কপিলমুনিতে হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন

বাংলাদেশ

আওয়াল শেখ, খুলনা
18 May, 2022, 10:45 am
Last modified: 18 May, 2022, 10:52 am
পাওয়া গেছে টেরাকোটা, মূর্তি, মাটির তৈরি বড় কড়াইয়ের আংটা, কড়ি, চাল, ইট প্রভৃতি। গত ১২ মার্চ হতে শুরু করে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই খনন কাজ চলে।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের রেজাকপুরে সম্প্রতি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বেরিয়ে এসেছে হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন। তার নাম দেওয়া হয়েছে 'কপিলমুনি ঢিবি'।

সেখানে পাওয়া গেছে, টেরাকোটা, মূর্তি, মাটির তৈরি বড় কড়াইয়ের আংটা, কড়ি, চাল, ইট প্রভৃতি। গত ১২ মার্চ হতে শুরু করে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই খনন কাজ চলে।

এ খনন দলটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরদের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা।

তিনি বলেন, 'রেজাকপুর গ্রামে আমরা যে নিদর্শনগুলো পেয়েছি, ধারণা করা হচ্ছে তা এক হাজার হতে ১২০০ বছরের পুরনো হবে।'

'খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা অঞ্চলে আগেও অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। রেজাকপুরের নিদর্শনের সাথে আগের অনেক নিদর্শনের মিল রয়েছে।বিশেষ করে যশোর জেলার কেশবপুরের ভরতভায়নার নিদর্শনের সাথে অনেক মিল রয়েছে। সেখানকার ইটগুলোর সাথে এখানে পাওয়া ইটগুলোর সাদৃশ্য আছে', যোগ করেন তিনি।

খুলনা শহর থেকে সড়কপথে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের ওই নিদর্শন সম্প্রতি পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক।

দেখা গেছে, সেখানেই প্রায় ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮০ মিটার প্রস্থ এলাকাজুড়ে খনন করা হয়েছে। আর সমতল থেকে প্রায় ৭ ফুট গভীরে মাটি খনন করা হয়েছে। এতে মূল প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা স্পষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি বেশ কিছু নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে।

ওই ঢিবিতে একটি বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামো আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্গাকার এই কক্ষটি ঘিরে একটি প্রদক্ষিণপথ রয়েছে, যা একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র ও মাটির পাত্রের টুকরা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হাঁড়ি, কলস, বাটি, থালা, বদনা, কড়াই, প্রদীপ প্রভৃতির অংশবিশেষ।

এছাড়াও পোড়ামাটির ফলকের ভাঙা অংশ, পোড়ামাটির প্রতিমার ভগ্নাংশ, অলংকৃত ইট, কড়িসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ পাওয়া গেছে।

বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামোর উত্তর-পশ্চিম কোণ ও উত্তর-পূর্ব কোণের প্রদক্ষিণপথের বাইরের দেয়ালের মাটির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় কালো রঙের চাল পাওয়া গেছে। একে পোড়া চাল বলছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।

এই চাল নিয়ে গবেষণা করলে এখানকার প্রাচীন আমলের ধানের প্রজাতিসহ প্রকৃতি-প্রতিবেশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে তাদের ধারণা।

এই ঢিবি এলাকা ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি। মানুষ এখানকার ইট নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছেন। সেখানে রাস্তা, বসতবাড়ি, গোয়ালঘর, পুকুর, ডোবা, ফলবাগান, বাঁশঝাড় প্রভৃতি রয়েছে। ঢিবির ইট তুলে তুলে সেখানে গর্ত করে ফেলা হয়েছে। আর ওই তোলা ইট নিজেদের ঘরবাড়িতে ব্যবহার করেছেন।

সুন্দরবন সংলগ্ন এই অঞ্চলে আগেও অনেক প্রাচীন নিদর্শন মিলেছে। এমনকি এই রেজাকপুর গ্রামের অনেক বাড়িতে যে ধরণের বিশেষ টালি-সদৃশ ইট পাওয়া গেছে, তার ব্যবহার আছে।

এ থেকে অনুসন্ধানকারীদের ধারণা, এই রেজাকপুর ও এর আশেপাশে অনেক প্রাচীন নিদর্শন আছে। স্থানীয়ভাবে মানুষের কাছে এগুলো ঢিবি নামে পরিচিত ছিল এবং মানুষ এখানকার এই বিশেষ ইট নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। কপিলমুনি ও সংলগ্ন সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার একাধিক জায়গায় এমন ঢিবি রয়েছে। এ থেকে অনুমান করা হচ্ছে, এখানে আরও অনেক নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে।

সুন্দরবন সংলগ্ন এই অঞ্চলে বহুদিন আগে থেকেই মানুষের বসতি বলে ধারণা করা হয়। মহাকাব্য রামায়ন-এ কপিলেশ্বর মুনি ও বিশাল জলাভূমির বন-এর উল্লেখ রয়েছে। সতীশচন্দ্র মিত্রের শত বছর পুরনো গ্রন্থ 'যশোহর- খুলনার ইতিহাস'-এ কপিলমুনিতে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থানের উল্লেখ রয়েছে। এই এলাকায় একাধিক ঢিবি থাকার কথাও বলা হয়েছে। পুকুর খননের সময় এই অঞ্চলে বুদ্ধ প্রতিমা পাওয়া গিয়েছিল। কপিলমুনি বাজারের মন্দিরে থাকা বিষ্ণু মূর্তিটিও ১২০০ হতে ১৪০০ বছর আগেকার বলে ধারণা করা হয়।

এখানকার খননের সাথে যুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক দলটিও বলছে, কপিলমুনি, রেজাকপুর, রামনগর, সিংহজানি, কাশিমনগরসহ আশেপাশের এলাকাজুড়ে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। তারা রেজাকপুরের এই নিদর্শনটিকে 'কপিলমুনি ঢিবি' নামে আখ্যা দিয়েছেন। এর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২৫০ মিটার, প্রস্থ ১৮০ মিটার। ঢিবিটি সমুদ্রতল থেকে ৩ দশমিক ৪৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।

রেজাকপুরে খনন শুরু হওয়ার পর থেকে নানান বয়সী মানুষ, শিক্ষার্থী, এমনকি বিদেশি প্রতিনিধিদলও এখানে এসেছেন।

ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে অনুসন্ধিৎসু স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাডভোকেট বিপ্লব কান্তি মন্ডলও দুয়েকদিন পরপর এই খননস্থলে এসেছেন।

তিনি বলেন, 'অনেক পরে হলেও রেজাকপুরে খনন কাজ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একটি যথাযথ কাজ করেছে; তবে এই খনন কাজটি আরও অনেক বিস্তৃত হওয়া উচিত।

এতোদিনে খননে উদ্যোগী না হওয়ায় অনেক নিদর্শন হারিয়ে গেছে। যা আছে, তা রক্ষা করার জন্য খনন কাজ আরও করা উচিত।'   
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.