সরকারের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা বাড়ছে, বাড়ছে খরচও

বাংলাদেশ

28 December, 2021, 12:30 am
Last modified: 28 December, 2021, 05:34 pm
আনুষ্ঠানিক তথ্যানুসারে, ২০১৬ সালে ৪,০০০টি মামলা দায়ের হয়। এই সংখ্যা তারপরের চার বছর পর্যায়েক্রমে বেড়েছে- ২০১৭ সালে ৬,১০০টি, ২০১৮ সালে ৬,৩০০টি, ২০১৯ সালে ৭,২০০টি এবং ২০২০ সালে ৭,৯০০টি।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের বিরুদ্ধে ৯৫ হাজারের বেশি মামলা চলছে উচ্চ আদালতে।

সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওযার পর বা চাকরিচ্যুত হওয়ার পর পেনশনের টাকা না পেয়ে রিট মামলা করছেন অনেকেই। যথাযথ সময়ে পদোন্নতি না পাওয়ার কারণেও মামলা হচ্ছে। নিয়োগ পরীক্ষায় সকল ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিয়োগ না পাওয়াতেও সরকারের বিরুদ্ধে হচ্ছে এমন রিট মোকদ্দমা। 

এছাড়া, বিভিন্ন আইন-বিধি সংশোধনের জন্য, সরকারি যানবহনে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে, চাকরিতে নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করাসহ নানান কারণে হাইকোর্টে রিট মামলার পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালে এসব মামলার সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার ৮০০, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৭০০-তে।

মামলা দায়েরের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিবছর। আনুষ্ঠানিক তথ্যানুসারে, ২০১৬ সালে ৪,০০০টি মামলা দায়ের হয়। এই সংখ্যা তারপরের চার বছর যথাক্রমে ছিল-  ২০১৭ সালে ৬,১০০টি, ২০১৮ সালে ৬,৩০০টি, ২০১৯ সালে ৭,২০০টি এবং ২০২০ সালে ৭,৯০০টি। 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের  সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের বিরুদ্ধে এরকম প্রায় ৮০ হাজার রিট মামলা হাইকোর্টে চলমান। আর বিভিন্ন আপিল নিস্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে আরও ১৫ হাজার হাজার মামলা।

শুধুমাত্র গত চার বছরেই এসব মামলার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা দাবি পরিশোধ করেছে সরকার।  যার মধ্যে ২০১৯ সালে দিয়েছে ১ হাজার ৮৮ কোটি এবং ২০২০ সালে ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।  প্রতিবেদনটি জানায়, মামলার সংখ্যা আগের বছর ৮৭ হাজার ৮০০টি হলেও, পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৭০০টিতে।  

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এসব মামলায় প্রতি বছর সরকারকে ক্ষতি গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তারা জনগণের অর্থের অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি রক্ষায় এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির পক্ষে মত দেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বলেন, "বেশিরভাগ মামলাই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। এসব দপ্তরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা যত্নবান হলে মামলার চাপ থেকে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকার অনেকটায় মুক্ত হতে পারে।"

আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের তথ্যমতে, ৯৫ হাজার রিট ও আপিলের ৩৫ হাজারই করা হয়েছে ২০১০ সালের আগে। আর গত ১০ বছরে হয়েছে বাকি ৬০ হাজার মামলা। 

এবিএম খায়রুল হক বলেন, "আপিলগুলো দ্রুত নিষ্পন্ন হলে, আর মামলা থাকবে না। কিন্তু দুর্নীতিসহ নানা জটিলতার কারণেই তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে রিট মামলা হচ্ছে।"

সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে যে সংখ্যক আইন কর্মকর্তা রয়েছেন, তা পর্যাপ্ত নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, "নিয়োগের সময়েও আইনজীবীদের দক্ষতা বিবেচনায় নিয়োগ দিতে হবে।"

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার টিবিএসকে বলেন, "সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অনিয়মের কারণেই এ ধরনের মামলার সংখ্যা বেড়েছে। এসব দপ্তরের অনেকেই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আবার অনেকেই আছেন মামলা করাই যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আদালতের উচিত এসব মামলা নিষ্পত্তিতে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত নিষ্পত্তির যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।"

সলিসিটর উইংয়ের তথ্যমতে,  গত ১০ বছরে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনা অনুসারে বিভিন্ন মামলা দাবির প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এ ধরনের দাবিসহ আরও প্রায় ১৮ হাজার রিট এবং আপিল সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট মামলার মধ্যে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের বিরুদ্ধে (এনবিআরসহ) মামলা ১৬ হাজার ৭৩টি।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৪০৫টি মামলা হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে, তারপরেই রয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়- মামলার সংখ্যা ১১ হাজার ৩৮৬টি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন জননিরাপত্তা বিভাগের বিরুদ্ধে ৫ হাজার ৩৮টি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বিরুদ্ধে ৫ হাজার ১০টি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৭৪৭টি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ২ হাজার ২০টি।   

