বিএম ডিপোর আগুনের ঘটনা থেকে সতর্ক হওয়ার সময় এখনই

বাংলাদেশ

08 June, 2022, 10:25 am
Last modified: 08 June, 2022, 12:13 pm
২৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে এস এম পাউডারভর্তি ২০ ফুট সাইজের ২৫৯টি কনটেইনার। বিপজ্জনক এই পদার্থ থেকে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের বিস্ফোরণ।

চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর আসা এস এম পাউডার ভর্তি কন্টেইনারটি পড়ে আছে এনসিটি (নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল) এর কাছে। ২৭ বছর ধরে পড়ে থাকা পাউডার হিসবে দাহ্য পণ্য চালানটি নষ্ট হয়ে গেলেও এখনো নিলামে বিক্রি বা ধ্বংস করতে পারেনি চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ।

নিয়ম অনুসারে পণ্য চালান বন্দরে আসার ৩০ দিনের মধ্যে আমদানিকারক ডেলিভারি না নিলে সেটি নিলাম কিংবা ধ্বংস করার বিধান রয়েছে। কিন্তু কাস্টম কর্তৃপক্ষ এসব পণ্য বিক্রি বা ধ্বংস না করার কারণে গত ২৭ বছরে বিপজ্জনক বা যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে এ ধরনের ২০ ফুট সাইজের ২৫৯টি বিপজ্জনক কন্টেইনার জমে আছে বন্দরের ইয়ার্ড ও শেডে।

এসব পণ্যের মধ্যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, সালফেট, সালফিউরিক এসিড, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, থিনার, সোডিয়াম সালফেট, মিথানল, ইথাইল হেক্সানল, নাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম অক্সাইডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ডিজি পণ্য দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পণ্যগুলো নিলামে বিক্রি কিংবা ধ্বংস করতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বারবার চিঠি দিলেও সাড়া মিলতো না কাস্টমস থেকে। পণ্য নিয়ে আমদানিকারকের দায়ের করা মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া, ধ্বংস প্রক্রিয়ায় অর্থের সংকট, জলবল সংকটসহ নানা অজুহতে কাস্টম কর্তৃপক্ষ নিলাম দিয়েও পণ্য বিক্রি না করার নজির রয়েছে। কাস্টমসের এমন কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রাম বন্দর অগ্নিকাণ্ডসহ বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

চট্টগ্রাম হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী দ্য বিজনেস স্ট্যন্ডার্ডকে বলেন, "দীর্ঘদিন ক্যামিকেলসহ বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণ করা হলে সেগুলো পরিবেশ, প্রতিবেশ, পানি, বাতাস সর্বোপরী মানুষের জীবনবিনাশী হয়ে উঠে। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোনো অবস্থাতেই এসব বিপজ্জনক পণ্য দীর্ঘদিন মজুদ করে রাখা ঠিক হয়নি।"

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব পণ্য সরাতে কাস্টম কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিলেও কাস্টম বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে এসব পণ্যের নিষ্পত্তি করেনি। বন্দরের ইয়ার্ড ও শেডে বিপজ্জনক পণ্য পড়ে থাকায় বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একইসাথে বন্দরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এগুলো। এরইমধ্যে গত বছরের ১১ নভেম্বর বন্দরের পি শেডে পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্যের মধ্যে একটি অগ্নিকাণ্ডও সংঘটিত হয়।

চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বিপজ্জনক পণ্য ও পণ্যবাহী কন্টেইনার অপসারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছিলেন। 

ছবি- মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/ টিবিএস

ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নিলামের জন্য পণ্য শুল্ক বিভাগকে হস্তান্তর করা হলেও বাস্তবে নিলামযোগ্য পণ্য বন্দর অভ্যন্তরে থেকে যায়। এতে বন্দরে পণ্যজট সৃষ্টি হয় এবং স্বাভাবিক অপারেশন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। 

বিপজ্জনক পণ্য এবং কন্টেইনারসমূহ একদিকে যেমন বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনি বন্দরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। 

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানিয়েছে, লেবাননের বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনার পর বিপজ্জনক পণ্য সরাতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়। ওই ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের পি শেডে থাকা প্রায় ৫৯ মেট্রিক টন পণ্য সুনামগঞ্জের লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের কারখানায় স্থানান্তর ধ্বংস করা হয়েছে।  

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় ৫ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টস হাউসের পুরোনো অকশন শেড। যেখানে ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরোনো পণ্য রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ১৪৬ টি বিভিন্ন প্রকারের গাড়ি, মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ, প্রসাধনী, ক্যামিকেল কাপড়- কম্বলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। 

