আফ্রিকায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ: শ্রম অভিবাসনের নতুন অধ্যায়ে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ

সুবীর ভৌমিক, দ্য ফেডারেল  
21 February, 2022, 07:10 pm
Last modified: 21 February, 2022, 07:10 pm
এটি আসলে দুই পক্ষেরই লাভবান হওয়ার মতো একটি কার্যক্রম। কারণ চুক্তিভিত্তিক চাষবাসের মাধ্যমে শুধু যে বেশি খাদ্য উৎপাদন হবে তা নয়, এর মাধ্যমে একটি 'রাব-অফ ইফেক্ট' তৈরি হবে। অর্থাৎ আফ্রিকান উপজাতিরা যারা এখনো পশুচারণ বা শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং আধুনিক কৃষি সম্পর্কে অবগত নয়, তারা বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে ধান চাষের আধুনিক পদ্ধতি শিখতে পারবে।   

পশ্চিমা দেশগুলো আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছিল  এর প্রাচুর্যকে লুট করতে এবং কৃষ্ণাঙ্গদের দাস হিসেবে নিয়ে যেতে। চীন আফ্রিকাকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে ঠিক একই কারণে- আফ্রিকার বিপুল ঐশ্বর্যে অবাধ বিচরণ চায় তারা। হর্ন অব আফ্রিকার মতো কিছু অঞ্চল আছে এই মহাদেশে, যেখানে পশ্চিমা ও চীনারা সমুদ্রপথের দখল নিয়ে একে-অপরের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই সবকিছুকেই আমরা একটা 'গ্রেট গেম'- এর অংশ হিসেবে ধরে নিতে পারি।     

কিন্তু দরিদ্র ও একই সাথে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈধ অভিবাসী সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ এসবের কোনোটাতেই যায়নি, বরং তারা আফ্রিকাতে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের সুযোগ খুঁজছে। ইতোমধ্যেই আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদানের কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পেয়ে গেছে বাংলাদেশ। এছাড়া আরও কিছু দেশের সাথে বাংলাদেশের গোপন আলোচনা চলছে বলেও মনে করা হচ্ছে।     

কন্ট্রাক্ট ফার্মিং কি? ধারণাটি খুবই সহজ- বাংলাদেশ আফ্রিকান দেশগুলোর হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার জমি লিজ নিবে, যার বেশিরভাগই হবে পতিত জমি। এরপর বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকেরা গিয়ে সেসব জমি চাষ করবে ও ফসল ফলাবে। এর ফলে আফ্রিকার খাদ্য সংকট দূর হবে, বিপুল পরিমাণ জমিতে ফসল উৎপাদিত হবে, বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত শ্রমকেও বিদেশে কাজে লাগানো সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশে জনসংখ্যার চাপ কমবে।

এটি আসলে দুই পক্ষেরই লাভবান হওয়ার মতো একটি কার্যক্রম। কারণ চুক্তিভিত্তিক চাষবাসের মাধ্যমে শুধু যে বেশি খাদ্য উৎপাদন হবে তা নয়, এর মাধ্যমে একটি 'রাব-অফ ইফেক্ট' তৈরি হবে। অর্থাৎ আফ্রিকান উপজাতিরা যারা এখনো পশুচারণ বা শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং আধুনিক কৃষি সম্পর্কে অবগত নয়, তারা বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে ধান চাষের আধুনিক পদ্ধতি শিখতে পারবে।   

বাংলাদেশ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য এ কাজ একেবারে নতুন নয়। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, গত শতাব্দীতেই ব্রিটিশরা আসামের বৃহত্তর অঞ্চল- যার বেশিরভাগই ছিল চর এবং নিচু পাহাড়ি এলাকা, সেখানে ফসল ফলাতে পূর্ববঙ্গের কৃষকদের (মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমানদের) নিযুক্ত করেছিল। এমনকি ২০০৪ সালের সুনামির পর যখন বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, আন্দামানের বিস্তৃত অঞ্চল আর কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত নয়; তখনও ঐ অঞ্চলে থাকা পূর্ববঙ্গের কৃষকেরা (দেশভাগের পর যারা সেখানে বসতি গেঁড়েছিল) এটিকে চাষের উপযুক্ত করে তুলেছিলেন।   

দক্ষিণ সুদানের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী দেং দাউ দেং মালেক তার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী মুহম্মদ আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বৈঠকের সময় কৃষি বিষয়ক একটি চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন।  

মধ্য আফ্রিকার এই দেশটিতে কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছেন দেং দাউ দেং। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কৃষিকাজের জন্য দক্ষিণ সুদানের সুনির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল নির্বাচন করা এবং কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য বাংলাদেশ থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানো হবে। কৃষি গবেষক, বিজ্ঞানী ও কর্মীদের মিলিয়ে তৈরি হবে এই দল।  

