আসামি ধরতে পুরস্কার কতটা কার্যকর? 

বাংলাদেশ

25 December, 2021, 01:55 pm
Last modified: 25 December, 2021, 02:11 pm
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এক ধরনের কৌশলের অংশ হিসেবে এমন অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করে থাকে, এতে করে পালিয়ে থাকা অপরাধীদের মাঝে মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি হয়।

ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত দুজন আসামিকে ধরিয়ে দিতে সম্প্রতি ৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার বা প্রায় ৪৩ কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত পলাতক আসামি মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া ও আকরাম হোসেন নিলয় হলেন এই মামলার আসামি। অভিজিৎ রায়ের মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া সিদ্ধান্তের পর থেকে অপরাধীদের ওপর পুরস্কার ঘোষণা এবং এ ধরনের কৌশলের কার্যকারিতার বিষয়টি সামনে আসে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, পলাতক ব্যক্তিদের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করতে কর্তৃপক্ষ কখনও কখনও পুরষ্কার ঘোষণা করে। এতে করে তাদের চলাচল ব্যাহত হয় এবং এটি তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনার ওপর প্রভাব ফেলে।

পুলিশ এক সাবেক মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অভিজিৎ হত্যাসহ বেশ কিছু জঙ্গি ঘটনায় ২০১৬ সালে পলাতক মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে সে সময় প্রায় ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত পুরস্কারের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় এই দফায় তার খোঁজ মিলতেও পারে।"

"আসামিদের ধরতে বিভিন্ন সময়ে সোর্স ও বিভিন্ন ব্যক্তির পেছনে অর্থ ব্যয় করে থাকে পুলিশ। আসামি ধরতে পুরস্কার ঘোষণাও সেরকমই একটা কৌশল," যোগ করেন তিনি।

এর আগে, ২০১৬-এর ২ আগস্ট দুজন সন্ত্রাসীর সন্ধানদাতার জন্য যথাক্রমে ২০ লাখ ও ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বাংলাদেশ পুলিশ। এছাড়া, জেএমবি নেতা তামিম চৌধুরীর জন্য আরও ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ওই বছরের ২৭ আগস্ট পুলিশের অভিযানে নিহত হন তামিম।

এছাড়া, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা প্রকাশ করে। এসব আসামিদের ধরিয়ে দিতে, ৮ জনের জন্য ১ লাখ টাকা করে এবং বাকি ১৫ জনের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাদের কাউকেই পুরস্কার ঘোষণার পর পর গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আলোচিত এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীরা হলো- সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, কালা জাহাঙ্গির, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেল, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম রাসু, ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আব্দুল জব্বার মুন্না, আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস, আরমান, হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, শামীম আহম্মেদ ওরফে আগা শামীম, জাফর আহম্মেদ মানিক ওরফে মানিক, সাগর ওরফে টোকাই সাগর, মশিউর রহমান কচি, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান, সানজিদুল ইসলাম ইমন, জিসান ওরফে মন্টি কচি ও মশিউর রহমান।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে ১ জন বন্দুক যুদ্ধে নিহত ও একজন গণপিটুনিতে মারা গেছে। এছাড়া, ৮ জন বাংলাদেশের কারাগারে রয়েছে। বাকি ১৩ জন ভারত, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে পলাতক রয়েছে। এদের অনেকেই এখনো ইন্টারপোলের রেড নোটিশে আছেন।

একজন আসামির সন্ধান পেতে এ পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বড় অংকের টাকা ঘোষণা করা হয় শীর্ষ জঙ্গি শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে ধরতে। ২০০৫ সালে সরকার এক কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

তবে শেষমেষ র‍্যাবের হাতেই গ্রেপ্তার হন তারা। এজন্য অবশ্য কাউকে অর্থ পুরস্কার দেয়া হয়নি। প্রচলিত কৌশলেই গ্রেপ্তার হন তারা।

চট্টগ্রামের আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত প্রধান আসামি মুসাকে ধরতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তবে, এখনও মুসার কোন হদিস পায়নি পুলিশ।

দেশে-বিদেশে পলাতক দাগী আসামি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরতে কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণার রেওয়াজ রয়েছে। বাংলাদেশেও ছোট-বড় আসামিদের ধরতে বিভিন্ন সময়ে হাজার থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসামিদের ধরা সম্ভব হয়নি। যে কয়জনকে ধরা গেছে তাদেরকে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই ধরেছেন, নয়তো বা যারা তথ্য দিয়েছেন তারা অর্থ বা পুরস্কার পাওয়ার আশা ছাড়াই খবর দিয়েছেন।

গত দুই দশকে বাংলাদেশে পলাতক আসামিদের ধরিয়ে দিয়ে পুরস্কার ঘোষণার সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সে সময়কার সাংবাদিকদের থেকে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। তাদের মতে, আসলে পুরস্কার ঘোষণা আসামিদের ওপর মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি করে, এতে করে তাদের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হয় এবং অপরাধ জগতে বিচরণ কমে যায়।

তবে, ৫০ বছর আগে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে পলাতক আসামিদের সন্ধান পাওয়ার জন্য যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পুলিশ সদর দপ্তরে পাওয়া যায় নি।

কিন্তু ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা মোট ৭৫জন সন্ত্রাসী ও আসামিদের বিশদ তথ্য আছে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরো (এনসিবি) ঢাকা ডেস্কের কাছে। এদের মধ্যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় ফাঁসির আসামি থেকে শুরু করে, ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মানবপাচারকারীর মতো আসামিরা রয়েছে।