বন্দরের ইয়ার্ড থেকে পুরাতন অকশন শেড সরিয়ে নিতে বন্দর স্টেডিয়ামের বিপরীতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন অকশন শেড নির্মাণ করে দিয়েছিলো বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর সেটি উদ্বোধন হলেও পুরোনো অকশন শেড থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্য সরায়নি কাস্টমস কতৃপক্ষ। 

উল্টো পরিত্যক্ত ভবনে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত ১ শতাধিক আনসার সদস্য বসবাস করতো। যদিও এক বছর আগে আনসার সদস্যদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, পুরোনো অকশন শেড সরানো হলে সেখানে প্রায় ১০ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার রাখার জায়গা তৈরি হবে। বছরে ১ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডেল হলে বছরে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা আয় হবে বন্দরের। অকশন শেড না সরানোর কারণে বন্দর কতৃপক্ষ নিরাপত্তা ঝুঁকির পাশাপাশি প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি হয়েছে। 

২০২১ সালের ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম সরেজমিন পুরোনো অকশন শেড পরিদর্শন করেন। ওই পরিদর্শনের সময় বন্দর চেয়ারম্যানকে দুই মাসের মধ্যে পুরেনো অকশন শেড সরানোর কথা জানিয়েছিলেন কাস্টম কমিশনার। পরিদর্শনের ১ বছর ৩ মাস পার হয়ে গেলেও পুরোনা অকশন শেড এখনো সরায়নি কাস্টম কর্তৃপক্ষ। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, "বন্দর থেকে বিপজ্জনক পণ্য সরাতে আমরা বহুবার কাস্টমকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সাড়া মেলেনি। আমি আজও (বুধবার) বিষয়টি নিয়ে কাস্টম কমিশনারকে এ বিষয়ে অবহিত করেছি। যত দ্রুত বন্দর থেকে এসব পণ্য সরানো যায় বন্দরের নিরাপত্তার জন্য ততই মঙ্গল।"

বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর এবার তৎপর কাস্টমস ও বন্দর

ছবি- মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/ টিবিএস

সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তৎপর হয়েছে প্রতিষ্ঠানদুটি। শনিবার দুর্ঘটনার পরই তড়িঘড়ি করে গত ৬ জুন ৩০ মেট্রিকটন হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান স্পট নিলামে তুলে বিক্রি করে। 

এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন প্রতিষ্ঠানদুটি বিপজ্জনক পণ্যের নিলাম এবং ধ্বংস কার্যক্রম পরিচালনা করতে এবার একযোগে কাজ শুরু করেছে বলে টিবিএসকে জানিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। 

বুধবার সকাল থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা পণ্যের ইনভেন্ট্রির কাজ শুরু করেছেন। দ্রুত হ্যাজাডার্স পণ্য সরিয়ে বন্দরকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠান দুটি। 

বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার ডেপুটি কমিশনার আলী রেজা হায়দার টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমসের টিম বন্দরে ক্যামিকেলসহ ঝুকিপূর্ণ পণ্যের ইনভেন্ট্রি করেছে। দ্রুত যাতে এসব পণ্যের নিলাম এবং ধ্বংস কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায় সেটি নিয়ে আমরা তৎপর রয়েছি। 

বন্দর কাস্টমসের হঠাৎ এমন তৎপরতায় বন্দর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, লেবাননের বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দরের এই ইস্যু নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তবে এবার যাতে নিলাম ও ধ্বংস প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা যায় সেটি প্রতিষ্ঠান দুটিকে নিশ্চিত করতে হবে। 

বিপজ্জনক পণ্য না সরানোর জন্য কাস্টমসের নিরব ভূমিকাকেই দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। 

সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে হাইড্রেজেন পার অক্সাইড থেকে বিস্ফোরণের ঘটনার পরই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এই পণ্য সরাতে ৫ জুন কাস্টমসকে চিঠি দেয় বন্দর। চিঠি প্রাপ্তির পরদিনই ৬ জুন স্পট নিলাম ডেকে ৪ বছর ধরে বন্দরে পড়ে থাকা ৩০ মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান নিলামে তোলে কাস্টমস।  

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা কেমিক্যাল পণ্য সরাতে সময় লাগছে। কম জনবল দিয়ে এরপরও আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় বন্দরে থাকা রাসায়নিক পণ্য সরাতে কর্মকর্তারা কাজ করছে। 

তিনি আরো বলেন, আমদানি হওয়া পণ্য চালান দ্রুত খালাস নিতে বুধবার (৭ জুন) একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। পণ্য আমদানির ৩০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি না নিলে ওই পণ্যচালান নিলামে তোলা হবে। 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.