বঙ্গোপসাগর আগাতে থাকলে বদলাবে মানচিত্র, সুন্দরবনকে আরো দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বৈষ্ণিক উষ্ণতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা আবারও তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সতর্ক করে তারা বলেছেন, 'পৃথিবীর এই ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে'।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যাচ্ছে হিমালয় ও আল্পসের হিমবাহ, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, বৃষ্টিপাতের মাত্রায় তারতম্য ঘটছে। এতে করে খরা নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হচ্ছে না। আবার প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড় উপকূলকে বিধ্বস্ত করছে প্রতিনিয়ত। ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ বনভূমি 'সুন্দরবন' ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
সম্প্রতি ভারতের আবহাওয়া বিভাগের উদ্যোগে প্রকাশিত 'হ্যাজার্ড অ্যাটল্যাস'-এ প্রতি ৫-৬ বছর অন্তর সুন্দরবনে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই আলাদা। ২০০৯ সালের ২৫ মে সুন্দরবনের ওপর আঘাত হানে ঘুর্ণিঝড় 'আইলা'। পরের ১০ বছর বেশ নিরাপদই ছিল বলা যায়। কিন্তু ২০১৯ সালে 'বুলবুল', ২০২০ সালে 'আম্ফান' এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে 'ইয়াশ'! অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়েছে তিন বার।
বৈষ্ণিক উষ্ণতার ফলে বঙ্গোপসাগরের পানি যেমন ফুলে-ফেঁপে উঠছে, সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতাও বাড়ছে। ১৮৭৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে উত্তর ভারত মহাসাগরে তৈরি হওয়া ৮০ শতাংশ ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে এসেছিল; আর ৪০ শতাংশ ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছিল বাংলার উপকূলে। সারা পৃথিবীতেই সমুদ্রের পানির উষ্ণতা ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি দশকে ০.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে। তবে বঙ্গোপসাগরে প্রতি দশকে পানির তাপমাত্রা বাড়ছে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে।
আইপিসিসির ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির গড় হার ছিল বছরে ৩.৬০ মি.মি.। স্যাটেলাইট নির্ভর অন্য এক গবেষণা (sealevel.colorado.edu) থেকে জানা গিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের পানি প্রতি বছর ৪.০৪ ± ০.৪৪ হারে ফুলে উঠছে। পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে ভূমির অবনমন। 'সাগরের পানির ফুলে ওঠা এবং ভূমির অবনমন মিলে বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর প্রতি বছর প্রায় ৭ মি.মি. হারে বেড়ে উঠছে। এই হার অব্যাহত থাকলে এই শতাব্দীর শেষে বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর বর্তমান অবস্থার তুলনায় ৫৬ সে.মি. উঁচুতে উঠবে। এতে উপকূলের কিছু এলাকা প্লাবিত হবে; ভরা জোয়ারের সীমানা আরও উত্তরে এগিয়ে আসবে। যদিও এতে সুন্দরবন সম্পূর্ণ ডুবে যাবে না।
আবার সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণিঝড় এবং অল্প সময়ের মধ্যে অতিবৃষ্টি। ১৮৭৭ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ভারত মহাসাগরের ৫১৩টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ১৭০টি ছিল অতি সক্রিয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চারটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি সুন্দরবনবাসীর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। প্রতি বারই বাঁধ ভেঙে নোনা জলে ভেসে গিয়েছিল গ্রাম ও কৃষিজমি। আরও বড় সমস্যা হলো আগ্রাসী বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় দ্বীপের ভূমি ক্ষয় করে এগিয়ে আসছে। প্রতিটি ঝড়েই বদলে যায় উপকূলের ভূগোল। এই কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন সুন্দরবনের প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ।
