‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন গবেষণা হয় না? কারণ, আমি দেখেছি গবেষণায় বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল’

বাংলাদেশ

13 February, 2022, 01:00 pm
Last modified: 13 February, 2022, 05:50 pm
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার সাক্ষাৎকার।

২০২১ সালের ২৯ আগস্ট চার বছর মেয়াদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার। দায়িত্ব নেওয়ার সময় তিনি পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব ছিলেন। এর আগে তিনি ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি নিজ বিভাগের সভাপতি হন। এ ছাড়া, তিনি তিন বার প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন বুলবুল হাবিব। 

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) :  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে পাঁচ মাস পার করেছেন। এই সময়টা কেমন পার করলেন বা অনুভূতি কেমন?
গোলাম সাব্বির সাত্তার: আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব ডিসটিঙ্গগুইজড ফিচার বা স্বলক্ষণগুলো থাকা প্রয়োজন সে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। কারণ আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমি একটা দায়িত্ব পেয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক এবং বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেছি। আগামী প্রজন্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে কেমন দেখতে চাই, কিভাবে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়ানো যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছি। দেখেছি,  আমরা কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও তা উত্তরণে গুরুত্ব দিয়েছি। এজন্য আমরা গবেষণা এবং পঠনে গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু গবেষণায় বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন গবেষণা হয়না সেজন্য সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দোষারোপ করা হয়। কিন্তু আমি দেখেছি গবেষণায় বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। ১ শতাংশের কিছু কম হতে পারে। বরাদ্দের বেশিরভাগ ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহের জন্য। আমি ইউজিসিকেও বলেছি, সরকারের পক্ষ থেকে আসলে প্রণোদনা এবং উদ্যোগ থাকা জরুরি। শুধুই লেখাপড়াই না, তার পাশাপাশি একটা মনন তৈরি করা, সে মননের জন্য খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড খুবই জরুরি। এজন্য মুজিব শতবর্ষকে কেন্দ্র করে নভেম্বর মাসে আমরা একটা বড় প্রোগ্রাম করেছি এবং সপ্তাহব্যাপী আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি। রাকসুর উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী ক্রীড়া উৎসব করেছি। কারণ আমরা চাই, আমাদের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা পড়ালেখার পাশাপাশি মননের চর্চার জায়গাটা রাখবে। শিক্ষার্থীদের মনন গড়ে তুলতে সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি।

করোনা মহামারি আমাদের যেমন কিছু সমস্যা দেখিয়ে দিয়ে গেছে, আমরা তা সমাধানও করছি। আবার আমাদের সামনে কিছু পথও দেখিয়ে দিয়ে গেছে। যেমন, করোনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা দূর করতে সরকার থেকে আমাদের অফলাইন-অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে, যাকে ব্লেন্ডেড পদ্ধতি বলা হচ্ছে। একসময় করোনা না থাকলেও আমরা এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ ভবিষ্যতে এটা আমাদের চলার পাথেয় হবে। আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি, আমরা টিকবো কি টিকবো না জানি না। এজন্য আমরা আইওটি, রোবোটিক্স, ইনফরমেশন টেকনোলজি, জেনোমিক্সের কথা বলছি। ইতোমধ্যে আমরা এসব বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছি।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছরের একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের প্ল্যান আছে। সেই প্ল্যানের সাথে একাডেমিক প্ল্যানকেও আমরা সংযুক্ত করেছি। একাডেমিক প্ল্যান ৫০ বছরের। ভবনের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা কি হবে তা আমরা নির্ণয় করেছি। কারণ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ভবন না শিক্ষার্থীদের মনভুবনও গড়ে তুলতে চাই। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১২ বছরে দেশের যে অর্থনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, দেশ যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি লাভ করেছে সেই উন্নয়নের ধারাকে বজায় রাখতে আমরা আমাদের অধিত জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে কাজ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানকে বহির্বিশ্বে সম্পৃক্ত করতে এবং মানব কল্যাণের কাজে লাগাতে কাজ করছি। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যেমন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোনো যোগাযোগ নেই, তা দূর করতে আমরা কাজ করছি। এজন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছি।

