নওগাঁর শত বছরের পুরনো প্যারা সন্দেশ, সুখ্যাতি ছড়িয়েছে বিদেশেও 

বাংলাদেশ

20 March, 2022, 03:20 pm
Last modified: 20 March, 2022, 06:04 pm
একেকটি দোকানে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৭০ কেজি পর্যন্ত প্যারা সন্দেশ তৈরি হয়ে থাকে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারত, কলকাতা, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের ক্রেতারা প্যারা সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছেন বর্তমানে।

যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালি জাতির মিষ্টান্ন দিয়ে অতিথি আপ্যায়নে যেন জুড়ি নেই। তার মধ্যে শত বছরের সুখ্যাতি রয়েছে ঐতিহ্যবাহী নওগাঁর 'প্যারা সন্দেশ'-এর।      

শুরুতে পূজামন্ডপে দেবদেবীর উপাসনার জন্য তৈরী হলেও এখন এটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। বর্তমানে দেশের মিষ্টান্ন জগতে অনেক বড় একটি জায়গা দখল করে আছে এ সন্দেশ। তবে কারিগররা সুষ্পষ্টভাবে বলতে পারেননি ঠিক কবে থেকে প্যারা সন্দেশের প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্যারা সন্দেশ তৈরী হচ্ছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আনুমানিক প্রায় শত বছর যাবত নওগাঁ শহরে প্যারা সন্দেশ তৈরী হচ্ছে।   

জানা গেছে, নওগাঁ শহরের কালীতলা এলাকার শ্রী শ্রী বুড়ী কালী মাতা মন্দিরের পাশে ভোগের প্রয়োজনে শত বছর আগে দোকানে এই প্যারা সন্দেশ তৈরী হতো। পূজারীরা বিভিন্ন পূজামন্ডপের দেবদেবীর উপাসনার জন্য এই সন্দেশ মন্দিরে ভোগ দিতেন। বর্তমানেও এর প্রচলন রয়েছে।

শ্রী শ্রী বুড়ী কালী মাতা মন্দিরের প্রধান গেট সংলগ্ন 'মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশ' এর দোকান। ওই দোকান থেকে প্রতিদিন সকালে সনাতন ধর্মাম্বলীরা সর্বনিম্ন ৫ টাকা থেকে ১১ টাকায় প্যারা সন্দেশ কিনে মন্দিরে ভোগ দেন। এই দোকান থেকে খুচরা ৩৪০ টাকা কেজি এবং শহরের মিষ্টিপট্টিসহ অন্য দোকানে ৩৭০-৩৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় সন্দেশ।  

বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠানো বা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই সন্দেশ এখন মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাদ আর পুষ্টিগুণে এর সুনাম এখন লোকের মুখে মুখে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারত, কলকাতা, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের ক্রেতারা প্যারা সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছেন।

জনশ্রুতি আছে, ভারতের বিহারের কোনো এক নবাবের মিষ্টি তৈরির কারিগর ছিলেন মহেন্দ্রী দাস। নবাব এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ওই ব্যক্তি প্রাণ নিয়ে এসে নওগাঁ শহরের কালীতলায় বসবাস শুরু করেন। জীবিকার তাগিদে তিনি 'প্যারা' সন্দেশ তৈরি করে বিভিন্ন মন্দিরে বিক্রি করতেন। পরে সেখানেই ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান খুলে বসেন। তখন কালীতলা এলাকায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। মহেন্দ্রীর পর তার ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দাস দোকানের দায়িত্ব পান। সেসময় বিমল মোহন্ত নামে মিষ্টি তৈরির এক কারিগরের হাতে তৈরি 'প্যারা' সন্দেশের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ধীরেন্দ্রনাথ দাস প্রায় ৩০ বছর ব্যবসার পর দোকানটি সুরেশ চন্দ্র মহন্তের কাছে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান।

এরপর সুরেশ চন্দ্র মোহন্ত দোকানে নতুন মিষ্টির কারিগর নারায়ণ চন্দ্রকে আনেন। আবারও ওই দোকানের মালিকানা পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দোকানের মালিক বৈদ্য রতন দাস। তিনিই এখন প্যারা সন্দেশ তৈরী করছেন। 

কালীতলা মহল্লার বাসিন্দা উত্তম কুমার বলেন, নওগাঁতে বেশ কয়েকটি প্যারা সন্দেশের দোকান হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে তার মধ্যে মন্দিরের পাশের দোকান  'মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশ'টি সবচেয়ে ভাল। দামও তুলনামূলক কম।

তবে বাজারের মধ্যে মিষ্টান্নের দোকানে কিছুটা হলেও দাম বেশি। দোকানগুলোর মালিকানা বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হলেও তাদের দোকানের সন্দেশের স্বাদ ও মান আছে সেই আগের মতই।

শহরের ঘোষপাড়া মহল্লার বাসিন্দা কাবেরী রানী ও কালীতলার বাসিন্দা দিপালী রানী বলেন, মন্দিরের পাশেই মিষ্টানের দোকান। দেবীর আরাধনায় ভোগের জন্য মিষ্টান্নের প্রয়োজন হয়। সকালে মন্দিরের পাশে সৈকত দাসের দোকান থেকে ভোগ হিসেবে প্যারা সন্দেশ নিয়ে থাকি। পাশাপাশি বাড়িতে খাওয়ার জন্য প্যারা সন্দেশ এখান থেকে কেনা হয়।

