৭৩ প্রকল্পে মতামত প্রদানের জন্য ৫ কোটি টাকা নিচ্ছেন আইএমইডি কর্মকর্তারা

বাংলাদেশ

11 June, 2022, 12:05 am
Last modified: 12 June, 2022, 11:41 am
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কর্মকর্তাদের মূল কাজ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। কিন্তু জনবল সংকটের নামে তারা নিজেদের কাজ আউটসোর্সিং করছেন। উপরন্তু তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন করা প্রকল্পগুলোর উপর আয়োজিত ভার্চুয়াল ওয়ার্কশপে 'বিশেষজ্ঞ' মতামত দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ পাচ্ছেন।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কর্মকর্তাদের মূল কাজ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। কিন্তু জনবল সংকটের নামে তারা নিজেদের কাজ আউটসোর্সিং করছেন। উপরন্তু তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন করা প্রকল্পগুলোর উপর আয়োজিত ভার্চুয়াল ওয়ার্কশপে 'বিশেষজ্ঞ' মতামত দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ পাচ্ছেন।

চলমান অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকার অগুরুত্বপূর্ণ ব্যয় কমানোর নির্দেশ দিলেও তা মানছে না আইএমইডি। উল্টো আইএমডির সচিব তার 'বিশেষজ্ঞ' মতামত প্রদানের জন্য প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকার বেশি সম্মানী পাচ্ছেন।

অথচ তারপরও তারা মনে করছেন, অফিস টাইমে দেওয়া 'মূল্যবান' মতামতের জন্যও যতটুকু প্রাপ্য, কর্মকর্তারা তার চেয়ে কম সম্মানী পাচ্ছেন।

আউটসোর্স করা প্রকল্পগুলোর জন্য আইএমইডির একটি বাজেট পরীক্ষা করে দেখা যায়, একজন সচিব থেকে শুরু করে তাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ—যাদের এ ধরনের মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার অধিকার নেই—অন্তত ১১৮ জন কর্মকর্তা একদিনে ছয়টি করে ১২ দিনে ৭৩টি অনলাইন কর্মশালায় ৭৩টি আউটসোর্স প্রকল্পের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন তারা।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—কর্মকর্তাদের অধিকাংশই মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকলেও সম্মানী ঠিকই পান। প্রকল্প মূল্যায়নের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা প্রতিটি সভায় অংশ নেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আউটসোর্সিংয়ের বিভিন্ন সভায় কর্মকর্তারা মেধা ব্যয় করছেন। তাই এ সম্মানী যৌক্তিক। বরং যে মেধা ব্যয় হচ্ছে, তার চেয়ে কম সম্মানী পাচ্ছেন কর্মকর্তারা।'

বিশ্ব ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সভার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বৈঠকে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সম্মানী দেওয়া হয়।'

তবে আইএমইডির একজন সাবেক সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, এটি আসলে কর্মকর্তাদের পকেট ভারী করার একটা পথ। 'আউটসোর্সিং প্রকল্প মূল্যায়ন এক ধরনের ব্যবসা। আমি এটি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু ভেতর থেকে বাধা আসায় ব্যর্থ হয়েছি।'

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম অনলাইন মিটিংয়ে এমন মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত ২২ মে আইএমইডি তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন করা ৭৩টি প্রকল্পের উপর বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়ার জন্য অনলাইন কর্মশালা শুরু করে। পাঁচ দিনে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি বৈঠক হয়েছে। ১২ জুন ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ শেষ করে আইএমইডি সচিব ফিরে আসার পর অবশিষ্ট বৈঠকগুলো শুরু হবে।

চলতি অর্থবছরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্প মূল্যায়নে ২৩.২০ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। এই বরাদ্দের এক-চতুর্থাংশ, বা ৫ কোটি টাকার বেশি চলে যাচ্ছে কর্মকর্তাদের পকেটে। 

চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে বারবার অপ্রয়োজনীয় বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু তার আহ্বানে কর্ণপাতই করছে না আইএমইডি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, আইএমইডির কর্মশালা বা সভায় অংশ নিয়ে ভাতা আদায়ের ঘটনা দেশে নতুন নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্মানী ও অন্যান্য ভাতা আদায়ের ঘটনা প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনিক এই সংস্কৃতি দীর্ঘ সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সরকারি সংস্থায় এই সংস্কৃতি বিরাজ করছে। 

তিনি আরও বলেন, যেকোনো ধরনের প্রশিক্ষণ বা সভা থেকে তারা অবাস্তব হারে ভাতা নেন। কর্মশালা এবং মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা কর্মকর্তাদের মূল দায়িত্বের অংশ, কিন্তু তারা নিজেদের কাজ করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ নিচ্ছেন। এটি বন্ধ করা উচিত, বিশেষ করে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আহ্বান জানাব তারা যেন এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়।'

কে কত টাকা পান

আইএমইডির ১৯ মে-র আউটসোর্সিং বাজেটের নথি থেকে জানা যায়, আইএমইডিরি কর্মকর্তারা অনলাইন প্রতি কর্মশালায় সম্মানী হিসাবে সাড়ে ৫ লাখ টাকা পান। টাকার বরাদ্দ এরকম—আইএমইডি সচিব সাধারণত প্রতি কর্মশালায় ৮,০০০ টাকা, অতিরিক্ত সচিব ৬,০০০-৮,০০০ টাকা, মহাপরিচালক ৬,০০০ টাকা, পরিচালক ৫,০০০ টাকা, উপপরিচালক ৪,০০০ টাকা পান এবং দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ৩,৪০০ টাকা পান।