টিবিএস: আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছিল। আপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ট্রাকের চাপায় ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব বিষয় আপনি ঠিক কিভাবে দেখেন?
সাত্তার: এখানে আপনি দুইটা প্রসঙ্গ এনেছেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে এবং দায়িত্ব নেওয়ার পর। দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে বেশ খারাপ সময়ই গেছে, এটাকে মাৎস্যন্যায়ের মতোই বলা যায়। চার/পাঁচ মাস উপাচার্য ছিলেন না। তার আগে বিগত প্রশাসনের উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের কথা না ভেবে অন্য পথে হেঁটেছেন। আমাদের সবারই তা জানা। এজন্য এটা নিয়ে আমি কথা বলতেও চাই না। তবে এটা আমার দুঃখবোধের বড় কারণ। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে মনে করি, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে, এই পাঁচ মাসের মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। এটা আমি কখনো কল্পনা করি না, আমি চাইও না। আমি সর্বান্তকরণে চাই এটাই যেন শেষ ঘটনা হয়। অন্তত আমার শিক্ষার্থী বা কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারী যাকে আমরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখি সেখানে যেন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেরকম কখনো চাই না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে দায়িত্ব নেওয়ার পরপর আমি বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা এবং এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যেসব বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন আছে, সেই  নিয়মগুলো  অনুসরণ করা এবং কোনো অন্যায় আবদার এবং ন্যায় পরিপন্থী কোনো বিষয়কে আমি প্রশ্রয় দিবো না। আমি যে কোনো প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের সাথে মাঠ পর্যায়ে থাকি এবং শিক্ষকরা আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেন। আমি মনে করি, বিগত পাঁচ মাস আমার যে কার্যকলাপ সেটাকে আরো সুসংহত করা, আরো জবাবদিহিতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া, আরো সুস্পষ্ট করা, একটা ট্রান্সপারেন্সির জায়গায় নিয়ে যাওয়া। ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে যেটা যেকোনো দেশের নাগরিকের জন্য  শুভকর নয়, এই ধরনের কথাবার্তা শোনার জন্য। আমরা সেই ধরনের স্টিগমা থেকে বের হয়ে আসতে চাই। 

টিবিএস: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট?
সাত্তার: সত্যি কথা বলতে গেলে, সন্তুষ্ট সে অর্থে না। এটা স্বীকার করতেই হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় না, এটা দেশের মধ্যে একটা অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়। যে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দাবির মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, শিক্ষার প্রয়োজনের তাগিদে যার প্রতিষ্ঠা। এই অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের  বর্তমান যে পঠন পাঠন সেক্ষেত্রে আমাদের আরও একটু মনোযোগী হতে হবে। আর্থিক দায়বদ্ধতা সরকারের থাকলেও পরিচালনের দায়িত্ব আমাদের। এজন্য আমি শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকদেরও আহ্বান জানাবো তারা যেন বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করে। এটা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির জায়গা না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন কলে ছাঁটা বিদ্যার কথা বলেছেন, সেই কলে ছাঁটা বিদ্যার এটা কোনো কল না কোনো ফ্যাক্টরি না। এখানে যারা থাকবেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় একটা আবেগের নাম, একটা আবেগের জায়গা। যেখান থেকে আমরা উন্নততর জীবনের আকাঙ্ক্ষা দেখি এবং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের সৃষ্টির জায়গা হিসেবে দেখি।

