চাকরি পেতে ১০ বছরে ১.৫-২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে কাতারের বাংলাদেশি প্রবাসীরা: গার্ডিয়ান

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
01 April, 2022, 10:30 pm
Last modified: 02 April, 2022, 01:34 pm
কাতারে নিয়োগ ফি নেওয়া অবৈধ হলেও নিয়োগ পেতে ৩ হাজার- ৪ হাজার ডলার দিতে বাধ্য হচ্ছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা।

বিগত দশকে কাতারে চাকরি নিশ্চিত করতে নিয়োগ ফি হিসেবে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের নিম্ন আয়ের প্রবাসী শ্রমিকরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিতে বাধ্য হয়েছে।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ ও নেপালের প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত এই ফি যথাক্রমে ৩ হাজার-৪ হাজার ডলার এবং ১ হাজার-দেড় হাজার ডলার। নিম্ন আয়ের এই শ্রমিকরা মাসে আয় করতে পারেন মাত্র ২৭৫ ডলার, অর্থাৎ নিয়োগ ফিয়ের খরচ যোগাতেই তাদের অন্তত এক বছর কাজ করতে হয়। 

২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই নিয়োগ ফি হিসেবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা দিয়েছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে নেপালি শ্রমিকরা এই ফি দিয়েছে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। কাতারে কর্মরত নিম্ন আয়ের প্রবাসী শ্রমিকদের থেকে এভাবে আদায় করা মোট ফি'র পরিমাণ আরও অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর শ্রমিকদের থেকেও এই ফি নেওয়া হয়। 

এই আদায়কৃত অর্থের মোট সংখ্যা গণনা করেছে দ্য গার্ডিয়ান। কয়েকটি শ্রম অধিকার গ্রুপ এই সংখ্যা যাচাই-বাছাই করে দেখেছে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠন ও শ্রম বিশেষজ্ঞদের প্রকাশিত নিয়োগ ফি ও সংশ্লিষ্ট খরচের তথ্য থেকে এই হিসাব করা হয়েছে। 

তবে কাতারে নিয়োগ ফি নেওয়া অবৈধ। কিন্তু তারপরও সর্বত্র এর চল আছে। উপসাগরীয় দেশগুলোতে সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়োগ ফি নেওয়া।  

গার্ডিয়ানের হিসাবে উঠে আসা সংখ্যায় সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে সব খরচ রাখা হয়েছে। বিভিন্নভাবে হয় এটি। প্রায়ই দেখা যায়, কাতারের কোম্পানি বা দালাল এবং শ্রমিক পাঠানো হয় এমন দেশগুলোর রিক্রুটমেন্ট এজেন্টরা শ্রমিকদেরকে তাদের নিজ নিয়োগের ফি দিতে বাধ্য করে। শ্রমিকরা নিজ দেশ ছাড়ার আগে স্বদেশী এজেন্টদের এই ফি দিয়ে আসেন। 

এই খরচ যোগাতে অনেক সময়ই এসব শ্রমিকদের উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয় বা নিজেদের জমি বিক্রি করে দিতে হয়। বন্দি হয়ে যান আধুনিক দাসত্বে, এই ঋণ শোধ হওয়ার আগে চাকরিও ছাড়তে পারেন না তারা। 

নিজ দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে এতোবেশি খরচ দিয়ে হলেও উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজের সন্ধানে যান দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক মানুষ। অনেকে ঝুঁকিটা জেনেই এই খরচ দেন, শুধুই ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পেতে। 

কাতার বলছে, এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। ২০১৮ সাল থেকে আটটি দেশে নিয়োগ কেন্দ্র খোলা হয়েছে, শ্রমিকরা এসব কেন্দ্রে গিয়ে প্রশাসনিক কাজ শেষে দেশত্যাগের আগে চাকরির নিয়োগপত্র সই করে যেতে পারবেন। 

কাজের জন্য দেশে একরকম শর্ত-নীতি জেনে গিয়ে কাতার গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র আবিষ্কার করার মতো ঘটনা কমেছে এই নিয়োগ কেন্দ্রগুলো স্থাপনের ফলে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়োগ ফি নেওয়া ঠেকাতে এসব কেন্দ্র তেমন কোনো কাজেই আসেনি কারণ নিয়োগ প্রক্রিয়ার আরও আগেই এই ফি নিয়ে নেওয়া হয়। 

তবে,  স্টেডিয়ামের সঙ্গে চুক্তি আছে এমন কোম্পানিগুলো যাতে তাদের শ্রমিকদের নিয়োগ ফি ফিরিয়ে দেয় সেজন্য কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন কমিটি ২০১৮ সালে নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়। শ্রমিকদের নিয়োগ ফি পরিশোধের প্রমাণ দেখাতে হবে না, কারণ এটি অবৈধ হওয়ায় পরিশোধের প্রমাণ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। মোট ৪৯ হাজার শ্রমিককে সর্বসাকুল্যে ২৮.৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে রাজি হয় কোম্পানিগুলো। এখন পর্যন্ত এর ২২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। 

তবে এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থ ফিরে পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা কাতারের মোট প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যার খুবই নগন্য অংশ মাত্র। অনেক ক্ষেত্রেই যে টাকা পরিশোধ করা হয় তা শ্রমিকদের দেওয়া নিয়োগ ফি'র অল্প কিছু অংশ মাত্র। শ্রমিকদের নেওয়া ঋণের জন্য কোনো অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। 

