প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মেরিন ড্রাইভকে নিরাপদ করে গেলেন সিনহা? 

বাংলাদেশ

03 February, 2022, 02:05 pm
Last modified: 03 February, 2022, 02:15 pm
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের একটি চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। তবে সিনহার মৃত্যুর পর থেকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়কে বন্দুকযুদ্ধের আর কোনো খবর আসেনি।

কক্সবাজারের কলাতলী সমুদ্র সৈকত থেকে টেকনাফ, দীর্ঘ ৮৪ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ রোড। একপাশে সুবিশাল সমুদ্র আরেক পাশে পাহাড়।

সিএনজি বা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে সমুদ্র ধরে পুরো পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। ২০১৭ সালের ৬ মে উদ্বোধনের পর থেকেই দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে কক্সবাজারের মানেই মেরিন ড্রাইভ রোড।

শুরুতে আশীর্বাদ হলেও, ধীরে ধীরে কক্সবাজারের গলার কাঁটা হয়ে উঠে এই রাস্তাটি। ২০১৮ সালে সরকারের মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হলে বাড়তে থাকে বন্দুকযুদ্ধ; নানন্দিক মেরিন ড্রাইভ পরিণত হয় আতঙ্কের সড়কে।

২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুলাই, এই দুই বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে মাদক ব্যবসায়ীদের 'কথিত বন্দুকযুদ্ধের' ঘটনাস্থল হিসেবে গণমাধ্যমে নিয়মিতই খবরের শিরোনামে ছিলো বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা কক্সবাজারের কলাতলী থেকে টেকনাফের সাবরাং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক।

একের পর এক 'বন্দুকযুদ্ধের' খবরে সন্ধ্যার পর মেরিনড্রাইভ রোডে চলাচলই কিছুটা সীমিত হয়ে পড়ে। আতঙ্কে আর অজানা ভয়ে পর্যটক ও স্থানীয় মানুষজন সন্ধ্যার পর এই রোডে তেমন একটা যাতায়াত করতেন না।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের একটি চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। তবে সিনহার মৃত্যুর পর থেকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়কে বন্দুকযুদ্ধের আর কোনো খবর আসেনি।

মেরিন ড্রাইভ সড়ক লাগোয়া ইনানীর শফিরবিলের বাসিন্দা শামীমুল ইসলাম ফয়সাল নামে এক তরুণ জানান, "সিনহা হত্যার আগে প্রতি সপ্তাহেই কারো না কারো লাশ পড়ে থাকত। কখনো সাগরপাড়ে, কখনো মেরিন ড্রাইভ বা তার আশপাশে। পরে গণমাধ্যমে খবর পেতাম পুলিশ, র‍্যাব কিংবা বিজিবির সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' তারা নিহত হয়েছেন।"

এই পথে কক্সবাজার থেকে নিয়মিত যাতায়াত করেন উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরিরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে দীর্ঘ ৪ বছর ধরে চলাচলের সময়কালে বিভিন্ন সময় নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, "এই পথে যাতায়াতের সময়ে বছর তিনেক আগে একদিন দেখলাম সমুদ্রের পাড়ে মানুষের জটলা। পরে শুনলাম সেখান থেকে একটি গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এধরনের ঘটনা দেখিনি।"

বন্দুকযুদ্ধ হ্রাস পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, "পুলিশকে উদ্দেশ্য করে মাদক কারবারিরা এখন আর গুলি ছোড়ে না। তাই আমাদেরও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালাতে হয় না। তাই বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে না। সেটি ছাড়াও কিন্তু বড় ইয়াবার চালান উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।"

কিন্তু চেকপোস্টে তল্লাশির মুখে পড়তে হয় জানিয়ে এই নারী বলেন, "অনেক সময় কক্সবাজারের বাড়িতে ফিরতে দেরি হয় জ্যামের কারণে। সন্ধ্যা ও বিকেলের বেশির ভাগ সময় চেকপোস্টে চেকিংয়ের কারণে অসংখ্য গাড়ি আটকা পড়ে।"

তবে নিরাপত্তার জন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চেকপোস্ট গুলো ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "একবার দেখলাম, বিজিবি সদস্যরা হাজার দশেক ইয়াবা উদ্ধার করেছে কক্সবাজার মুখী একটি সিএনজি থেকে। তবে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে তল্লাশির প্রক্রিয়া আরো শৃঙ্খল হওয়া উচিত।"

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি পরিসংখ্যান সুত্রে পাওয়া তথ্যমতে, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২০ সালে সিনহা নিহত হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রায় দুই বছরে শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান ২৮৭ জন। যার মধ্যে পুলিশের গুলিতে ১৭৪ জন, বিজিবির গুলিতে ৬২ ও র‌্যাবের গুলিতে ৫১ জন নিহত হন।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব বন্দুকযুদ্ধের অন্তত ৫২ টি ঘটনায় ৫৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয় ৮৪ কিলোমিটার আয়তনের মেরিনড্রাইভ সড়ক ও আশপাশের এলাকা থেকে।