টিবিএস: শিক্ষাকে সন্তুষ্টির জায়গায় নিয়ে যেতে আপনারা কোনো উদ্যোগ নিবেন কি না?
সাত্তার: আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে অনেক প্ল্যান করেছি, শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছি, একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান করেছি, রিসার্চ সেল করেছি, ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে যেন যেতে পারি সে বিষয়ে কাজ করছি। আমাদের অনেক কিছুই আছে, কিন্তু গোছানো নেই দেখে আমরা এগোতে পারছি না, ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে যেতে পারছি না। আমরা ভেরি স্ট্রং রোবাস্ট অপটিক ফাইবার বোন তৈরি করছি যাতে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ৫০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী একসাথে হাইস্পিড ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে, এই ধরনের কাজ শুরু হয়ে গেছে, তারপর অবকাঠামোগত নির্মাণ হচ্ছে, আমরা খেলার মাঠ প্রস্তুত করেছি, মেয়েদের জন্য জিমসিয়ামের মাঠ প্রস্তুত করেছি। সার্বিকভাবে পুরো ক্যাম্পাসে একটা কর্মযজ্ঞ চলছে।

টিবিএস: ৯০ দশকের শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রয়োজনীয় কিনা?
সাত্তার: ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। আমি সবসময় তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আমি যখন ৭০/৮০ দশকের ছাত্র ছিলাম তখন ছাত্র সংসদ ছিলো তা দেখেছি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমি পরবর্তীতে দেখেছি যে, আমাদের যে ছাত্র সংসদ আছে- রাকসু, তার সমন্ধে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ধারণা ক্লিয়ার না। তারা আমার কাছে আসে, রাকসু করবে বলে আসে, আমিও চাই। কারণ নেতৃত্ব থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো সংকট নিরসনে রাকসুর প্রতিনিধিত্বকারীদের সাথে বসে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হতো। আমি মনে করি যে, শিক্ষার অঙ্গণে, শিক্ষার রাজনীতি অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ সেখানে তারা পরিশীলিত মানুষ হিসেবে নিজেরা তৈরি হতে পারে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকার কারণেই ৭০/৮০ দশকের সেই তুখোড়, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ তৈরি হচ্ছে না। এখানে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এইজন্য পরিশীলিত ছাত্র রাজনীতি থাকা প্রয়োজন। তবে বর্তমান যে ছাত্র রাজনীতি সেরকম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মিলে, নিজের উৎকর্ষতা বিধান, নিজের জ্ঞানের জায়গাটা তৈরি করা এবং পারস্পরিক যে সহমর্মিতা, এই জায়গা থেকে ছাত্রদের যে বেড়ে ওঠা, সেই চিন্তা-চৈতন্য থেকে যেন ছাত্র রাজনীতি হয়। তাই শিক্ষার্থীদের সবসময় বলি যে, তোমরা আসো, তোমরা নিজেরা প্রস্তুত হও, তাহলে আমরা দিবো না কেন? তারা যদি প্রস্তুত থাকে, সহমর্মিতার, সহানুভূতির জায়গা থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিবো। এজন্য তাদের জ্ঞানের জায়গায়, যুক্তি ও বিবেচনাবোধের জায়গায় আসতে হবে।
টিবিএস: সিনেটে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন হয় না বহু বছর এ ব্যাপারে আপনার ভাবনা কী?
সাত্তার: সম্পূর্ণ সিনেট  করতে পারলে সেটা আমাদের জন্যই ভালো। আমরা যে কাজ করি বিশেষ করে আর্থিক লেনদেন কিংবা নতুন কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করলে তখন সিনেটের খুব প্রয়োজন হয়। ফলে সম্পূর্ণ সিনেট থাকলে দায়বদ্ধতার জায়গা বেশি তৈরি হয়। ইতোমধ্যে সিনেটে শিক্ষকদের প্রতিনিধি নির্বাচিত আছে, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের নির্বাচন দিতে পারলে সেটা আমাদের জন্যই ভালো। রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের নির্বাচন একটা জটিল প্রক্রিয়া। আমরা রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নিতে আগ্রহী। ইতিমধ্যে আমার প্রশাসন এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি।