এনসিবি ঢাকার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম টিবিএস'কে বলেন, "ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয় আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য। তবে, বন্দি বিনিময় চুক্তি ও অনান্য জটিলতায় অনেক আসামিদের ফেরত আনা যায় না। ২০১৯ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে সেখানকার পুলিশ গেপ্তার করলেও তাকে এখন পর্যন্ত দেশে ফেরত আনা যায় নি।"

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা টিবিএস'কে বলেন, "কোনো পলাতক কিংবা নিখোঁজ আসামিকে গ্রেপ্তারে পুরস্কার ঘোষণা করা বিশ্বজুড়ে পুলিশিংয়ের একটি ভালো প্র্যাকটিস। যুক্তরাষ্ট্রও বিভিন্ন সময় এভাবে ঘোষণা দিয়ে ভালো ফল পেয়েছে, হয়তো সে কারণেই তারা অভিজিতের হত্যার ঘটনায় এত বড় পুরস্কার ঘোষণা করেছে। আমার মনে হয়, এটা কার্যকর হলেও হতে পারে।"

আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময় এরকম আসামিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, তবে সবক্ষেত্রেই যে ফল পাওয়া যায় বিষয়টি এমন নয়। এই উপমহাদেশ ও আফ্রিকার দেশগুলোতেও এই চর্চা করে অনেক দাগী আসামিদের ধরতে পেরেছে। তবে, পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক তার দায়িত্ব চলাকালীন সময়ের এরকম কোনো পুরস্কার ঘোষণার কথা সুনির্দিষ্টভাবে মনে করতে পারেননি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, "কোনো আসামিকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও পুলিশ তার নিজ তাগিদেই কাজ করে। পুরস্কারের অর্থ পাওয়ার জন্য কেউ আসামি ধরে না। এমনকি আসামি ধরার পর পুলিশ কোন পুরস্কারের অর্থও নেয় না।"

"আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে অপরাধী গ্রেপ্তার করি, তা জেনে গেলে তাকে ধরতে আমাদের বেগ পেতে হয়। অনেক আসামি মোবাইল/ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করে দেয়, বা প্রচলিত কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখে না। এ অবস্থায় প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে আসামিদের ধরা যায় না। তখন পুরস্কার ঘোষণার মতো বিষয়ে জোর দিয়ে তথ্য পেতে হয়,' বলেন তিনি।

দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত আছেন আজকের পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামরুল হাসান। তিনি জানান, কয়েক দশকের সাংবাদিকতায় কখনও পুরস্কার ঘোষণার পর আসামি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এমনটা শোনেননি তিনি।

তিনি বলেন, "এমনকি কখনও আসামি ধরা পড়লেও কেউ পুরস্কারের অর্থের জন্য তথ্য দিয়েছে এমনটাও হয়নি। আসলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এক ধরনের কৌশলের অংশ হিসেবে এমন অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করে থাকে, এতে করে পালিয়ে থাকা অপরাধীদের মাঝে এক ধরনের মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি হয়। তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমনকি অনেক আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে অপরাধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করলেও এই ধরনের ঘোষণার পর তাদের জীবনযাপন ও কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ে।"

"এই কৌশলে অনেক সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, সেক্ষেত্রে বলা যায় পুরস্কার এক ধরনের পুলিশি কৌশল," যোগ করেন কামরুল হাসান।

তিনি আরও বলেন, "আমার যতদূর মনে পড়ে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার দুই দফায় দেশের প্রায় ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকা করে তাদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এদের অনেককেই এখনও ধরা সম্ভব হয়নি, দুই-একজনকে ধরা গেলেও তাদেরকে যে পুরস্কার অর্থের জন্যই ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। সাধারণ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়েই পুলিশকে তথ্য দিয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান মনে করেন, আসামি ধরতে পুরস্কার ঘোষণা এক ধরনের প্রনোদণা যাতে সাধারণ মানুষ আসামি ধরতে, অবস্থান শনাক্ত করতে ও পুলিশকে তথ্য দিতে এগিয়ে আসে। এটা যে সবক্ষেত্রেই কার্যকরী, তা বলা যাবে না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই উপায় কার্যকর হয়েছে।

মোখলেসুর রহমান বলেন, "আমি কর্মরত থাকা অবস্থায় অন্তত দুটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা মনে করতে পারি, যে ঘটনাগুলোতে পুরস্কার ঘোষণার পর আসামিদের ধরা সম্ভব হয়েছে। এমনকি ওই দুটি ঘটনাতে সন্ধানদাতাদেরকে ঘোষিত পুরস্কারের টাকাও হস্তান্তর করা হয়েছে।

তবে আসামি ধরতে পুরস্কার ঘোষণা পুলিশের এক ধরনের ব্যর্থতা কিনা এমন প্রশ্নে মোখলেসুর রহমান টিবিএস'কে বলেন, শুধু বাংলাদেশ পুলিশই নয়, পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের পুলিশ আসামি ধরতে নাজেহাল হলে পুরস্কার ঘোষণা করে থাকে। কারণ তারা অনেক সময় কৌশলে আত্মগোপনে থাকে, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যেও তাদের ধরা সম্ভব হয় না। এসব পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে, তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরস্কার ঘোষণা একটি কার্যকরী উপায় বলে মনে করেন তিনি।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.