শহরের কালীতলার বিখ্যাত 'মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশ' দোকানের স্বত্বাধিকারী বৈদ্য রতন দাস বলেন, মহেন্দ্রী দাস নামে এক ব্যক্তি প্রথমে প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেছিলেন। তখন কালীতলা এলাকায় জনবসতি তেমন ছিল না। পর্যায়ক্রমে মহেন্দ্রীর পর এখন আমি দোকানের মালিক। প্রায় ৩৫ বছর ধরে প্যারা সন্দেশের ব্যবসা করছি। প্রতিদিন পাশের মন্দিরে ভোগ দেন পূজারীরা। প্রতিদিন ভোগের জন্য প্রায় ৪ থেকে ৫ কেজি সন্দেশ বিক্রি হয়। এছাড়া বিভিন্ন দোকানদাররা পাইকারি কিনে নিয়ে যায়। কিছু দোকানে আবার খুচরা বিক্রি করা হয়। দেশের বাইরে যাদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে তাদের জন্য অনেকে কিনে পাঠান।

বৈদ্য রতন দাসের ছেলে সৈকত দাস বলেন, আমরা বংশপরম্পরায় শহরের কালীতলায় বিখ্যাত প্যারা সন্দেশ তৈরী করে সরবরাহ করছি। বর্তমানে নওগাঁয় বেশ কয়েকজন প্যারা সন্দেশ তৈরি করলেও আমাদের দোকানের ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৭০ কেজি পর্যন্ত প্যারা সন্দেশ তৈরি করা হয়ে থাকে। তবে পূজাসহ বিভিন্ন দিবসগুলোতে আরো বেশি পরিমাণ প্যারা সন্দেশ তৈরি করা হয়।

প্যারা সন্দেশ তৈরির কৌশল ও উপকরণ বিষয়ে সৈকত দাস বলেন, তৈরি পদ্ধতি খুবই সহজ। এক কেজি প্যারা সন্দেশ তৈরি করতে দরকার হয় প্রায় ৪ লিটার তরল দুধ, এর সঙ্গে ১ কেজি চিনি যোগ করা হয়। প্রথম ধাপে তরল দুধের সাথে চিনি মিশিয়ে জ্বাল করে তৈরি করা হয় ক্ষীর। অনবরত নাড়াচাড়া করতে হয়। এক সময় ক্ষীর হাতায় জড়িয়ে আসে। তখন হালকা উষ্ণ ক্ষীর দু'হাতের তালু দিয়ে রোল করে সামান্য চাপ দিলেই তৈরি হয়ে যায় প্যারা সন্দেশ। প্রতিটি প্যারা সন্দেশ প্রায় আধা ইঞ্চি চওড়া ও দুই ইঞ্চি লম্বা করা হয়ে থাকে। প্রতি কেজিতে ৬০ থেকে ৬৫টি পিস হয়। দুধ আর চিনি ছাড়া অন্য কোন উপকরণ না থাকায় স্বাভাবিকভাবে ১০ থেকে ১৫ দিন রাখা যায়। আর কৃত্রিম উপায়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এই সন্দেশ ভালো রাখা যায়। প্রতি কেজিতে দুধ, চিনি, মসলাসহ সব মিলে খরচ পড়ে ৩০০-৩১০ টাকার মত। আর বিক্রি করা হয় ৩৪০ টাকা কেজি দরে।    

শহরের মিষ্টিপট্টি বাজারে 'নওগাঁ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক বলেন, অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় প্যারা সন্দেশের দাম তুলনামুলক বেশি। ক্রেতাদের কাছে সারা বছরই এ মিষ্টান্নের চাহিদা থাকে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ক্রেতারা নিয়ে যান। এছাড়া পূজা, ঈদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই শুধু নয়, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া হয় এই প্যারা সন্দেশ। স্বাদ ও মানের দিক থেকে এই প্যারা সন্দেশ মুখরোচক ও অতুলনীয়। স্বাভাবিকভাবে বেশ কয়েক দিন ধরে সংরক্ষণ করা যায়।

কবি, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক আতাউল হক সিদ্দিকী বলেন, হিন্দু সম্প্রদায় সারা বছর বিভিন্ন পূজা অর্চনা করে থাকেন। দেবীর আরাধনায় প্রয়োজন মিষ্টান্নের। শত বছর পূর্বে শহরের কালীতলায় ছোট ছোট মিষ্টির দোকান বসত। এসব দোকান থেকে প্রয়োজনীয় মিষ্টান্ন কিনে পূজারীরা পূজা অর্চনা করত। সে সময় মিষ্টির প্রয়োজনে ওই দোকানের আদি কর্তারা প্রথম প্যারা সন্দেশ তৈরী করেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই সন্দেশ শুধু দেবীর আরাধনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে রসনাবিলাস খাবারের মধ্যে প্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন শহরের বিভিন্ন মিষ্টান্নের দোকানে এটি পাওয়া যাচ্ছে।

স্থানীয় সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী বলেন, মিষ্টান্নের মধ্যে জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার প্যারা সন্দেশ। নওগাঁতে যারা বেড়াতে আসেন লোভনীয় ও সুস্বাদু প্যারা সন্দেশ নিয়ে যেতে ভুলেন না।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.