দীর্ঘায়িত হচ্ছে সিলেটের বন্যা, বাড়ছে দুর্ভোগ

বাংলাদেশ

দেবাশীষ দেবু, সিলেট
19 May, 2022, 07:55 pm
Last modified: 19 May, 2022, 07:59 pm
সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৭৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ৩৪ বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকেছে বিভিন্ন এলাকায়।

বৃহস্পতিবার সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বেড়েছে নদীর পানি। বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। আর জেলার ১০৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭০টিই প্লাবিত হয়ে গেছে।

গত ১১ মে থেকে ঢল আর অতিবৃষ্টিতে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ায় বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ। দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার পানির সঙ্কট। এছাড়া স্যানিটেশন সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। জেলার বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎহীনতা এই দুর্ভোগকে আরও তীব্র করেছে।

এদিকে বাড়ছে পানিবাহিত রোগবালাইও। বন্যার্তদের সহায়তায় জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলেও তা যথেষ্ট নয় বলে দাবি করেছেন আক্রান্তরা।

নগরের চালবিন্দর এলাকার বাসিন্দা কুন্তি দাস বলেন, 'চারদিন ধরে ঘরের ভেতরে পানি। কিন্তু খাবার পানি নেই। এছাড়া বাসার টয়লেটও পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক দূরের একটি কারখানার টিউবওয়েল ও টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে।'

নগরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা শিহাব আহমদ বলেন, 'পাঁচদিন ধরে বাসায় পানি। পানির কারণে ঘর থেকেও বের হওয়ার উপায় নেই। চারদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। খাবার পানি নেই। টয়লেটের ব্যবস্থাও নেই। সবমিলিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটছে আমাদের। বাসার নারী ও শিশুরা সবচেয়ে সঙ্কটে আছে।'

সিলেট নগরে পানি সরবরাহ করে সিলেট সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল আলিম শাহ বলেন, জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করা প্লাবিত এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ সরবরাহ পাইপে কোনো ছিদ্র থাকলে তাতে বন্যার পানি মিশে রোগবালাই দেখা দিতে পারে। এ কারণে বুধবার থেকে এসব এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।

তবে এসব এলাকায় ভ্রাম্যমান গাড়ির মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আলিম। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সামান্য বলে জানিয়েছেন নাগরিকরা।

রোগবালাই ঠেকাতে সিটি করপোরেশন পানি বন্ধ রাখলেও ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় সর্বমোট ৯৪ জন পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ডায়রিয়া ও চর্মরোগে আক্রান্ত।

ঘরের মধ্যে নোংরা পানিতে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন জানিয়ে নগরের সোবহানীঘাট এলাকার বাসিন্দা উত্তরা সেন পম্পা বলেন, 'পানির সাথে ড্রেনের ময়লা আবর্জনাও ঘরে প্রবেশ করছে। এতে পায়ে ঘা হয়ে গেছে। আজ বাধ্য হয়ে বাচ্চাকে নিয়ে আরেকটি পরিবারে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এখানেও খাবার পানি নেই।'

নগরের চেয়ে সঙ্কট আর দুর্ভোগ আরও বেশি গ্রামাঞ্চলে। বন্যায় প্লাবিত হয়ে পড়েছে সিলেটের বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদ। 

সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী ইউনিয়নের সুপ্রাকান্দি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বন্যায় এলাকার বেশিরভাগ টিউবওয়েল ডুবে গেছে। ফলে খাবার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। দূর-দূরান্ত থেকে পানি নিয়ে আসতে হচ্ছে। ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় রান্নাবান্নাও করা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, 'ঘরে অনেকগুলো গরু রয়েছে। নিজেরা তবু কোনোরকমে খেতে পারছি। কিন্তু মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় গোখাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।'

এদিকে সিলেটে বৃহস্পতিবারও অব্যাহত রয়েছে পানি বৃদ্ধি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৭৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ৩৪ বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকেছে বিভিন্ন এলাকায়।

পানি উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলা কমপ্লেক্সে। এসব উপজেলার অনেক বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রেও পানি উঠে গেছে।  

সিলেট জেলায় ১৩ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে জানিয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, 'বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটের তেমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি। পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদির বলেন, 'আমাদের দুটি উপকেন্দ্রে বন্যার পানির কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে একটি উপকেন্দ্র সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। আর শাহজালাল উপশহর এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি থাকার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।'

সিলেটে বন্যাকবলিতদের চিকিৎসা দিতে ১৪০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের সিভিল সার্জন এস এম শাহরিয়ার।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, জেলায় ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বর্তমানে ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬ হাজার ৪৭৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদিপশুর জন্য ২২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে।

আর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থানকারী নাগরিকদের খাবার সংকট, পয়ঃসুবিধা, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.