চলমান প্রকল্পগুলোর মূল্য সমন্বয়ের দাবি ঠিকাদারদের  

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
18 April, 2022, 11:50 am
Last modified: 18 April, 2022, 12:16 pm
কিছু নির্মাণ সামগ্রীর বাজারমূল্য দেড় থেকে দুইগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে লোকসানে অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

নির্মাণ সামগ্রীর অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলমান কাজ এগিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশের ঠিকাদাররা। পণ্যের যে দাম নিয়ে তারা কাজ শুরু করেছিলেন বর্তমান বাজারমূল্য অনেকক্ষেত্রে তার দেড় থেকে দুইগুণ। এতে লোকসানে অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এই অবস্থায় সরকারি ক্রয় বিধি (পিপিআর) অনুযায়ী, বর্তমানে চলমান ঠিকাদারি কাজগুলোর প্রাইস এডজাস্টমেন্ট বা মূল্য সমন্বয় এবং নতুন কাজের ক্ষেত্রে রেট সিডিউল হালনাগাদ করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদ। একই সঙ্গে ঠিকাদারি কাজের ভ্যাট ও ট্যাক্স সাড়ে ১৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

রোববার রাজধানীর কল কমিউনিটি ক্লাবে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তারা এ দাবি জানান।

বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'চলমান করোনা সংক্রমণের কারণে ঠিকাদাররা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। তার উপর গত এক বছরের বেশি সময় ধরে নির্মাণ উপকরণ যেমন- লোহা এবং লৌহ জাতীয় দ্রব্য, সিমেন্ট, পাথর, ইট, বিটুমিন, ডিজেল, এ্যালুমিনিয়াম, বিল্ডিং ফিনিশিং আইটেমসহ প্রায় সব নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক ও লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে চলমান কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।'

তিনি বলেন, ২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রতি টন রডের দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এখন প্রতি টন রডের দাম ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল দ্রব্যের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৯৪ শতাংশ। এ শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক, সুপারভাইজার ও দক্ষ জনবলের মজুরীও শতকরা ৬০-৭০ শতাংশ বেড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য। বিশেষ করে ডিজেলের দাম ৬৫ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হওয়ায় পরিবহন ও যন্ত্রপাতি চালনা ব্যয় বেড়ে গেছে। আবার চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমদানিকৃত সব নির্মাণ মালামাল ও যন্ত্রপাতির দাম আরও আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

রাজ্জাক বলেন, 'গত অর্থবছরে দরপত্র দাখিলের সময় ৫% হারে এআইটি ধার্য ছিল, এখন তা ৭% করা হয়েছে এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ার ফলে ঠিকাদারগণ বিল পাচ্ছেন না। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এতে ব্যাংক হতে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে, ঠিকাদারের আর্থিক সক্ষমতা কমছে। এই অবস্থায় করোনাকালীন পরিস্থিতি ও ঋণপত্রের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে সরকার ভ্যাট ও ট্যাক্স ১৪.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করলে ঠিকাদাররা ঘুরে দাঁড়াতে পারে।' 

ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির বিষয় তুলে ধরে সংসদে কথা বলেছেন। এখন আমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের পালা।'

তিনি বলেন, 'সারাদেশের সব উন্নয়ন কাজ করে দিচ্ছে ঠিকাদাররা। তারপরও তাদের কিভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বলা হয় ঠিকাদাররা চুরি করে। কিন্তু গুলশান-বনানী সহ অভিজাত এলাকায় হিসাব করলে দেখা যাবে সেখানে ঠিকাদারদের কতটা বাড়ি আছে! খুঁজলে পাওয়া যাবে না। সব বাড়ি সরকারি কর্মকর্তা ও বড় ব্যবসায়ীদের।'

বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের সভাপতি 'কুশলী নির্মাতা'র ব্যবস্থাপনা প‌রিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা চলমান প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে পারছি না এবং নতুন কোন দরপত্রেও অংশগ্রহণ করার সাহস পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় চলমান অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির সাথে মূল্য সমন্বয় না করলে সকল নির্মাণ কাজে স্থবিরতা দেখা দিবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ঠিকাদারদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে একটি কমিটি করা হোক। আর সরকারের পক্ষ থেকে একটি কমিটি হোক। যে সমস্যা আসবে আমাদের কমিটির মাধ্যমে সেটা সরকারের কমিটির কাছে তুলে ধরবো।'

রফিকুল ইসলাম বলেন, 'একনেকে প্রকল্প পাশ হয়। কিন্তু আমাদের কোন প্রতিনিধি না থাকায় বিভিন্ন প্রজেক্টের বিস্তারিত যখন প্রধানমন্ত্রী শুনতে চায় তখন আমাদের দাবি উঠে আসে না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সমস্যার কথা শুনতে পারে না। আমাদের যে কোনভাবে হোক প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।' 

স্পেক্টা কনস্ট্রাকশনের নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মমতাজ উদ্দিন বলেন, 'আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে আমাদের কথাগুলো নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছাবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রনালয়ে আমাদের দাবিগুলো স্মারকলিপি আকারে দিতে হবে।'

সংসদ সদস্য নাসিমুল আলম চৌধুরী নজরুল বলেন, 'আমাদের একটা সমিতি করতে হবে, যার মাধ্যমে একটি ফান্ড গঠন করতে হবে। যে ফান্ডের টাকা আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরতে খরচ করা হবে।'

সরকারের কাছে ঠিকাদারদের দাবি- বর্তমান চলমান কাজগুলো যেহেতু 'ফিক্সড রেট কন্ট্রাক্টে' সম্পাদিত হচ্ছে; তাই বিশেষ ব্যবস্থায় প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর)-এ সন্নিবেশিত ফর্মূলা অনুযায়ী মূল্য সমন্বয় ধারা সকল চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা।  

বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী গণপূর্ত বিভাগসহ সকল দপ্তরের রেট শিডিউল হালনাগাদ করা। প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত খরচ সকল রেট শিডিউলে সন্নিবেশিত করা। বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ববাজার পরিস্থতিতে, বৈশ্বিক অর্থ মন্দার প্রভাবে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির বিপরীতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি নির্মাণ কাজের প্রাক্কলনে প্রাইস কন্টিনজেন্সি-এর আওতায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা। সরকারের পরিপত্র ও বিধিনিষেধ আরোপের কারণে নির্মাণ সামগ্রীর দরের পরিবর্তনের প্রভাব এবং নির্মাণ ব্যয় সমন্বয় সংক্রান্ত পিপিআর এ বর্ণিত ধারা কার্যকর করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত নির্বাহী প্রতিষ্ঠানকে জরুরী আদেশ প্রদান।

এছাড়াও চলমান নির্মাণ চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়ন নির্বাহী প্রতিষ্ঠান যেমন- গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি মূল্য সংশোধন সেল তৈরী করে চুক্তিবদ্ধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের দাবি রয়েছে।

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন এস এস রহমান গ্রুপের চেয়ারম্যান রকিবুল আলম দিপু সহ দেশের নামকরা শতাধিক ঠিকাদারি কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ও মনোনীত প্রতিনিধিরা। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.