দেং দেউ কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাককে আরও জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে দক্ষিণ সুদানের কাছে ছয় লাখ বর্গকিলোমিটার জমি রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, "এসব জমির বেশিরভাগই পতিত এবং অনাবাদী। এই বিশাল এলাকাকে কৃষি উৎপাদনের আওতায় এনে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদের সুযোগ রয়েছে।"

শুধুমাত্র দক্ষিণ সুদানের সাথেই নয়, আফ্রিকার আরো কিছু দেশের সাথে ইজারা নেওয়া জমিতে বাংলাদেশি কৃষকদের ফসল আবাদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে ঢাকা। বছর পাঁচেক আগে কিছু কূটনীতিবিদ বন্ধুর সাথে দেখা করতে দিল্লীতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম প্রায় দশজন আফ্রিকান রাষ্ট্রদূতের সাথে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন প্রয়াত হাইকমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলী। পরে জানতে পারলাম, আফ্রিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশের কন্ট্রাক্ট ফার্মিং- এর সম্ভাবনা আছে কিনা, সেটিই ছিল ওই আলোচনার মূল এজেন্ডা।   

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোয়, বিশেষ করে নির্মাণকাজের সাথে তারা বেশি যুক্ত। মরু অঞ্চলের দেশগুলোতে অসংখ্য প্রতিকূলতাকে জয় করেও তারা জীবিকা নির্বাহ করছে। এদের অনেকেই সেখান থেকে অবৈধভাবে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। 

বছর দুয়েক আগে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে কাজের অনুপযুক্ত পরিবেশ নিয়ে প্রতিবাদ করায় ৩৮ বাংলাদেশি নাগরিককে অপহরণ করে মানব পাচারকারীরা। দলটির মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হওয়ার পর ২৮ জনকে গুলি করে হত্যা করে তারা।   

কিন্তু আফ্রিকার দক্ষিণে পরিবেশ আরও অনুকূল, সেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়। তাই পূর্ব বাংলার কৃষকেরা বেশ ভালো করেই জানে কীভাবে এখানে ফসল উৎপাদন করা যাবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, দক্ষিণ সুদানের সাথে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং চুক্তি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে তা সংশ্লিষ্ট ৩টি ক্ষেত্র: কৃষি, মৎস্য ও জলজ উদ্ভিদে প্রসারিত হবে। সম্প্রতি ঢাকায় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "আমরা একটা ড্রাফট (খসড়া) চুক্তি নিয়ে কাজ করছি এবং দক্ষিণ সুদান সেটি বিবেচনার পর চূড়ান্ত করবে।"

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে অবৈধভাবে অভিবাসী পাচারের বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে তার সরকার। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, "অবৈধ অভিবাসীদের কোনো অস্তিত্ব আমাদের কাছে থাকে না, কারণ তারা আর কখনো ফিরে আসবে না কিংবা দেশে এক পয়সাও পাঠাবে না। কিন্তু আমাদের নাগরিকরা যদি বৈধভাবে বিদেশে যায়, তাহলে আমরা তাদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স আয় করব যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করবে।"

অতীতের প্রসঙ্গ টেনে নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সামরিক শাসকেরা তাদের 'পাকিস্তানি মনোবৃত্তি' দিয়ে দেশের মানুষকে শুধু বোঝা হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদেরকে সম্পদ হিসেবে দেখেছে। বিশ্বব্যাংক যখন আমাদেরকে পদ্মা সেতু নিয়ে ৪ বিলিয়ন ডলার দিতে টালবাহানা করছিল, শেখ হাসিনা তখন তাদের তামাশা বন্ধ করে দিলেন এবং দেশের টাকা দিয়েই দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই প্রকল্পের ফান্ড সচল রাখতে প্রবাসী আয় একটি প্রধান উৎস ছিল।  

একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে গত এক দশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি সত্ত্বেও ২০২১ সালে বাংলাদেশ ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আয় লাভ করেছে। তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটিই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। 

তাই শ্রম রপ্তানির প্রবাহ বৃদ্ধি এবং পুরো প্রক্রিয়াকে বৈধকরণের পর আওয়ামী সরকার যে যৌক্তিক পদক্ষেপটি নিয়েছে তা হলো- নতুন কৃষি ক্ষেত্র উদ্ভাবন।

আফ্রিকায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিংও তেমনই একটি পদক্ষেপ। তবে এটি সরকারি সংস্থা, নাকি সরকারি পর্যবেক্ষণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে, তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চুক্তিভিত্তিক চাষবাসের এ প্রকল্প যদি কার্যকরী হয়, তাহলে তা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের শ্রম অভিবাসনের ইতিহাসেও নতুন অধ্যায় যোগ করবে।


  • লেখক: সুবীর ভৌমিক বিবিসির একজন সাবেক সংবাদদাতা এবং লেখক। এর আগে তিনি বিডিনিউজ২৪.কম এর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন।
  • সূত্র: দ্য ফেডারেল                                                  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.