উল্লিখিত চারটির মধ্যে তিনটি ক্ষেত্রে ঝড় ভূমি স্পর্শ করেছিল এমন সময়, যখন ছিল ভরা জোয়ার। এই দুইয়ের সমন্বয়ই বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রথম তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের সময় বঙ্গোপসাগরে জোয়ারের জলের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল যথাক্রমে ৪.২০, ৪.৭৭ এবং ৪.৬৭ মিটার। কিন্তু ইয়াসের সময় ওই উচ্চতা ছিল ৭.৫০ মিটার। বাতাসের গতিবেগের নিরিখে আম্ফান ছিল সব চেয়ে শক্তিশালী।
২১ মে, ২০২০ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার। অন্যদিকে, আইলা ও বুলবুল ধেয়ে এসেছিল ১৩০-১৩৫ কিলোমিটার গতিতে। ইয়াশের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৫৫ কিলোমিটার। গতিশীল বাতাস ফুলে ওঠা জোয়ারের পানিকে এনে ভাসিয়ে দিয়েছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। দুই ২৪ পরগনার ২৩৪ কিলোমিটার নদী বাঁধ এবং ২১ কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল; প্লাবিত হয়েছিল ২১৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। জানা দরকার, সংশ্লিষ্ট স্যাটেলাইটটি ঝড়ের দিন উপকূল এলাকা অতিক্রম করেছিল বিকেল ৫.৪০-৫.৪৫ মিনিটে; যখন নদীতে ভাটার টান বলেই অনেক এলাকার জল নেমে গিয়েছিল। অর্থাৎ, সকালে ঝড়ের সময় প্লাবিত হয়েছিল আরও বিস্তৃত এলাকা।
আগামী কয়েক দশকে সুন্দরবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা পড়বে সে কথা গভীর গবেষণার বিষয়। তবে, এ কথা প্রমাণিত যে ঘন ম্যানগ্রোভই পারে উপকূলকে রক্ষা করতে। সমুদ্র থেকে ঘূর্ণিঝড় জঙ্গলে প্রতিহত হলে শক্তি হারায় এবং অপেক্ষাকৃত কম শক্তি নিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করে। সমুদ্র আর স্থলভাগের মাঝে এই সুন্দরবনের প্রাচীরই ব-দ্বীপের বসতিকে রক্ষা করে। সেই ঔপনিবেশিক কালে যে ৫৪টি দ্বীপ থেকে জঙ্গল কেটে ফেলা হয়েছিল, সেই পথেই ঘূর্ণিঝড় বিনা বাধায় বার বার ব-দ্বীপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। বিপর্যস্ত করেছে মানুষের বসতি এলাকা।
এত বিধিনিষেধ ও সতর্কতার পরেও সুন্দরবনের মূল অঞ্চল থেকে গত দুই দশকে ১১০ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল বিলুপ্ত হয়েছে। ম্যানগ্রোভ বন যে পরিমাণ কার্বন শোষণ করে, তার পরিমাণ আমাজন বনের শোষণ ক্ষমতার থেকেও বেশি। এই বনের উদ্ভিদ ও মাটিতে সঞ্চিত আছে ২১০ লক্ষ টন কার্বন এবং এখনও প্রতি বছর প্রতি হেক্টর বন ৬.৫৪ কিলো টন কার্বন শোষণ করছে। এ ছাড়া পলিসঞ্চয় এবং ভূমির লবণাক্ততা হ্রাসেও ম্যানগ্রোভের ভূমিকা অপরিসীম।
গত কয়েক দশকে বিভিন্ন ভাবে বাঁধ নির্মাণ করে সুন্দরবনে ভূমিক্ষয় রোধ করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেই চেষ্টা সর্বত্র সফলতার মুখ দেখেনি। তবে, বাঁধের সামনে ও পিছনে ম্যানগ্রোভের প্রাচীর নির্মাণ করলে হয়তো ভূমিক্ষয় কিছুটা হ্রাস পাবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। কিন্তু এখন লাগানো গাছ বেড়ে উঠতে প্রায় এক দশক লাগবে। সেই সময় পর্যন্ত প্রচলিত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যেই নদী ও উপকূলীয় বাঁধ রক্ষা করতে হবে।
প্রসঙ্গত, সুন্দরবনের উপকূল রেখা বদলে যাওয়ার অর্থ ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা বদলে যাচ্ছে। এই বিশ্ব-ঐতিহ্য অঞ্চল ও দেশের সীমান্তরক্ষার দায়িত্ব সরকার অস্বীকার করতে পারে না। এই মুহূর্তে জরুরি কাজ হলো সুন্দরবন-মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা। আশার কথা সেই ভাবনা শুরু হয়েছে।
সূত্র: আনন্দবাজারে প্রকাশিত কল্যাণ রুদ্রর লেখা অবলম্বনে