টিবিএস:  বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট  দ্বারা পরিচালিত হয়। আপনার বিশ্ববিদ্যালয় কি ১৯৭৩  অ্যাক্ট পুরোপুরিভাবে কার্যকর?
সাত্তার: ৭৩ সালের অ্যাক্ট আমাদের রক্ষাকবচ। আমরা এ পর্যন্ত যা করেছি তা ৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী করেছি। তবে আমার মনে হয় এখানে একটা গ্যাপ আছে। কারণ ১৯৭৩ সালের পরে ১৯৭৫ সালে একটা অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছে। বিশেষ করে প্রায়িই লেখালেখি হয় উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে। তারা অনেকেই হয়তো জানেন না যে ১৯৭৫ সালে নভেম্বরে আরেকটা অর্ডিন্যান্স হয়েছে। সেখানে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সে পরিবর্তনের বিধি অনুযায়ীই মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এখন আমরা সিনেটের মাধ্যমে কেন উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারছি না? কারণ সিনেট একটা বিশাল ব্যাপার। সিনেট যদি সম্পূর্ণ না হয়, সিনেটের অধিবেশন না ডাকলে প্যানেল তৈরি করা সম্ভব হয় না। সেটা যদি না হয় সে ক্লসটাও কিন্তু আইনের মধ্যেই আছে। কাজেই আমি দেখি যে, অনেকে বলে যে, কোনো আইন মানা হচ্ছে না, সেটা ঠিক না। আমাদের ৭৩ অ্যাক্ট আসলে ভায়োলেট করার কোনো সুযোগ নাই। কেউ যদি করে থাকে সেটা দুর্ভাগ্যজনক।

টিবিএস: আপনার পূর্ববর্তী ভিসি নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতায় নানান আন্দোলনের মুখে পড়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ে সমাজে বহু কথা প্রচলিত আছে এসব বিষয়গুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
সাত্তার: খুবই দুর্ভাগ্যজনক, এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে নিজেকেও কেমন যেন লাগে। আপনাদের সোজাসোজি যে কথাটা বলতে চাই, আগে যে পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেখানে যথাযথ পদ্ধতি অনুসৃত হয়নি। আগের ভিসির ১৩৮ জনের যে নিয়োগের বিষয়টি ছিলো, সেটা ভিসির ক্ষমতার মধ্যে একটা জায়গায় বলা আছে, ৩৫ এ, সেটা প্রয়োগ করতে গিয়ে, আমার মনে হয় অপপ্রয়োগ হয়ে গেছে। কারণ অ্যাডহক নিয়োগের বিষয় তো, অ্যাডহক নিয়োগেরও একটি প্রক্রিয়া আছে। তার চাহিদা আছে কিনা, যোগ্যতা আছে কি না, প্রয়োজন আছে না সেই জায়গাগুলো ঠিক করতে হবে। আমি ওই বিষয়টিতে আর কথা বলতে চাই না, কারণ এটা হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বিষয়টি সম্পূর্ণ রহিত করা আছে। সেই বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা অবহিত আছেন।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালায় ২০১৭ তে যোগ্যতা অবনমিত করা হয়েছিলো। আমরা সেই বিষয়টিতেও হাত দিয়েছি। ইউজিসি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বেইজ লাইন তৈরি করে দিয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেই বেজ লাইনের ওপরে থেকে একটা যৌক্তিক, সর্বজনগৃহীত শিক্ষক নীতিমালা তৈরি করা যায়। কারণ আমরা শিক্ষক নিয়োগ দিবো শিক্ষকতার জন্য, অন্যকিছুর জন্য না।

টিবিএস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবছর শিক্ষার্থী ভর্তির আসন সংখ্যা কমিয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কি ভাবছে?
সাত্তার: এই বিষয়ে আমার পক্ষে এককভাবে বলা সম্ভব না। কারণ আমাদের একাডেমিক কাউন্সিল আছে, ভর্তি কমিটি বলে একটা বড় কমিটি আছে, যদিও ক্ষমতাবলে আমি সেই কমিটির প্রধান। কিন্তু ভর্তি সংক্রান্ত যে সকল বিষয় আছে, সব সিদ্ধান্ত তারা নেন। আর বিভাগ বর্ধিত করবো না সংকুচিত করবো, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় একাডেমিক কাউন্সিল। তবে আমরা যদি এরকম যৌক্তিক কোনো বিষয়ে অনুভব করি যে, আমাদের ওভারলোড হয়ে গেছে, ওভার বারডেন হয়ে গেছে সেক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমাদের অনেক বিভাগেই শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ওভারলোডেড হয়ে যাচ্ছে। কারণ শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে শিক্ষক না থাকে সেক্ষেত্রে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কেরও অবনমন ঘটে। তবে যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে এই দূরত্ব কমে যাবে এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। তবে আমরা এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।

