মোবাইল ফোন পরিষেবার দুরবস্থা নিরসনে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ

বাংলাদেশ

23 January, 2022, 11:55 pm
Last modified: 24 January, 2022, 02:45 pm
বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকেও উঠে এসেছে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট গতির শোচনীয় হাল

 

দেশে টেলিকমিউনিকেশন সেবায় গ্রাহকদের নিত্য অভিযোগ; যখন-তখন কল ড্রপ, ইন্টারনেটের দুর্বল গতি, ভয়েস কলের নিকৃষ্ট মান ও দেরিতে কল সংযোগ।  

দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে এসব অভিযোগ, প্রতিনিয়ত যার ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের।

বৈশ্বিক নানান সূচকেও বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেট গতির শোচনীয় চিত্র উঠে এসেছে। যেমন ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ওকলা স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স- এ ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৮তম স্থান লাভ করে। অথচ ইন্টারনেট গতিতে বাংলাদেশের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে আফ্রিকার উগান্ডা ও লিবিয়ার মতো দরিদ্র দেশ।      

কিন্তু ব্যবহারকারীদের কাছে এই দুর্বল ইন্টারনেট পরিষেবার সমাধান ছিল বহুদূরের বিষয়।

মহামারি চলাকালে দৈনন্দিন জীবনে আরও আবশ্যক হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট পরিষেবা। অবশেষে, নাগরিকদের ভোগান্তি দূর করতে দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধানেই এগিয়ে এসেছেন মহামান্য হাইকোর্ট।

রোববার (২৩ জানুয়ারি) জারি করা এক আদেশে মহামান্য হাইকোর্ট দেশের মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহকদের উন্নত মানের স্পষ্ট ভয়েস কল, স্থিতিশীল মোবাইল সংযোগ এবং দ্রুততম ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।

একইসাথে মোবাইল নেটওয়ার্ক, মোবাইল ইন্টারনেট সংক্রান্ত সমস্যা এবং গ্রাহকদের অভিযোগের দ্রুত সমাধানে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) 'অভিযোগ সেলের'কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছেন আদালত।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর্স অব বাংলাদেশ (এমটব)'র একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে এ কমিটি করে দিয়েছেন আদালত।

আদেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

জনস্বার্থে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাইফুর রহমান রাহির দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দেকার দিলিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার রুলসহ এ আদেশ দেন। রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এম এ মাসুম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

ব্যারিস্টার এম এ মাসুম সাংবাদিকদের বলেন, কী পরিমাণ অভিযোগ রয়েছে, কী পরিমাণ নিষ্পত্তি হয়েছে এবং অনিষ্পিন্ন অভিযোগগুলো কিভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে কমিটি। এছাড়াও, অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং করবে এই কমিটি। উন্নত, স্বচ্ছ ভয়েস কল, স্থিতিশীল সংযোগ ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে একটি পূর্নাঙ্গ সুপারিশ উপস্থাপন করবে।

এছাড়াও স্বচ্ছ ভয়েস কল, দ্রুত গতির ইন্টারনেট এবং স্থিতিশীল মোবাইল নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং গ্রাহকের কেনা মোবাইল ইন্টারনেট ডাটার পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতে প্যাকেজে মেয়াদ বাতিল করতে করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ইয়াসির আজমান, রবির প্রধান নির্বাহী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, বাংলালিংকের প্রধান নির্বাহী এরিক আস টাইগার্স ডেন ও টেলিটকের প্রধান নির্বাহী মো. শাহাব উদ্দিন এবং অপর তিন বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাইফুর রহমান রাহি চারটি মোবাইল অপারেটরেরই গ্রাহক। কল ড্রপ, দুর্বল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের মেয়াদসহ নানা ভোগান্তি নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি বিটিআরসিতে অভিযোগ করেন। কিন্তু বিটিআরসির অভিযোগ সেল থেকে এর প্রতিকার না পেয়ে গত ১০ জানুয়ারি তিনি আইনি নোটিশ দেন। বিবাদীদের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে গত সপ্তাহে রুল ও নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। সে রিটের প্রাথমিক শুনানির পরই রুল ও নির্দেশনা দিলেন হাইকোর্ট।

ব্যারিস্টার এম এ মাসুম বলেন, ইন্টারনেটের দুর্বল গতি, ভয়েস কলের নিকৃষ্ট মান ও অস্থিতিশীল নেটওয়ার্কের কারণে গ্রাহকরা চরম ভোগান্তির শিকার হন।

তিনি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, "মহামারি কালে যখন মহামান্য আদালতের কার্যক্রম যখন ভার্চুয়ালি চালিত হচ্ছিল তখন সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অপারেটরদের নেটওয়ার্ক সিগন্যাল অত্যন্ত নিম্ন অবস্থানে নেমে আসে। কেউ ঠিকমতো ফোন করতে বা ইন্টারনেট সংযোগ পাচ্ছিলেন না।" 

মহামারি চলাকালে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষার্থীকে ভার্চুয়াল ক্লাসে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, দিন দিন এসব বিষয় বাজে রূপ নিচ্ছে, যার কোনো বাস্তব উন্নতিও চোখে পড়ছে না। 