এই সময়ে, কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন টেকনাফ উপজেলার ১৬১ জন। যার মধ্যে মেরিন ড্রাইভের বিভিন্ন অংশে হওয়া বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশনা কিংবা তার সরাসরি অংশগ্রহণ ছিলো বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনেও এর খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। "টেকনাফে আসার পর থেকেই তিনি মাদক নির্মূলের আড়ালে 'সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা' করছিলেন৷ ইয়াবা ব্যবসায়ী ছাড়াও স্থানীয় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নিরীহ পরিবারকে টার্গেট করে, তাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে, অনেককে 'ক্রসফায়ারে দিয়ে এবং 'ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে' টাকা আদায়ের 'নির্মম নেশা' পেয়ে বসেছিল তাকে," উল্লেখ করা হয় সেখানে।

২০১৯ সালের ২৩ জুলাই, সকালে মেরিন ড্রাইভ সড়ক-সংলগ্ন উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের চিরাইখালের পাড় থেকে উদ্ধার করা হয় একই উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের টাইপালং এলাকার মৃত দরবেশ আলী সিকদারের ছেলে নজরুল ইসলাম এর লাশ। ঘটনাস্থল থেকে একটি বন্দুক, ৩টি গুলি ও ৫০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

সেসময় উখিয়া থানা পুলিশ জানিয়েছিল, মাদক ব্যবসা নিয়ে আগের দিন রাতে দু'পক্ষের সংঘর্ষে নজরুল নিহত হয়।সেখানকার বাসিন্দারা লাশ উদ্ধারের আগের দিন রাতে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পান বলে জানান নজরুলের স্বজনদের।

নজরুলের লাশ শনাক্তের জন্য সেদিন ঘটনাস্থলে যাওয়া তার এক নিকটাত্মীয় জানান, "নজরুলের লাশ গুলিবিদ্ধ ছিলো, মারা যাওয়ার দুদিন আগে তিনি নিখোঁজ হন। কিন্তু সে কিভাবে মেরিন ড্রাইভে পৌঁছালো এবং কিভাবে মারা গেলো সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাকে সেদিন সেখানকার স্থানীয় লোকেরা বলেছিলো, তারা রাতে গুলির শব্দ শুনেছেন এবং দুটি মাইক্রো গাড়ির হর্ণ ও শুনতে পেয়েছিলেন।"

বন্দুকযুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নিরাপত্তার কারণে মেরিনড্রাইভে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সরব অবস্থান।

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে নতুন করে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিলে সীমান্তসংলগ্ন এলাকা ও পর্যটকের সমাগম থাকায় নিরাপত্তা বিবেচনা করে পুলিশ, বিজিবি,সেনাবাহিনী মেরিনড্রাইভ সড়কে স্থাপন করে ১১ টি বিশেষ তল্লাশি চৌকি যার মধ্যে শামলাপুরের চৌকিতে মৃত্যু হয় সিনহার।

এসব চৌকিতে প্রতিনিয়তই তল্লাশির মুখে পড়তে হয় এই পথে চলাচল করা স্থানীয় থেকে শুরু করে পর্যটকদের। যার একটি রামু ও উখিয়া উপজেলার সংযোগস্থল রেজুখাল সেতুর রামু অংশে স্থাপিত ৩৪ বিজিবির রেজুখাল চেকপোস্ট। যেখানে তল্লাশির ফলে লেগে থাকে জ্যাম, যাত্রীদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। তবে, তল্লাশিতে বিভিন্ন সময় উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা, এমনি অবৈধ স্বর্ণের বারসহ আটক হচ্ছে চোরাকারবারিরা।

এদিকে, সিনহা হত্যার পর শুধু মেরিনড্রাইভ সড়ক নয় সারা দেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা হ্রাস পেয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় ২০২১ সালে মাত্র ৫১ জন নিহত হন বন্দুকযুদ্ধে। তবে এর আগের বছর ২০২০ সালে প্রাণ হারানো ১৮৮ জনের অধিকাংশই মারা যান ৩০ জুলাই এর আগে।

২০১৯ সালে ৩৭৪ জন,২০১৮ সালে একবছরে সর্বোচ্চ ৪২১ জন, ২০১৭ সালে ১৪১ জন ও ২০১৬ সালে ১৭৭ জন বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান বলে উল্লেখ আছে ওই প্রতিবেদনে।

২০১৬ সালে দেশে 'বন্দুকযুদ্ধে' ১৭৭ জনের মৃত্যু হয় বলে উল্লেখ আছে। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা কমে ১৪১ জনে নেমে আসে। ২০১৮ সালে তা আবার বাড়ে। ওই বছরে নিহত হয় ৪২১ জন। ২০২০ সালে তা কমে হয় ১৮৮ জনে। এই মৃত্যুর বেশির ভাগই হয়েছিল সিনহা হত্যার আগে। আর সদ্যসমাপ্ত বছর ২০২১ সালে তা আরও কমে হয় ৫১ জন।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.