খুলনা ডায়েরি: দেরি হওয়ার জন্য আর মালিকের বকা খেতে হবে না

বাংলাদেশ

26 June, 2022, 07:55 pm
Last modified: 26 June, 2022, 10:27 pm
‘কয়েকদিন আগেও ঢাকা যেতে অন্তত ১১ ঘণ্টা সময় লাগত। কিন্তু এখন আর তা লাগছে না। আমি আসলে আনন্দ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

ছবি: মুমিতএম

কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন মোহাম্মাদ বাবুল শেখ (৪২)। আবেগের ঘোর তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমি একটা মাছের কার্গো ঢাকা নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন আগেও ঢাকা যেতে অন্তত ১১ ঘণ্টা সময় লাগত। কিন্তু এখন আর তা লাগছে না। আমি আসলে আনন্দ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।'

অনেকটা তার মতোই অনুভূতি প্রকাশ করলেন চৌধুরী পরিবহনের চালক আকাশ ইসলাম। তিনি বলেন, 'এই সেতুতে এটা আমার প্রথম ট্রিপ। এত সুন্দর একটা সেতু। আর ঢাকায় যেতে লাগবে মাত্র তিন ঘণ্টা, ভাবাও যায় না!'

আকাশ জানালেন, তার অনেক যাত্রী শুধু পদ্মা সেতু দেখতে এসেছেন।

স্বাধীন বাসের চালক মনির হোসেনও পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বলেন, 'দারুণ খুশি লাগছে। এত সুন্দর সেতুতে আমি আগে কখনো গাড়ি চালাইনি।'

''পদ্মা সেতু দেশের চেহারাই পাল্টাইয়া দিব'

ঢাকা থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে খুলনায় যাচ্ছিলেন চালক খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, 'আজকের মতো এমন আনন্দ আর কখনও পাইনি। মনে হয় গাড়ি চালানোর জীবনে এই প্রথমদিন সুখ পাইলাম। মনেই হয় নাই যে পদ্মা নদী পার হইলাম। এখন আর মালামাল আনা-নেওয়ার কোনো ঝামেলাই থাকল না।'

তিনি আরও বলেন, 'গ্যাস নিয়ে খুলনা-ঢাকা দীর্ঘ দিন ধরে যাতায়াত করি। প্রতিবারই ফেরিঘাটে বসে থাকতে হতো। কাচাঁমাল আর জরুরি গাড়ি পাড় হলে তারপর সুযোগ পেতাম। কোনো উৎসব এলে তো ৫ থেকে ৭ দিনও ঘাটে বসে থাকতে হতো। মালিকের বকা শুনতাম আর নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে খাওয়াদাওয়া করতাম। এখন মালিকও লাভবান হবে আমরাও লাভবান হবো। '

''পদ্মা সেতু দেশের চেহারাই পাল্টাইয়া দিব,' বলেন তিনি।

'টোলঘরে ২ ঘণ্টা নষ্ট না হলে চার ঘণ্টায় খুলনা চলে আসতাম'

খুলনার ট্রাক চালক রহমত মিঞা। গত পরশু খুলনা থেকে ট্রাকভর্তি পেঁয়াজ ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ (২৬ জুন) সকালে খুলনা ফেরার জন্য রওনা দেন। তারপর ৬ ঘণ্টায় পৌঁছে যান খুলনায়। অথচ আগে সময় লাগত ১২ ঘণ্টার মতো। যাতায়াতের সময় প্রায় অর্ধেক কমে যাওয়ায় উচ্ছ্বসিত রহমত।

মাঝে যানজটের কারণে সেতুর টোল ঘরে ঘণ্টা দুয়েক দেরি হয়েছে; তা না হলে চার ঘণ্টাতেই খুলনা পৌঁছে যেতে পারতেন বলে জানালেন তিনি।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে রহমত মিঞা বলেন, 'সকালে ৬ টায় ঢাকা থেকে রওনা দিই। প্রায় ২ ঘণ্টা পরে ৮ টার দিকে পদ্মা সেতুর টোল ঘরের কাছে আসি। সেখানে প্রচণ্ড যানজট ছিল। প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি। আমরা ২ ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করে টোল দিতে পেরেছি।'

তিনি বলেন, 'সেখান থেকে সেতু পার হতে সময় লেগেছে প্রায় ১৫ মিনিট। কারণ সেতুতে সবাই তুলনামূলক কম গতিতে বাস চালাচ্ছিল।' 

ঢাকা থেকে খুলনায় পৌঁছতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লেগেছে জানিয়ে রহমত বলেন, 'টোল ঘরের কাছে দেরি না হলে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টায় খুলনাতে চলে আসতে পারতাম।'

এই ট্রাকচালক আরও জানালেন, 'আগে আমাদের খুলনা থেকে মালামাল নিয়ে ঢাকাতে যেতে প্রায় ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগত। কারণ বেশিরভাগ পণ্য আমরা রাতে খুলনা থেকে ঢাকাতে নিয়ে যাই। রাতে আরিচা ঘাট পার হয়ে ঢাকায় যেতে হয়। মাওয়া ঘাটে রাতে ফেরি বন্ধ ছিল।'

আরিচা ঘাটে পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি থাকত বলে জানান রহমত। 'সেখানে ৩ থেকে ৮ ঘণ্টা দেরি করে সিরিয়াল পেতে হয়। যে কারনে ঢাকায় পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেত। এখন আর আরিচা হয়ে খুলনার কেউ পণ্য নিয়ে ঢাকায় যাবেন না,' বলেন তিনি।

রহমত আরও বলেন, 'গত পরশু দিনও পণ্য নিয়ে ঢাকায় যেতে প্রায় ১২ ঘণ্টা লেগেছে। আর পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ৬ ঘণ্টায় চলে আসলাম।'

ঢাকা ফেরত বাসযাত্রী আশিকুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, আজ সকাল ৭টায় তিনি সায়েদাবাদ থেকে খুলনার উদ্দেশে রওনা হন। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় যানযটে পড়ে দেড় ঘণ্টার সময় অপেক্ষা করতে হয় তাকে। খুলনায় পৌঁছেন দুপুর একটার দিকে। 

আশিকুল ইসলাম বলেন, 'পথে পদ্মা সেতু দিয়ে পার হয়ে এসেছি, এটা খুবই ভালো লেগেছে।'

ট্রাকচালক সৈয়দ আলী বলেন, 'আজ রাত ১১টার দিকে খুলনা থেকে পেঁয়াজ নিয়ে ঢাকায় রওনা হব। আশা করি ৪ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছাতে পারব। সেই সাথে রাতের পদ্মা সেতুটাও দেখা হয়ে যাবে।'

প্রসঙ্গত, রোববার (২৬ জুন) সকাল ৬টা থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় পদ্মা সেতু। তারপর থেকেই যানচলাচল শুরু হয়েছে সেতুতে। 

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সময় কমিয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতু। শরীয়তপুর, খুলনা থেকে গাড়িতে করে ঢাকায় এসে দিনে দিনেই আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তারা।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.