তিনি আরও বলেন, "বিটিআরসির অভিযোগ সেল বিভিন্ন সেল বিভিন্ন সময় অভিযোগ গ্রহণ করছে। কিন্তু সেই সেলটি যথাযথভাবে কাজ করছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। যদি কাজ করত তাহলে এসব মোবাইল গ্রাহকদের ভোগান্তিগুলো থাকত না। সে জন্যেই আমরা রিট আবেদনে করেছিলাম।"

টেলিকম পরিষেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ ক্রমে বেড়েই চলেছে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে মোট ২১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, যেখানে ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল মাত্র ১২ হাজার ৮৩২টি। এরমধ্যে মাত্র ৬৪ শতাংশ সমাধান করতে সক্ষম হয় বিটিআরসি। 

জানতে চাইলে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, হাইকোর্টের আদেশের কথা তারা শুনেছেন।

তিনি বলেন, "আমরা ইতোমধ্যেই সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের সমাধানের জন্য একটি ডেডিকেটেড সেল গঠন করেছি। আদালতের আদেশ পাওয়ার পরেই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।"  

তবে টেলিকম বিশেষজ্ঞ এবং শ্রীলঙ্কা ভিত্তিক আইসিটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এলআইআরএন এশিয়া এর সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, বিটিএস (বেইজ ট্রান্সিভার স্টেশন) অপটিক্যাল ফাইবারের সাথে সংযুক্ত না হলে, পরিষেবার মান কখনই উন্নত করা যাবে না। 

তার মতে, "টেলিকম পরিষেবার সামগ্রিক মান নিম্নমানের হতে বাধ্য কারণ বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের তাদের নেটওয়ার্ক স্টেশনে অপটিক্যাল ফাইবার অবকাঠামো ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।"  

সেবাদাতাদের ব্যবসা বাড়লেও, বাড়েনি সেবার মান: 

বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ সেবাদাতাদেরা ব্যবসায়িক আয় এবং গ্রাহকসংখ্যা দুটোই ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

২০২০ সালের মার্চে দেশে মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহক বেড়েছে ১ কোটি ৫৯ লাখ। ২০১৯ সালে দেশে মোট মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫৫ লাখ, যা ২০২১ সালের নভেম্বরে ১৮ কোটি ১৫ লাখে ঠেকেছে।

গ্রাহক বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাপকভাবে বেড়েছে মোবাইল অপারেটরগুলোর আয়ও।

২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসে দেশের বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের আয় করেছে ১০ হাজার ৪৭৯.৭ কোটি টাকা। আর গত বছরের একই সময়ে অপারেটরটির মোট আয় ১০ হাজার ৬৭৮ দশমিক ৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে।

শুধু গ্রামীণফোন নয়, আরও দুটি বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের আয়ও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।

২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে রবি আজিয়াটা লিমিটেড ৫ হাজার ৬৪৪ দশমিক ১ কোটি টাকা আয় করেছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপারেটরটির আয় বেড়ে ৬ হাজার ৯৬ দশমিক ৮ কোটি টাকা হয়।

দেশের তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের আয় ২০২০ সালের ৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর মেয়াদে ৩ হাজার ৫৬৪ দশমিক ৪ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

গতির স্থানীয় মান পূরণে ব্যর্থ অপারেটররা:

২০২১ সালের ডিসেম্বরের ওকলা স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স অনুসারে, স্পিড টেস্টিং সূচকে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৮তম এবং ফিক্সড ব্রডব্যান্ডের গতিতে ৯৪তম।

অথচ উগান্ডা ও লিবিয়ার মতো দরিদ্র অর্থনীতি ও অবকাঠামোর কিছু আফ্রিকান দেশও ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। 

বিটিআরসির সাম্প্রতিক কোয়ালিটি অফ সার্ভিস (কিউওএস) প্রতিবেদনে একই অবস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে। এ প্রতিবেদনে সারা দেশে অপারেটরগুলোর ইন্টারনেট ডাউনলোড এবং আপলোড গতির কোনোটিই মানসম্মত পর্যায়ে পাওয়া যায়নি।

বেশিরভাগ অপারেটরই চতুর্থ প্রজন্মের (৪জি) ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিটিআরসির বেঞ্চমার্ক ছুঁতে পারেনি।

গত সপ্তাহে বিটিআরসি রংপুর বিভাগের কিউওএস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেশের চার মোবাইল অপারেটরের মধ্যে তিনটিই রংপুর বিভাগে ন্যূনতম ৪জি গতি দিতে পারছে না বলে উঠে এসেছে।

তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইলফোন অপারেটর বাংলালিংক এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটকের সঙ্গে বাজারের বৃহত্তম অপারেটর গ্রামীণফোন দীর্ঘদিন ধরে রংপুর বিভাগে ৪জি গতির বেঞ্চমার্ক পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সিলেট ও রাজশাহীতে বাংলালিংক ছাড়া বাকি সব মোবাইলফোন অপারেটরকে ৪জির বেঞ্চমার্কের কম গতি সরবরাহ করতে দেখা গেছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.