৭০ ঘণ্টায়ও কেন নেভেনি সীতাকুণ্ডের আগুন?

বাংলাদেশ

08 June, 2022, 10:40 am
Last modified: 08 June, 2022, 11:50 am
ফায়ার সার্ভিস বলছে, সব ধরনের আগুন নেভানোর সক্ষমতা রয়েছে তাদের। কিন্তু ডিপোতে কেমিক্যাল মজুতের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য না পাওয়ায় এই হতাহত ও অগ্নিনির্বাপনে বিলম্বের ঘটনা ঘটেছে।

দীর্ঘ ৭০ ঘণ্টা পরও (মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত) পুরোপুরি নেভেনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ডিপোটিকে ঝুঁকিমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। তবে ঘটনার তিন দিনেও আগুন নির্বাপন না হওয়ায় দেশের ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, সব ধরণের আগুন নেভানোর সক্ষমতা রয়েছে তাদের। কিন্তু ডিপোতে কেমিক্যাল মজুতের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য না পাওয়ায় এই হতাহত ও অগ্নিনির্বাপনে বিলম্বের ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ফেনীর উপ-পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দী। আগুন নির্বাপনের নেতৃত্বে দেয়া এই কর্মকর্তা  বলেন, 'সব ধরণের অগ্নিনির্বাপনে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কেমিক্যাল মজুত থাকার বিষয়ে তথ্য না জানানোর কারণে অগ্নি নির্বাপনে নিয়োজিত এত বেশি ফায়ার কর্মীর একসঙ্গে মৃত্যু ও আহত হয়েছে। একই সঙ্গে এত মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বিস্ফোরণের পরও কর্তৃপক্ষ ডিপোতে মজুত পণ্যের বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য দেয় নি। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে।'

এর আগে শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ৪৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার ও দেড় শতাধিক আহতের ঘটনা ঘটে।  নিখোঁজ থাকা ২০ জনের সন্ধানে ডিএনএ টেস্টেও নমুনা দিয়েছে তাদের পাঁচ স্বজন। এর মধ্যে এখনো ফায়ার সার্ভিসের ৩ কর্মী নিখোজ রয়েছে। কয়েকশ মানুষ দগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ৪৩ জনের মধ্যে ২৫ জনের নাম-পরিচয় মিলেছে।

কনটেইনারে রাসায়নিক পদার্থ থাকায় ডিপোর ভেতরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সেনাবাহিনী। আগুন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আশঙ্কা, ফের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই খুবই সতর্কতা ও সুপরিকল্পিতভাবে আগুন নেভানোর কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের।

আরো দুই মৃতদেহ উদ্ধার

বিএম কন্টেইনার ডিপো থেকে আরো দুই মৃতদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকাণ্ডের তৃতীয় দিন মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ডিপোর মধ্যে থেকে এই মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এই নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৩ জনে। তবে ফায়ার সার্ভিস বলেছে, তারা এই পর্যন্ত ৪৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান বলেন, একজনের মৃতদেহের পাশ থেকে ফায়ার সার্ভিসের পোশাক ও অপরজনের পাশ থেকে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাকের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। এতে ধারণা করা হয়েছে, উদ্ধার করা দুইজনের মধ্যে একজন ফায়ার সার্ভিস কর্মী ও অপরজন ডিপোর সিকিউরিটি গার্ড। তবে মৃতদেহ দুইটি পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় ডিএনএ টেস্ট ছাড়া পরিচয় নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

এর আগে সকালে ডিপো থেকে মানুষের হাত, পা ও নাভিসহ বিভিন্ন দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছে, দেহাবশেষগুলো ডিপোর যে স্থান থেকে উদ্ধারকরা হয়েছে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম টিমটি আগুন নিভানোর কাজে নিয়োজিত ছিলো। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, দেহাবশেষগুলো নিখোঁজ ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের হতে পারে।

২৭ কন্টেইনার কেমিক্যাল ছিল ডিপোতে

মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ডিপোতে কম-বেশি ২৭ কন্টেইনার কেমিক্যাল ছিল। এরমধ্যে ১৫ কন্টেইনার ধ্বংস হয়ে গেছে। বাকিগুলো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখা হয়েছে, যেখানে বিস্ফোরণ হলেও আমাদের ক্ষতি হবে না। নিরাপদ দূরত্ব বলতে- কম্পাউন্ডের ভেতরেই আছে। যেহেতু কনটেইনারগুলো আগে গরম হয়ে আগুন লেগেছে এখনও গরম হয়ে লাগতে পারে, তাই ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না।

আহতদের সবার শরীরেই কেমিক্যাল ইনজুরি, সঙ্কটাপন্ন ৮

কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহতদের সবার শরীরেই কেমিক্যাল ইনজুরি আছে। এদের মধ্যে আটজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ও  পাঁচ জনের চোখের কর্ণিয়া মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম টিবিএসকে বলেছেন, 'সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধরা অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডে আহতদের মতো নন। আহতদের শরীরে বার্ন ও কেমিক্যাল ইনজুরি আছে। এর সঙ্গে স্মোক ইনহেলেশন (ধোঁয়ায় শ্বাসতন্ত্র দগ্ধ) হয়েছে।'

'এই তিনটার সমন্বয়ে তারা যতটুকু দগ্ধ হয়েছে তারচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কেউ হয়তো ১০ শতাংশ পুড়েছেন কিন্তু অসুস্থ হয়েছেন ৪০ শতাংশের মতো। ঢাকায় চিকিৎসাধীনদের মধ্যে আইসিইউতে আছেন ৩ জন; এদের মধ্যে একজন আছেন লাইফ সাপোর্টে। বাকিরা পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে আছেন। কিন্তু এদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন।'

ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল বলেন, ‌'চমেকে চিকিৎসাধীন ৬৩ জন রোগী আমি দেখেছি। তারা কোনো না কোনোভাবে চোখে কেমিক্যালের ধোঁয়া ও আগুনের তাপে আঘাত পেয়েছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার লিটন কুমার পালিত বলেন, 'চিকিৎসাধীন ৬৩ জন রোগীর মধ্যে তিনজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তাদের শ্বাসনালীসহ শরীরের ৭০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। তারা ইনফেকশনে আক্রান্ত বলে ধারণা করছি। এছাড়া শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ১৪ জনের।'

বেসরকারি পার্ক ভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, 'বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে ১১ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে দুইজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন, তারা চোখের কর্ণিয়ায় আঘাত পেয়েছে। একজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তার বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা খুব কম।'

এখনো মামলা হয় নি

কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনার তিন দিন পার হলেও মামলা হয়নি। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান।

তবে তিনি বলেন, 'সরকারিভাবে ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির কাছ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই আমরা আইনি প্রক্রিয়া শুরু করবো।'

কর্মীশূন্য দুই ফায়ার স্টেশন

ডিপোতে আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণে হতাহত হয়ে কর্মীশূন্য হয়ে পড়ে সীতাকুণ্ডের দুটি ফায়ার স্টেশন। বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত সীতাকুণ্ড ও কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন ফায়ার ফাইটারের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে ৩ জন। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৫ জন। এরমধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। 
 

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.