চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড: অপরিকল্পনার খেসারত দিচ্ছে স্থানীয়রা

বাংলাদেশ

09 February, 2022, 11:30 am
Last modified: 09 February, 2022, 01:01 pm
দুই হাজার ৬৭৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটির কাজ শেষ না হলেও ২০২১ সাল থেকে এই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।

ব্যস্ত মহাসড়ক পার হওয়ার জন্য কোনো স্পিড ব্রেকার, ওভারপাস, আন্ডারপাস বা স্ট্রিটলাইট না থাকায় চট্টগ্রামের আউটার রিং রোডটি আশেপাশের বাসিন্দাদের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় জেলে, গবাদিপশু পালনকারীসহ নগরীর ৮টি ওয়ার্ডের ১৫ লাখ মানুষকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ভাবা হয়নি লাখ লাখ পর্যটকের সুরক্ষার কথাও। এই দীর্ঘ সড়কে দুই পাশে চলাচলকারী এসব মানুষের জন্য রাস্তা পারাপারের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। পথচারীদের সুরক্ষায় নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপও। ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কে নেই স্পিড ব্রেকার, স্ট্রিটলাইট।

ফলে এ সড়কে যান চলাচল শুরু হওয়ার এক বছরে অর্ধশতাধিক দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরেছে স্থানীয় বাসিন্দা, স্কুল ছাত্র এবং পর্যটকসহ ২০ এরও বেশি মানুষের।

চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার আউটার রিং রোডের আশপাশে সিটি করপোরেশনের ৮টি ওয়ার্ডের প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। এই এলাকায় ৯টি মৎস অবতরণ কেন্দ্র (ফিশারি ঘাট), ৩টি যাতায়াতের সড়ক রয়েছে। এসব ঘাটের ওপর নির্ভরশীল ৪ হাজার ১০৫ জন নিবন্ধিত জেলে। এছাড়া সাগর পাড়ে রয়েছে একাধিক গোচারণভূমি।

কিন্তু, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় এসব মানুষকে বিবেচনা করা হয়নি। মহাসড়কের দুপাশের এসব মানুষের চলাচলের জন্য কোন পথ রাখা হয়নি মেগাপ্রকল্পে। ফলে জীবন ও জীবিকা উভয় নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা।

শুক্রবার শেষ বিকেলে আউটার রিং রোডের দক্ষিণ হালিশহর আনন্দ বাজার এলাকার সাগড় তীরবর্তী গোচারণভূমি থেকে গরু নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন মনজুরুল আলমসহ কয়েকজন। সন্ধ্যা নামার আগে তারা একত্রিত হন ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে। গরুর পাল নিয়ে এক কিলোমিটার দূরে ধুমপাড়া দিয়ে সড়ক পার হন তারা। সেখানে রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবহার করতে হয় সড়ক বিভাজনের (ডিভাইডার) ছোট ফাঁকা স্থান। গাড়ি থামাতে লাল পতাকা ধরতে হয় তাদের।

৪৫ বছর বয়সী রাখাল মনজুরুল ৯-১০ বছর বয়স থেকেই এখানে গরু পালন করে আসছেন। কিন্তু এ সড়কটি হওয়ার পর জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত গবাদিপশু পালনের উপর নির্ভরশীল এসব মানুষ। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে তাদের গরু। আর দুর্ঘটনা আতঙ্কে অন্য কাজ ফেলে সারা দিন বসে থাকতে হয় এখানে।

মনজুরুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত এক বছরে ৩০টির বেশি গরু শুধু এই ধুমপাড়ায় দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমাদের পূর্ব-পুরুষেরাও গরু এবং গরুর দুধ বিক্রি করে পরিবার চালাতেন। কিন্তু এ সড়কে চলাচলের রাস্তা না থাকায় অনেকে গরু পালন পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।"

অন্যদিকে, কাঁধে ভারি মাছের ঝুড়ি নিয়ে সন্ধ্যায় অন্ধকারেই দ্রুতগতিতে এই মহাসড়ক পার হন জেলে রিপন দে। মাছের ঝুড়ি নিয়ে ৩০ ফুট অসমতল টিলা বেয়ে নিচে নামেন তিনি। মাছ ধরার সরঞ্জাম, ট্রলারের যন্ত্রাংশ নিয়েও উঠেতে হয় এই উচু টিলায়। সাগর পারের মানুষদের এ সংকট খুব বেশিদিনের নয়। অপরিকল্পিত উন্নয়নই তাদের জীবন-জীবিকাকে কঠিন পথে নিয়ে গেছে।

রিপন দে টিবিএসকে বলেন, "আমার পূর্ব-পুরুষেরাও মাছ ধরে জীবন কাটিয়েছে। আমরাও এ পেশা ধরে বেঁচে আছি। কিন্তু এই সড়কে চলাচলের রাস্তা রাখা হয়নি। আমাদের কথাই বা কে শুনে!"

