দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে পুষ্টিতে 

বাংলাদেশ

23 March, 2022, 01:25 pm
Last modified: 23 March, 2022, 03:01 pm
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খাবারের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।

 

দেড় বছরের ছেলে রহমতুল্লাহর হার্ট সার্জারির খরচ বহন করতে পারছেন না রাজধানীর জিগাতলার একটি বাড়ির কেয়ারটেকার মোহাম্মদ আফসার শেখ তার। বারো হাজার টাকা বেতন থেকে ছেলের চিকিৎসার জন্য মাসে দেড় হাজার টাকা খরচ করতে হয় তাকে। 

"ছেলেটির চিকিৎসা, পরিবারের খাবার খরচ, বড় তিন সন্তানের স্কুলের খরচ সবকিছুর পর মাস শেষে কিছুই থাকে না। মাসের বেশির ভাগ দিনই আমরা ভাত, ডাল, আলু ভর্তা খাই," মঙ্গলবার বিকেলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।

আফসার শেখ বলেন, "অনেক কষ্টে দুইদিন টিসিবির একটি ট্রাক থেকে ডাল, তেল ও চিনি কিনে আনলাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ায় রমজান মাস কীভাবে কাটাবো জানি না।"

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাবার খরচ কমাতে বাধ হয়েছেন রাজধানীর উত্তর পীরেরবাগের বাসিন্দা রাজিয়া বেগম। 

তিনি টিবিএস-কে জানান, মহামারির কারণে তার স্বামী চাকরি হারিয়েছে। এখন ছোট ব্যবসা করে। যা আয় করে তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া, ছেলে-মেয়ের পড়াশুনা খরচ দেয়ার পর তেমন কিছুই বাকি থাকে না। 

রাজিয়া বেগম বলেন, "দুই ছেলে ও এক মেয়ের স্কুলের বেতন, বই-খাতার খরচ জোগাতে গিয়ে কমাতে হচ্ছে খাবারের খরচ। এখন ছেলে-মেয়েদের দুধ-ডিম খাওয়াতেই পারিনা। বেশিরভাগ দিন সবজি খেতে হয়, তারও দাম বেশি।"

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খাবারের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।  ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড মহামারি চলাকালীন আর্থিক সংকট থেকে বাঁচতে ৪৩ শতাংশ মানুষ তাদের খাবারের খরচ কমিয়েছে।

এতে করে পুষ্টি পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

খ্যাতিমান পুষ্টিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অনারারি অধ্যাপক ড. খুরশীদ জাহান টিবিএসকে বলেন, গড়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দিনে ২১০০ কিলো ক্যালোরির প্রয়োজন। একজন মানুষ প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন, নিউট্রিশন না পেলে তার প্রভাব পড়ে তার কাজে। প্রত্যেক মানুষের বয়স, উচ্চতা, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির ওপর ভিত্তি করে ক্যালোরি, প্রোটিন রিকয়রমেন্ট আছে। প্রতিদিন প্রয়োজনীয় খাবার না খেলে শিশুদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হবে। 

"এছাড়া অপুষ্টির সাথে বিভিন্ন রোগ সংক্রমণের সম্পর্ক আছে। অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন হয়, এর ফলে বিভিন্ন রোগ বেড়ে যায়," বলেন ড. খুরশীদ জাহান। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হলেও পুষ্টি খাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো অনেকটা পিছিয়ে বাংলাদেশ। দেশে শিশু, নারী ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে। স্বাভাবিক সময়ে অপুষ্টির যে চিত্র করোনা মহামারিতে তা আরো বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের খাবারের পরিমাণ কমলে তা আরো খারাপ হবে।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্যমতে, ৫৪ শতাংশের বেশি প্রাক-স্কুলগামী বয়সের শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, ওজন কম ৫৬ শতাংশ শিশুর। 

ইউএসএআইডি বলেছে যে বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারী এবং মা হননি বা স্তন্যদানকারী নন এমন ৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।৫৭ শতাংশ গর্ভবতী/ স্তন্যদানকারী নারীর জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়াও, ১৫-১৯ বছর বয়সী অবিবাহিতদের মধ্যে ৮ শতাংশের ওজন কম।

ড. খুরশীদ জাহান বলেন, "আগে বলা হতো গরিবের প্রটিন হলো ডাল- এখন সেই ডালের দামও বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ প্রয়োজনীয় প্রোটিন, নিউট্রিশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দাম না কমালে যেসব উৎস থেকে প্রোটিন, ফ্যাট পাওয়া যায় সেগুলো খাওয়া মানুষ আরো কমিয়ে দেবে। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে পুরো সমাজের ওপর। একদিকে অপুষ্টির কারণে শারিরীক বিভিন্ন সমস্যা বাড়বে আবার কর্মক্ষমতাও কমে যাবে।"

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খাবারের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন রাজধানীর রামপুরার মহানগর প্রজেক্টের গৃহকর্মী ফিরোজা বেগম। 

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "বাড়ি ভাড়া, ছোট নাতির জন্য গুড়া দুধ কিনতে গিয়ে নিজেদের খাবারের খরচ কমাতে হচ্ছে। আগে সপ্তাহে অন্তত একদিন ছোট মাছ খেতে পারলে এখন তাও খাওয়া হয়না। দুধ আমরা কখনো খাইনা, মাঝে মাঝে ডিম ভাজি খাই তাও ডিমের দামও বেশি এখন।"

নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে ডিম। ডিমের দামও বেড়েছে। বাজারে এক ডজন ডিমের দাম এখন ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। ডিমের দাম বাড়ায় মানুষের পুষ্টিতে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খালেদা ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ডিমের প্রোটিন অনেক উচ্চ মানের। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্যই পুষ্টি নিশ্চিত করতে ডিম খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ডিম সবসময় সুবিধাবঞ্চিতদের নাগালের মধ্যে থাকা উচিত। ডিমের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের পুষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।"

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.