বিশ্বকাপ আয়োজনে সরাসরি ভূমিকা রাখা হসপিটালিটি খাতের অসংখ্য শ্রমিক এই পরিকল্পনার আওতায় পড়েনি বলে জানিয়েছে গার্ডিয়ান। গত বছর ফিফা সমর্থিত হোটেলগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল গার্ডিয়ান, এসব শ্রমিকরা জানিয়েছে ২,৭৫০ ডলার পর্যন্ত নিয়োগ ফি দিয়েছে তারা। 

বিশ্বকাপ আয়োজনকারী সুপ্রিম কমিটি এক বিবৃতিতে বলে, "যেরকম পরম্পরা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ আমরা।  ন্যায্য, টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী শ্রম সংস্কার ও জীবন উন্নয়ন করবে এ পরম্পরা"। 

কিছু শ্রমিককে বিনামূল্যে ও ন্যূনতম ফিয়ের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হলেও অধিকাংশকেই এই ফি দিতে বাধ্য করা হয়। নিয়োগদাতা ও কাতারের এজেন্ট এবং নেপাল-বাংলাদেশের রিক্রুটার ও দালালদের মধ্যকার চুক্তির ভুক্তভোগী হন অনেকেই। 

কিছু ক্ষেত্রে কাতারের এজেন্টরা শ্রমিকদের নিয়োগের জন্য ভিসা নিশ্চিত করে পরবর্তীতে এর পরিবর্তে ৩০০ থেকে ৫০০ ডলার দাবি করে দেশগুলোর এজেন্টদের কাছ থেকে। ফলে এই খরচ বহন করতে হয় শ্রমিকদের। 

কাতার ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, "শ্রমিকরা যে খরচটা দিচ্ছে তা মূলত রিক্রুট্মেন্ট এজেন্টদের আদায় করে নেওয়া 'ঘুষ'। এর কারণেই উচ্চ সুদের ঋণের বোঝা চাপে শ্রমিকদের ওপর"। 

বাংলাদেশি শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি নিয়োগ ফি দিতে হয়। ২০১৬ সালে আমান উল্লাহ নামের এক বাংলাদেশি শ্রমিকের কাছে কাতারে একটি চাকরির জন্য ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা (৪,১৯০ ডলার) নেওয়া হয়। মাসিক ২,৫০০ কাতারি রিয়াল বেতনে ঢালাইকারীর কাজ পাবেন বলে জানানো হয়েছিল তাকে। কিন্তু তিনি কাতারে পৌঁছে দেখেন, ৮০০ রিয়াল বেতনে একটি খামারে কাজ করতে মরুভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। 

"সেখানে কাজের কোনো সময় বাধা ছিল না। বিদ্যুৎ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়া থাকতে হয়েছে আমাদের, সেখান থেকে বের হওয়ারও অনুমতি ছিল না"।

নিজের অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে ফেরার অনুমতি পেতেও তাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। দেশে ফিরে দেখলেন কাতারে গিয়ে তার কোনো আয়ই হয়নি। উল্টো ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখ টাকায়। আগের ঋণ পরিশোধ করতে আবারও ঋণ নিতে বাধ্য হন আমান উল্লাহ। 

এমনকি মৃত্যুও মুক্তি দেয় না এই ঋণের বোঝা থেকে। মেয়ের যৌতুকের অর্থ আয় করতে একজন এজেন্টকে ১৫০,০০০ এনপিআর (নেপালি রুপি) দেন নেপালের মোহামাদ নাদাফ মানসুর ধুনিয়া। ২০১৮ সালে কাতারে নির্মাণ কাজে যোগদানের জন্য এই নিয়োগ ফি দেন তিনি। বার্ষিক ৪৮ শতাংশ সুদের হারে ঋণের অর্থ যোগাড় করেছিলেন নাদাফ মানসুর। গত বছর কর্মক্ষেত্র থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়। 

তার স্ত্রী মাইরুল খাতুন স্বামীর মৃত্যুর বিষয়ে বলেন, "আমার মনে হয় ঋণ, মেয়ের বিয়ে আর পরিবারের দেখভালের চাপ আত্মহত্যার কারণ হতে পারে।"

হাত-পায়ে কাদা লেপ্টে ছিল মাইরুল খাতুনের। বাড়ির পাশে এক জমিতে কাজ করেন তিনি, দিনে আয় ৩০০ নেপালি রুপি আর কয়েকটি আলু। 

স্বামীকে হারালেও তার ঋণ রয়েই গেছে। "আমি এখন অনেক চিন্তায় থাকি। আগে আমরা মাংস, দুধ খেতে পারতাম, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সামর্থ্য নেই এসব খাওয়ার। আমি রাতে ঘুমাতে পারিনা", বলছিলেন তিনি। 

কাতার সরকার জানিয়েছে, অবৈধ নিয়োগের সাথে জড়িত কোম্পানিগুলোকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এরকম ২৪টি রিক্রুট্মেন্ট এজেন্সি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাতারের আইন ভাঙায় তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। 

কাতার সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, "ইউরোপসহ বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের সুরক্ষায় কিছু জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কাতার শ্রম বাজারে অবৈধ নিয়োগের চর্চা বন্ধ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে শোষণ চলে তা মোকাবিলায় সচেষ্ট"। 

বাংলাদেশের  প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, "নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত ও দায়িত্বশীল শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ সরকার।"

উচ্চ নিয়োগ ফি'র জন্য উভয় দেশের মধ্যস্ততাকারীদের 'ভিসা বাণিজ্য'-কে দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ পেলে সে সব রিক্রুট্মেন্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.