ধান রক্ষার বাঁধের কারণে হাওরের অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে

বাংলাদেশ

25 May, 2022, 02:00 pm
Last modified: 25 May, 2022, 03:00 pm
কেবল বাঁধ নয়, হাওরে ধানের জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, বিল সেচে  মৎস্য নিধন ও নির্বিচারে পোনা মাছ ধরার কারণেও হাওরের মাছ কমে আসছে। 

ধান বাঁচাতে সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে প্রতিবছর নির্মাণ করা ফসল রক্ষা বাঁধের কারণে হাওরে মাছের চলাচল ব্যাহত হয়, প্রজনন কমে গিয়ে বিলুপ্তির পথে অনেক প্রজাতি। 

কেবল বাঁধ নয়, হাওরে ধানের জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, বিল সেচে  মৎস্য নিধন ও নির্বিচারে পোনা মাছ ধরার কারণেও হাওরের মাছ কমে আসছে। 

চলতি মৌসুমেও সুনামগঞ্জে ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

যত্রতত্র এই বাঁধ নির্মাণকেই হাওরের মাছ কমে যাওয়ার বড় কারণ বলে মনে করেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মুত্যুঞ্জয় কুন্ড। 

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচল খুবই জরুরী। তারা সবসময় চলাচলের মধ্যে থাকে। এটি বাধাগ্রস্ত হলে মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। হাওর এটাই হচ্ছে।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাওর তীরবর্তী বাজারগুলোতে পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, পাবদা, কৈয়ের মতো খামারের মাছের ছড়াছড়ি, হাওরের মাছ নেই। বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে খামারে চাষ করা পাঙ্গাস মাছ।

প্রতিবছর মার্চের দিকে ঢল আর ভারি বৃষ্টিতে হাওর এলাকায় অকাল বন্যা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় ফসল। ঢলের পানি যাতে হাওরে প্রবেশ করে ধানের ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ।

তাহিরপুরের মৎস্য কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন বলেন, "ফসল রক্ষায় নির্মাণ করা এই বাঁধের কারণে মাছের প্রজনিন ব্যহত হচ্ছে। বাঁধের কারণে মাছ নদী থেকে হাওর বা বিলে যেতে পারছে না, পানিতে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারছে না। একারণে হাওরে মাছের সংখ্যা কমে এসেছে"।

"এছাড়া ব্যাপক আকারে কীটনাশক ব্যবহার, হাওরের ইজারা প্রথা, সেচ দিয়ে মাছ শিকারসহ বিভিন্ন কারণে হাওরের মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। কীটনাশকের কারণে মাছ ডিম কম দিচ্ছে। সব ডিম থেকে বাচ্চাও ফুটছে না। অনেক সময় হাওরে মাছ মরে ভেসে উঠতেও দেখা যায়।" 

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিস বায়োলজি ও জেনেটিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায় মনে করেন, ধান ও মাছ দুটোর ব্যাপারেই মনোযোগী হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, যে জায়গায় ধান হয় সেখানে ধান চাষ করতে হবে। আর যে জায়গায় ধান হয় না, অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সেখানে ধান চাষ না করে মাছ চাষে মনোযোগী হতে হবে।

"এইসব বাঁধের মাটি কোথায় যাচ্ছে, বৃষ্টির সাথে এগুলো হাওর ও বিলে যাচ্ছে। প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মাটি জমছে হাওরে। ফলে বিলে পানি বেশি সময় থাকছে না। অদূর ভবিষ্যতে তো বিলগুলোই থাকবে না, সব সমতল ভূমি হয়ে যাবে। ফলে ধান ও মাছ দুটোরই ক্ষতি হবে।" 

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত অর্থ বছরে ৯০ হাজার ১৩০.২৫ মেট্রিক টন মাছ পাওয়া গেছে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন জলাশয় থেকে। এর মধ্যে নদী থেকে ৪ হাজার ৫৪৪.৪৫ মেট্রিক টন, বিল থেকে প্রাকৃতিকভাবে ২৮,৬২৪.৩৯ মেট্রিক টন, বিলে পোনা অবমুক্তের মাধ্যমে ৬০.৯০ মেট্রিক টন, হাওর থেকে ৩৪ হাজার ১৩৪.০৭ মেট্রিক টন এবং প্লাবনভ'মি থেক ২৭১৫.২৫ মেট্রিক টন।

বিলুপ্ত অনেক প্রজাতি

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মান, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ও অবাধ মৎস্য নিধনের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। 

সিলেট মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের হাওরগুলো এক যুগ আগেও প্রায় ১০৭ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতে। এরমধ্যে গত কয়েক বছরে বেশকিছু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। আরো কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেটের হাওরগুলোর ১০৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৩২ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।  

বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে মহাবিপন্ন, সঙ্কটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি। 

এরমধ্যে মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রাণী, পাঙ্গাস, বামোশ, নাফতানি, চিতল, একথুটি ও চাকা।

সঙ্কটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়।

এবং বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালিবাউশ।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.