও 'বাজরাঙ্গি ভাইজান'-এর (২০১৫) মতো কিছু সিনেমায় সহজ-সরল, বন্ধুপ্রিয়, ভালো মনের মানুষ চরিত্রে অভিনয় করেন।
সালমানের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের ছবি 'ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া' (১৯৮৯) ও 'হাম আপকে হ্যায় কৌন'-এ (১৯৯৪) অভিনীত চঞ্চল তরুণ 'প্রেম'-এর চরিত্র তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তবে 'তেরে নাম' ও 'ওয়ান্টেড'-এর মতো সিনেমাগুলো তাকে নতুন এক দর্শক দলের সঙ্গে পরিচিত করায়, যারা ভারতের সাধারণ শ্রমিক সমাজ। এমন এক সমাজ যারা নিজেদেরই একটি অতিরঞ্জিত রূপ দেখতে চাইত পর্দায়। তার চরিত্রগুলো দিয়ে তিনি এসব খেটে খাওয়া পুরুষদের সান্নিধ্যে যেতে সফল হয়েছিলেন। 'দাবাং'-এ চুলবুল পান্ডে (রবিন হুড) নামক পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করা সালমান খানের জনপ্রিয়তা সেটিই প্রমাণ করে।
হিন্দি সিনেমার নায়কদের এই বৈচিত্র্যময়ী পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ আদতেই আকর্ষণীয়। দিলীপ কুমারের নায়কত্ব থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের নায়ক; অমিতাভের রাগী চরিত্র থেকে তিন খানের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত, এনআরআই ও শ্রমিক-শ্রেণির ধাঁচ, মূলত বলিউডের নানামুখী পরিবর্তনই ফুটিয়ে তোলে।
-
সূত্র: স্ক্রল ইন্ডিয়া