টিবিএস: ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষার পরিবেশ পূর্ণতা লাভ করবে কিনা?
সাত্তার: আমি মনে করি। আসলে আমরা শিক্ষার্থীদের দোষারোপই করি কিন্তু তাদের বিষয়ে যত্নবান হই না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে তার মাধ্যমে তাদের জ্ঞানকে পরিশীলিত করা, ক্ষুরধার করা, তাদেরকে বিকশিত করা, এটা কিন্তু ছাত্র সংসদের মাধ্যমেই  তৈরি হবে। কারণ তারাই তো আগামিতে দেশকে নেতৃত্ব দিবে। দেশের বিভিন্নস্থানে কাজ করবে। ফলে দায়িত্বশীল আচরণ করবে। আমার মনে হয়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটা ভালো প্ল্যাটফর্ম।

টিবিএস: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টির মতো হল রয়েছে। হলের আবাসিক সংকটে সরকারি দলের রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনটি সাধারণ ছাত্রদের উপর কর্তৃত্ব করে কিনা?
সাত্তার: আমার মনে হয় এমন হবার কথা না। তবে এমন যদি অভিযোগ আসে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। আমরা কোনো ছাত্রকে দলীয় হিসেবে দেখিনা। আমরা শিক্ষার্থী হিসেবে সবাইকে দেখি। তবে অতীত থেকে কিছু ব্যাড প্র্যাকটিস হয়ে আসছে, আমাদের কানে এসেছে, এ ধরনের অভিযোগে প্রভোস্ট কাউন্সিল নিয়ে মিটিং করেছি। শুধু শিক্ষার্থীদের সিটের বিষয় নিয়ে না, তাদের খাবার দাবার, তাদের স্বাস্থ্যসঙ্গতির বিষয় আছে, মেডিকেল সেন্টারের বিষয় আছে, এসব নিয়ে আমরা কাজ করছি।  এখানে কিছু সমস্যা রয়েছে আমাদের। কারণ ছাত্রদের জন্য যে খাদ্য বরাদ্দ আছে তা খুবই অপ্রতুল। ১৮ টাকা ২৪ টাকাতে আমরা পারিনা। তারপরও দেওয়ার চেষ্টা করি যতটুকু পারি। আমরা এইজন্য প্রভোস্ট কাউন্সিল করেছি। প্রভোস্টরা  ছাত্রছাত্রীদের এসব মৌলিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। আমরা হয়তো সব দূর করতে পারবো না কিন্তু কিছুটা যদি কমিয়ে আনতে পারি তাহলে আমার মনে হয়, তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে।

টিবিএস: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক আবাসন সংকট রয়েছে। ৪০ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে থেকে মাত্র ১০ হাজারের মতো শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা আছে। সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই সংকটকে আপনি কিভাবে দেখেন? নিরসনে কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
সাত্তার: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী আছে। তার বিপরীতে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা আছে ১০ হাজারের মতো। সব মিলিয়ে ১২ হাজারের মতো শিক্ষার্থী হলে থাকে। এর বাইরে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে  মেস করে, বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। এই সংকট নিরসনে আমরা আরও দুইটি হল নির্মাণ করছি। হল নির্মাণ হয়ে গেলে প্রায় ২৫০০ জন ছাত্রছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে। আমরা আরও প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। যত বেশি হলের সংখ্যা বাড়িয়ে আমরা একে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে পারবো তত বেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গল হবে।