বাদবাকি মামলাগুলো সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিরুদ্ধে।   

প্রতিবেদনটি উল্লেখ করে যে, আরও প্রায় ১ লাখ রিট মামলায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগ সেকেন্ডারি বিবাদী হিসেবে রয়েছে।

সরকার যেভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে: 

অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মোহসীন আলীকে ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরি-বিধিমালা অনুযায়ী তার পাওনা পেনশন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কিছুই তাকে দেওয়া হয়নি। পাওনা চেয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও কোনো সাড়া পাননি তিনি।

এরপর ২০০০ সালের মার্চ মাসে চাকরি ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন মোহসীন আলী। ২০০১ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট এক রায়ে তার চাকরি ফেরতের আবেদন খারিজ করেন। কিন্তু সরকারে কাছে বাদীর পাওনা পেনশনের সকল সুযোগ-সুবিধা বাবদ ২৬ লাখ টাকা ১ মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে সরকারকে নির্দেশ দেন।

ওই বছরই হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করে সরকার। দীর্ঘদিন শুনানি শেষে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। একইসাথে ২৬ লাখ টাকা দিতে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তার সাথে আপিল নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত ওই টাকার সুদ যোগ করার নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য সরকার আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করে ২০০৭ সালেই। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের আপিল বেঞ্চ ওই রিভিউ আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগের রায় বহাল রাখেন।

মোহসীনের আইনজীবী আব্দুল লতিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকারের রিভিউ আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগের রায়েও মোহসীনকে হাইকোর্টের দেওয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী- ২৬ লাখ টাকার সাথে রিভিউ নিষ্পত্তির সময় পর্যন্ত সরকারি ব্যাংকে ওই টাকা এফডিআর হিসাবে রেখে সকল সুদ যোগ করতে বলেন। অবেশেষে মোহসীন আলীকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রায় ৭১ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করে।"

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সরাসরি বিভিন্ন দাবি, ক্ষতিপূরণ, অধিগ্রহণ হওয়া জমির যথাযথ মূল্য পেতে, পেনশনের টাকা পেতে প্রায় ১৮ হাজার রিট ও আপিল রয়েছে। এই মামলাগুলোর বিপরীতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা জড়িত রয়েছে। 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক টিবিএসকে বলেন, "এসব মামলায় একটি স্বার্থান্বেষী মহল অর্থাৎ যারা মামলা পরিচালনার সাথে যুক্ত থাকেন, তাদের একটি বড় অংশ দায়ী। এতে করে যারা ন্যায়বিচার চেয়ে মামলা করে, তারা বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে নিজ জীবদ্দশায় ন্যায়বিচার পান না।"

সমস্যা সমাধানের জন্য আইনজীবীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার পরিবর্তে দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি। 

সলিসিটর বিভাগ বলছে, সুপ্রিম কোর্টে এসব মামলা সাধারণত পরিচালনা করে থাকে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের আইন কর্মকর্তারা। তবে তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের আরও প্রায় নিজস্ব ১,২০০ আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া রয়েছে। 

আইনজীবীদেরকে মামলা পরিচালনার খরচ ও তাদের ফি বাবদ প্রতি বচর প্রায় ৮০০ কোটি টাকা দিতে হয়। গত দশ বছরে প্রায় সাত হাজার কোটি এ বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার অনোয়ারুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এসব বিষয় নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে আইন সচিবের সাথে আলোচনা করেছি। অনিয়মের কারণে চাকুরিচ্যুত হওয়ার পর এবং জমি অধিগ্রহণের পর দখল না ছাড়তে রিটের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এসব ক্ষেত্রে রিট গ্রহণযোগ্য কিনা- সে বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের সাথে আলাপ করবে।" 

তিনি আরো জানান, অনিষ্পন্ন মামলার তালিকা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগে পঠানো হচ্ছে। যাতে তারা দ্রুত সেগুলো নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিতে পারে। 

অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, "মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যেই বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।" 

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, "মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আইন মন্ত্রণালয়ের সাথে এ নিয়ে কয়েকদফা আলাপ করেছে। বেশ কিছু কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, যা প্রধান বিচারপতির সাথে কথা বলে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আশা করি খুব শিগগির সেটি হবে।" 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.