কর্মশালায় অংশ নেওয়া  প্রত্যেক কর্মকর্তা নগদ ১,৮০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন ব্যাগ, ফোল্ডার ও কলম কেনা বাবদ। এছাড়া ৫০০ টাকা করে খাবার বিল পাচ্ছেন। প্রতিদিন ৬টি কর্মশালা হচ্ছে। 

আউটসোর্সড প্রকল্পের জন্য একটি স্টিয়ারিং কমিটি আছে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য স্টিয়ারিং কমিটির দুটি করে, অর্থাৎ মোট ১৪৬টি সভা হয়। সভায় অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের সম্মানী ২,০০০ টাকা করে। ৭৩টি প্রকল্পের জন্য স্টিয়ারিং কমিটি সভাপতি হিসেবে সচিবের আয় ২ লাখ ৯২ হাজার টাকা।

৭৩ প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ ও প্রভাব মূল্যায়নের কার্যক্রম থেকে সর্বোচ্চ ৯ লাখ টাকার বেশি সম্মানী পাচ্ছেন আইএমইডি সচিব—ছয়টি প্রকল্প নির্বাচন সভা থেকে ১২,০০০ টাকা, ১৪৬টি স্টিয়ারিং কমিটির সভা এবং ৭৩টি অনলাইন কর্মশালা থেকে ৬ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা।

একইভাবে একজন অতিরিক্ত সচিব ৮ লাখ টার বেশি, মহাপরিচালক ৭ লাখ টাকার বেশি, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা সাড়ে ৬ লাখ টাকার বেশি এবং দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত পান।

চলতি বছরের আউটসোর্সিং বাজেট সংশোধন করে সভাপতির সম্মানী ১ হাজার টাকা বাড়ায় আইএমইডি।

এসব কর্মশালা কি প্রয়োজনীয়?

আইএমডির কর্মকর্তাদের কাজই হলো সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে মতামত দেওয়া। কিন্তু অফিস চলাকালীন সময়ে কাজ করেই বড় অঙ্কের সম্মানী নিচ্ছেন।

তাদের অনলাইন কর্মশালা হচ্ছে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে। এতে তাদের অফিস টাইমের বাইরে গিয়ে সময় দিতে হচ্ছে না। তাছাড়া অধিকাংশ আইএমডি কর্মকর্তাই এসব অনলাইন সভায় অংশ নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম না প্রকাশের করার শর্তে আইএমইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, এই ধরনের কর্মশালা প্রকল্প মূল্যায়নে কোনো কাজে আসে না। কারণ বেশিরভাগ কর্মকর্তাই কেবল একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে অনলাইন কর্মশালায় যোগ দিয়ে তারপর অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, 'কোনো কারিগরি বিশেষজ্ঞ উপস্থিত থাকেন না; তাই এই ধরনের কর্মশালার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি না। মিটিংয়ে যারা অংশ নেন তাদের বেশিরভাগেরই মতামত দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই।'

এর আগে ২০২০ সালের কোভিডের লকডাউনের সময় অনলাইন কর্মশালা থেকেও একইভাবে ভাতা হিসেবে সরকারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেন আইএমইডির কর্মকর্তারা। 

ওই সময় টিবিএসে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিভিন্ন মহল সমালোচনার মুখে পড়ে আইএমইডি।

সমালোচনার মুখে আইএমইডি ২০২১ সালে বেসরকারি ফার্মের মাধ্যমে প্রকল্প মূল্যায়নের সংখ্যা ৭২ থেকে ৩২-এ নামিয়ে আনে। কিন্ত চলতি অর্থবছরে এই সংখ্যা আবারও বাড়ানো হয়েছে।

প্রকল্প মূল্যায়নের সঙ্গে যোগসূত্র নেই, এমন অনেকেই কর্মশালায় অংশ নেন

আইএমইডি সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব এবং মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ হিসেবে মতামত দিচ্ছেন। এতে তারাও সম্মানী ও কর্মশালার উপকরণ বাবদ সম্মানী পাচ্ছেন। যদিও প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রযুক্তিগত বিষয়ে দক্ষতার প্রয়োজন হয় এমন কর্মশালায় যোগদানের এখতিয়ার তাদের নেই।  

তাদের সম্মানী জনপ্রতি প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

অনলাইন কর্মশালায় ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের যৌক্তিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, 'সচিব হিসেবে সবকিছু দেখার দায়িত্ব আমার না। তবে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের সম্মানী নেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখব।'

আউটসোর্সিং করে প্রকল্প মূল্যায়নে সুফল আসে?

উন্নয়ন প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে আইএমইডির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে। এ বিভাগের কর্মকর্তাদের মূল কাজই হলো সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে তদারকি করা। ২০১০ সালে আইএমইডি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বেসরকারি ফার্ম নিয়োগ দিয়ে আলাদাভাবে মূল্যায়ন শুরু করে। 

কিন্তু প্রকল্প মূল্যায়নের জন্য তারা যে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ করে, তাদের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইএমইডি কর্মকর্তা বলেন, আইএমইডির নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট সক্ষমতা নেই। এ কারণেই আইএমইডির অনেক কর্মকর্তা নিজেই মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করতে সাহায্য করেন।

কাজেই প্রকল্প মূল্যায়নের আউটসোর্সিং কোনো সুফল বয়ে আনে না-ই, উল্টো জনগণের অর্থ গচ্চা যায়।

একজন প্রাক্তন সচিব পরামর্শ দিয়েছেন, আইএমইডি যেন তাদের নিজস্ব জনবল বাড়িয়ে ধীরে ধীরে প্রকল্প মূল্যায়নের এই পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.