রোগী নেই চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালে!
রোগী নেই, ডাক্তার নেই। নেই কোনো অপারেশনের যন্ত্রপাতি। একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স। তাও নষ্ট হয়ে পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। সরেজমিনে গত ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালে গিয়ে চোখে পড়লো এমনই দৃশ্য।
চট্টগ্রামের অপর দুটি সরকারি হাসপাতাল (চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল) যেখানে রোগীতে ঠাসা, সেখানে একেবারেই ভিন্ন চিত্র সিআরবি এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের প্রধান এই হাসপাতালের।
কর্তৃপক্ষ জানায়, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা না থাকায় দিনদিন রোগী কমে আসছে সেখানে। প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৫ জন করে রোগী আসেন। চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, সার্জন, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক যন্ত্রপাতির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত ১০ বছর ধরে হাসপাতালের রোগী কমে আসছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
রেলওয়ে হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) আব্দুল আহাদ বলেন, হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে। তাই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এখানে গুরুতর রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না।
রোগী সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলকে একাধিকবার জানানোর পরও কোনো প্রতিকার হয়নি বলে তিনি জানান।
নাজুক অবস্থা স্বাস্থ্য সেবার
একসময় চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালের সুনাম জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের আনাচে-কানাচে। রেলওয়ের নিজস্ব স্টাফদের পাশাপাশি বহিরাগতরাও কম খরচে এখানে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পেতেন। এখন রোগীদের চলাচল কমে যাওয়ায় হাসপাতালটি তার গুরুত্ব হারিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলওয়ের ১১,০০০ কর্মী এবং ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পূর্বাঞ্চলের প্রত্যেকে সিআরবিতে অবস্থিত এই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার উপর নির্ভরশীল। পুরো হাসপাতালটি ৯৫ শয্যাবিশিষ্ট।
এখানকার ১৭টি পদের বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৪ জন। তাদের একজন ডা. ইবনে সাফি আব্দুল আহাদ। তিনি প্রধান বা চীফ মেডিক্যাল অফিসার (সিএমও)। এছাড়া ডা. ফাতেমা আক্তার (এএস এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট) প্রায় এক বছর ধরে শিক্ষাছুটিতে আছেন।
আরেকজন, ডা. শিবু নাথ (এএস এক্সটার্নাল ডিপার্টমেন্টস-২) দীর্ঘদিন ছুটিতে ছিলেন, এখন হাসপাতালে আসছেন। ডা. জামাল হোসেনকে মাঝেমধ্যেই লাকসাম রেলওয়ে হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, "বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এই দিকে মনোযোগ বাড়ালে হাসপাতালটি আবার রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পারবে।"
এই হাসপাতালের বাইরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ১০ শয্যা বিশিষ্ট হালিশহর পোর্ট ইয়ার্ড হাসপাতাল, ঢাকায় ৭৫ শয্যা বিশিষ্ট রেলওয়ে হাসপাতাল ও চট্টগ্রামে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট বিশেষায়িত একটি বক্ষব্যাধি হাসপাতালসহ আরও ৩টি চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে; যার সবকটিতেই বিরাজ করছে নানান সমস্যা। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে পোর্ট ইয়ার্ড হাসপাতালের কার্যক্রম। বাকি দুটিতেও রোগী নেই বললেই চলে।
যন্ত্রপাতি ও লোকবল সংকট
চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি যন্ত্রপাতি সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। অপারেশনের জন্য কোন যন্ত্রপাতি নেই।
গাইনী বিভাগ, সার্জারি বিভাগ ও মেডিসিন বিভাগে কোনো রোগী ও চিকিৎসক দেখা যায়নি। হাসপাতালের একপাশে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এ এম হামিদুর রহমানের ল্যাব রুম। তিনি চেয়ারে বসে তিন সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলছিলেন।
হামিদুর রহমান বলেন, "গত দেড় বছর ধরে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ল্যাবে অলস সময় কাটাচ্ছি। কেউ আসে না এখানে।"
বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "জ্বর, মাথাব্যথার মতো ছোটখাটো অসুখের চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনো অসুখে এখানে কারও আসার খবর পাইনি।"
চট্টগ্রামের সচেতন মহলের ধারণা, সিআরবি এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে অনেকখানি সক্রিয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অথচ নিজেদের হাসপাতালটি নতুনভাবে চালু করার ক্ষেত্রে নেই কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।
চট্টগ্রাম জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক ডা. মাহফুজুর রহমান মনে করেন, নতুনভাবে উদ্যোগ নিলে রেলওয়ের এই হাসপাতালটি আবারও স্বাস্থ্য সেবায় সুনাম ছড়িয়ে দিতে পারবে।