ছবি: সংগৃহীত

টিবিএস: দুর্ঘটনায় এক ছাত্রের মৃত্যুর কারণে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পুরো অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সড়কগুলো বেহাল দশা, কোথাও লাইটিংয়ের ব্যবস্থা নাই। আপনি কী মনে করছেন?
সাত্তার: আমি মনে করি, এসব বিষয় নিরসনে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি। তবে হ্যাঁ কিছু কিছু রাস্তার অবস্থা খারাপ। কারণ নির্মাণ সামগ্রী বহনের জন্য বেশিরভাগ রাস্তা খারাপ হয়ে গেছে। ৪০/৫০ টন ট্রাকের লোড সামলানোর উপযোগী রাস্তা নাই। তাই ২০২৩ সাল পর্যন্ত নির্মাণ কাজ রয়েছে, ফলে একটা দুইটা রাস্তা খারাপ থাকবে। এটা মেনে নিতেই হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যতটা সম্ভব গুছিয়ে আনা যায়। তবে অধিকাংশ রাস্তাই আমাদের ভালো। আর আলোর ব্যবস্থা আমরা সবসময় করি। আমরা লাইট দিই, কিন্তু লাইটগুলো দেওয়ার পর বহিরাগতরা খুলে নিয়ে যায়। এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করতে হবে।

টিবিএস: করোনাকালীন সময়ে যখন সবকিছু খোলা রয়েছে তখন শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়ে ক্লাস করা বন্ধ রাখাটা আপনি কতটা যৌক্তিক মনে করেন?
সাত্তার: আমরা যেটা করেছি, আমরা ক্লাস বন্ধ করিনি, আমাদের অনলাইন ক্লাস চালু আছে। তবে আমরা ইন পার্সন ক্লাস বন্ধ রেখেছি। সরকার যেভাবে বলেছিলো, সেটাকেও আমরা কিছুটা অতিক্রম করে, আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে, শিক্ষার্থীদের ওপর ভরসা করে আমরা হল খোলা রেখেছি, একাডেমিক ভবন খোলা রেখেছি, পরীক্ষাগুলো চলছে এবং অনলাইনে ক্লাসও কিন্তু হচ্ছে। সে অর্থে আমরা বন্ধ রাখিনি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই একাডেমিক কাউন্সিলে যেসব লম্বা ছুটি ছিলো, ধর্মীয় ছুটি বাদে, সব বাতিল করেছি। কারণ আমরা চাচ্ছি যে যত দ্রুততম সময়ে তাদের কোর্সগুলো শেষ করে দিতে। কারণ আমরা জানি না, করোনা কবে শেষ হবে? করোনা একটা আনসার্টেনিটি, আমরা জানি না এর শেষ কোথায়? তাই আসলে আমরা সব বন্ধ রেখেছি বিষয়টা এমন বলা যায় না।

টিবিএস: আপনি চার বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। চার বছর শেষে আপনি যখন দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন, তখন আসলে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন জায়গায় দেখে যেতে চান?
সাত্তার: বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় দেখে যেতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে মানুষের যে একটা নেতিবাচক ধারণা আছে, সেটাকে সম্পূর্ণভাবে মানুষের মন থেকে দূর করে দিতে চাই। আমি যখন চলে যাবো, আমি এমন একটা পথ বিনির্মাণ করে দিয়ে যেতে চাই, আমাদের সবাইকে নিয়ে (কারণ বিশ্ববিদ্যালয় একটা সামষ্টিক কনসেপ্ট) যেন আমার পরে যিনি দায়িত্বে আসবেন তিনি যেন বিশ্ববিদ্যালয়কে আমার চেয়ে উন্নততর জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় যেমন হওয়া দরকার, আমরা যে মুক্ত বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনার কথা বলি, যে জ্ঞানচর্চার কথা বলি এবং সর্বোপরি এসকল জ্ঞানকে ধারণ করে যে মানবিক মানুষের কথা বলি, সেই জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি দেখতে চাই।

টিবিএস: টিবিএসকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সাত্তার: আপনাকেও ধন্যবাদ।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.