‘মনে অইছে আর বাঁচতাম নায়, খালি আল্লাহ আল্লাহ করছি’

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
19 June, 2022, 08:50 pm
Last modified: 20 June, 2022, 02:23 am
“দিন তবু কোনমতে কাটতো। কিন্তু রাত ছিলো ভয়ংকর। চারপাশ অন্ধকার। চারদিকে কেবল পানির শা শা শব্দ। একেকটা ঢেউয়ের চোটে মনে হয় আমাদেরও ভাসায়ে নিয়ে যাবে।”

বন্যায় সব নিয়া গেছে। ঘরে গরু ও মুরগী ছিলো, এগুলো ভাসায়ে নিছে। ঘরের আসবাবপত্রও ভাসে গেছে স্রোতের তোড়ে। কিছুই রক্ষা করতে পারিনাই। কেবল নিজেরা জীবন নিয়ে কোনমতে আসছি।

চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিলাজুর এলাকার বাসিন্দা এরশাদ মিয়া। 

সিলেটে চলমান বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। এই উপজেলার প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গিয়েছিলো পানিতে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এ উপজেলা। চারদিন ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ নেই। ফলে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন এই উপজেলার বাসিন্দারা। নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেকে।

রোববার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জ গিয়ে শোনা যায় মানুষের সব হারানোর হাহাকার ও আর্তনাদ।

বিলাজুর এলাকারই বাসিন্দা মদরিছ আলী বলেন, আমার ৫/৬ টা মুরগী ছিলো। পানি ভাসিয়ে নিছে। কিছুদিন আগেই ধান ঘরে তুলেছিলাম। সেগুলাও নিয়ে গেছে। ঘরের বেড়াও ভাসায়ে নিছে স্রোত।

তিনি বলেন, আমরা ঘরের চালের তীরে ধরে কোনরকমে বেঁচে গেছি। কিন্তু সব হারিয়ে এখন বাঁচবো কী করে।

তিনদিন পানিবন্দি অবস্থায় ছিলেন কোম্পানীগঞ্জের পাড়ুয়া গ্রামের আফিয়া বিবি। শনিবার সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।

সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে আফিয়া বলেন, মনে অইছে আর বাঁচতাম নায়। খালি আল্লাহ আল্লাহ করছি।

তিনি বলেন, দিন তবু কোনমতে কাটতো। কিন্তু রাত ছিলো ভয়ংকর। চারপাশ অন্ধকার। চারদিকে কেবল পানির শা শা শব্দ। একেকটা ঢেউয়ের চোটে মনে হয় আমাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি জানিয়ে আফিয়া বলেন, কিছুতেই তো নাই। সব পানি নিয়ে গেছে। কেবল আমরাই বেঁচে আসছি।

এই উপজেলার আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলেও এমন হাহাকার আর আর্তনাদই শোনা গেল। 

কেবল কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাই নয়, পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জের চিত্রই এখন এমন। এই দুজেলায়ই এখন হারানোর আর্তনাদ।

সিলেট সদর উপজেলার রায়েরগাওয়ের মনির মিয়া বলেন, এক কাপড়ে বাড়ির সদস্যদের নিয়ে বেড়িয়ে এসেছিলাম। আর বাড়িঘরের খবর জানি না। কিছু আছে কিনা তাও জানি না।

সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের হিসেবেই সিলেট ও সুনাম্পগঞ্জে পানিবন্দি হয়ে আছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। অব্যাহত বৃষ্টি ও ঢলে তলিয়ে গেছে এই দুই জেলার প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা।

শেষ খবর অনুযায়ী, স্টেশন থেকে পানি নেমে যাওয়ায় রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে। 

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, বন্যার পাশাপাশি বিদ্যুৎহীনতা ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এতে উদ্ধার কার্যক্রমও ব্যহত হচ্ছে। 

তবে প্রশাসন বানভাসী মানুষের সহায়তায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ  মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে।

শুক্রবার থেকে সিলেটে এবং শনিবার থেকে সুনামগঞ্জে বানভাসী মানুষদের উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী। শনিবার থেকে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে নৌবাহিনীও।

সেনাবাহিনীর এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল হামিদুল হক জানান, সেনাবাহিনীর ১৭টি ব্যাটেলিয়ান বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। 

"একটি প্যারা কমান্ড দলও এই কাজে যুক্ত হয়েছে", বলেন তিনি। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে কিছুটা কমেছে। তবে বেড়েছে কানাইঘাটে। অন্য নদীগুলোর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত আছে।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.