‘পুলিশের উচিত অপরাধের তদন্ত করা, নারীর চরিত্র তদন্ত নয়’

বাংলাদেশ

26 December, 2021, 05:15 pm
Last modified: 26 December, 2021, 05:31 pm
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেছেন, ধর্ষণের মামলার তদন্ত যখন চলমান থাকে, তখন ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে কথা বলাটা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ।

কক্সবাজারের স্বামী-সন্তানকে আটকে রেখে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় পুলিশের 'মুহুর্তে মুহুর্তে ব্রিফিং' নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। 

তারা বলেছেন, ধর্ষণের মামলার তদন্ত যখন চলমান থাকে, তখন ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে কথা বলাটা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে কথা বলা একেবারেই নিন্দনীয় একটি কাজ। ভুক্তভোগী যদি যৌনকর্মীও হয়ে থাকেন তবুও তার চরিত্র নিয়ে কথা উঠতে পারে না। বিশেষ করে, পুলিশের তো একেবারেই উচিত না। এগুলো শুধু অপ্রাসঙ্গিকই নয়, বরং তাদের দায়িত্বে লঙ্ঘনও। একজন পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ব্যক্তির দায়িত্ব অপরাধের তদন্ত করা এবং বিচারের আশ্রয়প্রার্থীকে নিরাপত্তা দেয়া। এ ধরনের মন্তব্য করে তারা এ দুটি দায়িত্বই লঙ্ঘন করছেন।"
 
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ ধারার ১ম অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে সুপ্রিমকোর্টের এই আইনজীবী বলেন, "ধারায় বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীর নাম, পরিচয় ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। তাও কেন এ তথ্যগুলো জনসম্মুখে আসবে? পুলিশের কাজ তদন্ত পরিচালনার শেষে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া, মিডিয়ার সঙ্গে এরকম মুহুর্তে মুহুর্তে ব্রিফিং দেয়া না। আর এই সুযোগটি করে দিচ্ছে মিডিয়াগুলো।"

এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান গত শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেছেন, "তার (ওই নারীর) স্বামীর সঙ্গে ধাক্কা লাগার জের ধরে ঘটনার শুরু বলা হলেও আমরা জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি, ভিকটিমকে যখন আশিক মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন তখন তার স্বামী একটি হোটেলে ব্যক্তিগত কাজে অবস্থান করছিলেন।"

ট্যুরিস্ট পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেছিলেন, "মোটরসাইকেলে তুলে মেইন রোড দিয়েই তারা জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে গেছেন, এ সময় ভিকটিম কোনো ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি করেননি বা আপত্তি জানাননি। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তারা হোটেলে ওঠেন।"

তদন্তের মধ্যেই পুলিশ-র্যাবের ব্রিফিং নিয়ে ২০১৯ সালে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির জামিনের রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছিল, "আজকাল দেখা যাচ্ছে যে, কোনো আলোচিত ঘটনার তদন্ত চলমান থাকলেও পুলিশ-র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি, অভিযুক্ত বিষয় বা তদন্ত সম্পর্কে প্রেস বিফ্রিং করছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি, সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়। অনেক কর্মকর্তাকে অতি উৎসাহ নিয়ে তদন্ত চলছে—এমন বিষয়ে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এসব বিষয় অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। এ বিষয়ে আদালতের একটি রায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

ওই পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছিলেন, "এ কথা সকলকে মনে রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বলা যাবে না যে, তিনি অপরাধী বা অপরাধ করেছেন। তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে গণমাধ্যমে এমনভাবে বক্তব্য দেওয়া যাবে না যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। মামলার তদন্ত পর্যায়ে, তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে গণমাধ্যমকে কতটুকু জানানো যাবে, সে বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা বাঞ্ছনীয়।"

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কক্সবাজারের সাম্প্রতিক ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে দিল যে, এই দেশ আসলে নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। না সেসব বিকৃতমনা পুরুষদের কাছে, না এদেশের ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার জন্য পিতৃতান্ত্রিক অপবাদ প্রয়োগ করা সেসব  আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে।"

তিনি বলেন, "এ ঘটনায় পুলিশ যেভাবে আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর পূর্ব পরিচয়ের বিষয়টি সামনে এনেছে, তাতে তারা পরোক্ষভাবে এটাই প্রমাণ করতে চাইছে যে, একজন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কোনো নারীর 'পূর্ব পরিচয়' থাকা মানে ঐ নারী কোনোভাবেই ভালো চরিত্রের হতে পারে না। যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।"

এই মানবাধিকার কর্মীর মতে, পুলিশের উচিত অপরাধের তদন্ত করা, নারীর 'চরিত্র' তদন্ত নয়, তা না হলে জনগণ পুলিশের ওপর থেকে ভরসা হারিয়ে ফেলবে।

মামলার এজাহার অনুযায়ী, গত বুধবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে স্বামী-সন্তানসহ কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন ওই নারী। এরপর বিকেলে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে ঘুরতে গিয়ে অপরিচিত এক যুবকের সঙ্গে তার স্বামীর ধাক্কা লাগলে কথা-কাটাকাটি হয়। এরপর সন্ধ্যায় পর্যটন গলফ মাঠের সামনে থেকে তার আট মাসের সন্তান ও স্বামীকে সিএনজি অটোরিকশায় করে তুলে নিয়ে যায় একদল যুবক। আর আরেকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এরপর ওই নারীকে নিয়ে যাওয়া হয় জিয়া গেস্ট ইন নামে একটি হোটেলে। সেখানেও আরেকবার ধর্ষণ করা হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন ওই নারীর স্বামী।

এদিকে কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে ওই নারীকে গণধর্ষণের অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) রাতভর অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের এসপি মো. জিল্লুর রহমান।

তবে ধর্ষণকাণ্ডের মূলহোতা আশিকুল ইসলাম আশিক, ইসরাফিল হুদা জয় এবং মেহেদি হাসান বাবু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.