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) এক সমীক্ষায় চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটের সমস্যা সমাধানে এবং ভবিষ্যত টেকসই যোগাযোগ নিশ্চিতে সমুদ্র তীরবর্তী ট্রাঙ্ক সড়ক সংযোগ উন্নত করার সুপারিশ করা হয়। এ বিষয়টিকে আমলে নিয়ে সাগরের তীরবর্তী বেড়িবাঁধের ওপর আউটার রিং রোড নির্মাণের প্রকল্প নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

২০১৩ সালে একনেক প্রকল্পটির অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালে কাজ পুরো সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও দুটি ফিডার সড়কের কাজ এখনো বাকি।

দুই হাজার ৬৭৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটির কাজ শেষ না হলেও ২০২১ সাল থেকে এই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।

দক্ষিণ হালিশহর এলাকা বেড়িবাঁধের বন্দরটিলা ঘাটের দোকানি মো. আলমগীর টিবিএসকে বলেন, "আমাদের কথা চিন্তা করা হয়নি। পারপারের রাস্তা না থাকায় দোকানের মালামাল আনতেও বিরাট অসুবিধা হয়। আবার বেচা-বিক্রিও কমে গেছে।"

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ বলেন, "এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা সম্প্রসারিতভাবে কাজ করছে। সিএমপিও ইতোমধ্যে তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।"

প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল, চট্টগ্রামের উপকূলীয় বাঁধ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে শহরকে রক্ষা করা। বাঁধের উপর রাস্তা নির্মাণ করে শহর থেকে ভারি যানবাহন এই বাইপাসের মাধ্যমে যাতায়াতের সুবিধা করে চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসন করা।

কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তাবায়নে আউটার রিং রোডের আশেপাশের এলাকায় নতুন করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। পানি নিষ্কাশণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য প্রকল্পটির অধীনে ১১টি স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হয়েছে। এসব স্লুইচ গেটের সঙ্গে খালের সংযোগ নেই। আর চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনালের মাটি ভরাটের কাজে স্লুইচ গেটগুলোর সামনে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। তাই স্লুইচ গেটগুলো এখন অকার্যকর। রেশিরভাগ স্লুইচ গেটের নির্মাণস্থলে খালের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে একনেকে অনুমোদন হলেও আউটার রিং রোড প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। ২০১৪ সালে পতেঙ্গা এলাকা দিয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে সরকার। ২০১৭ সালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অনুমোদন হয় একনেকে।

তবে, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনালের মূল কাজ শুরু হয়নি এখানো। প্রায় একই সময়ে প্রকল্পগুলোর কাজ চললেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছিল না। ফলে নগরীর পতেঙ্গা এলাকাকে কেন্দ্র করে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নকশায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে এখন।

নগরপরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পটি একেবারেই পরিকল্পিতভাবে হয়নি। জনগণ এর সুফল পাবে না। এখানে তিনটা ফিডার রোড হবে। ওইদিকে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল হবে। ওখান থেকে কন্টেইনারগুলো আসবে। তাহলে পর্যটকদের গাড়িগুলো কোথা থেকে আসবে?"

"বিভিন্ন স্থানে জংশন হচ্ছে। এই জংশনগুলোই মরণফাঁদ ও যানজটের কারণ। এখনই এখানে সঠিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন," বলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে আউটার রিং রোড প্রকল্প পরিচালক ও বাস্তাবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, "আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল ও বিমানবন্দর একই স্থানে মিলিত হওয়ায় যানজটের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সব সংস্থার সমন্বয়ে ইন্টারফেস ডিজাইনের কাজ চলছে।"

এছাড়া, আউটার রিং রোড প্রকল্পের কিছু ডিজাইনেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে জানান তিনি। "নতুন একটি ফিডার রোড করা হবে হালিশহরের বড়পোল দিয়ে। নগরীর বিভিন্ন সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সার্ভিস লেন করা হবে। টানেল হওয়ায় এ সড়কে যানবাহনের চাপ অনেক বাড়বে। তাই রিং রোড চার লেনের পরিবর্তে আট লেনে উন্নিত করা হবে," যোগ করেন হাসান বিন শামস।

তিনি আরও বলেন, "জেলেদের চলাচলের স্থানগুলোতে গতিরোধক দেওয়া হবে। স্লুইচগেটগুলো অকার্যকর হয়েছে বন্দরের বে-টার্মিনালের কাজের কারণে। তারা দেয়াল তৈরি করায় পানি প্রবাহে সমস্যা হচ্ছে। তারা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করেনি। কিন্তু আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেছি। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আপাতত ব্লকের বাইরে দেয়াল তৈরি করা হবে। পরে ড্রেন করে দেয়া হবে।"

ঝুঁকিতে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম

আউটার রিং রোডে যানবাহন যাতায়াতের জন্য সাগরিকা থেকে একটি ফিডার সড়ক জহুর আহম্মদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ভেতর হয়ে মূল ফটক দিয়ে নেমেছে। এজন্য স্টেডিয়ামে ইন্টার কমপ্লেক্স এবং মূল ফটক ভাঙা হয়েছে।

ক্ষতিপূরণবাবদ স্টেডিয়ামের ভেতরে অন্য পাশে এসব স্থাপনা নির্মাণ করে দিচ্ছে বলে দাবি সিডিএর। সড়কটি একেবারে স্টেডিয়ামের ভেতর দিয়ে নামায় এখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিরাজউদ্দিন মো. আলমগীর টিবিএসকে বলেন, "পৃথিবীর কোনো আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের মধ্যে মহাসড়ক নেই। অথচ জহুর আহম্মদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ড্রেসিং রুমের কাছ দিয়ে সড়ক নেমেছে। আউটার রিং রোডের পাইলিংয়ের কারণে স্টেডিয়ামের লিফটের কোর দেড় ফুট সরে গেছে। তাই লিফট অকেজো। স্টেডিয়ামের অবকাঠামো দেবে গেছে। পুরো স্টেডিয়াম এখন ঝুঁকিতে।"

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.