‘সমন্বয়হীনতায়’ বারবার আগুন কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্রে

বাংলাদেশ

27 April, 2024, 09:30 am
Last modified: 27 April, 2024, 09:29 am
আগেরবার অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি

গত চার বছরে তিনবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সিলেটের কুমারগাঁওয়ে বিদ্যুতের ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রে। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে আবার আগুন লাগে। ওইদিন সকালে লাগা এ আগুনে সিলেট নগর ও আশপাশের এলাকার লক্ষাধিক গ্রাহক প্রায় ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল। 

কেপিআইভুক্ত দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনায় কেন বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে সমন্বয়হীনতার কারণে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।

এর আগে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে এই উপকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ওই সময় সিলেট নগরীসহ আশপাশের এলাকায় টানা ৩১ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল আরেকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে। 

২০২০ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ১৯৬৭ সালে স্থাপিত উপকেন্দ্রটির প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন না করা এবং কর্তৃপক্ষের সঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করে দুর্ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশগুলো আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। 

বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রহমত উল্লাহ্ মো. দস্তগীরকে আহ্বায়ক করে গঠিত সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশে বলা হয়, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) নিয়ন্ত্রণাধীন ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের ইকুইপমেন্টসের কন্ট্রোল ও প্রটেকশনের জন্য ডিসি সিস্টেম (ডিসি সোর্স ব্যাটারি, চার্জার ও ডিস্ট্রিবিউশন প্যানেল) এবং বিউবোর (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩ কেভি বাস ও ইকুইপমেন্টসের কন্ট্রোল ও প্রটেকশনের জন্য ডিসি সিস্টেম জরুরিভিত্তিতে সম্পূর্ণ পৃথক করতে হবে।

এছাড়া ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন, জরুরি ভিত্তিতে গ্রাউন্ডিং সিস্টেম বৃদ্ধিপূর্বক যথাযথ মানে উন্নয়ন/সম্প্রসারণ করা, ভূগর্ভস্থ কন্ট্রোল ক্যাবলিং সিস্টেম জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা, ফল্ট লেভেল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৩২ কেভি ও ৩৩ কেভিতে প্যারালালে সংযুক্ত পাওয়ার ট্রান্সফরমারগুলো জরুরিভিত্তিতে পৃথক করা, পাওয়ার ট্রান্সফরমার, কারেন্ট ট্রান্সফরমার, পটেনশিয়াল ট্রান্সফরমার, সার্কিট ব্রেকার ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্টসমূহ উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন বলেও সুপারিশ করা হয়।

এছাড়াও এই কমিটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দক্ষ কারিগরি জনবল দিয়ে দেশের সব গ্রিড উপকেন্দ্র পরিদর্শনের ব্যবস্থা, উপকেন্দ্রের সংরক্ষণ কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে তদারকি আরও জোরদার করা, উপকেন্দ্রের পরিচালন ও সংরক্ষণ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য পিজিসিবি ও বিউবোর আলাদাভাবে জনবল পদায়ন করা এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করে।

এছাড়া গ্রিড উপকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্টগুলো নিয়মিত পরীক্ষা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং এসব যন্ত্রপাতির জন্য হিস্ট্রি বুক সংরক্ষণ করা, জরুরি ভিত্তিতে কুমারগাঁও ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের বিকল্প সোর্স তৈরি করার সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।

ওই প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, 'প্রতিটি গ্রিড বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাইবার সিকিউরিটি ও ফিজিক্যাল সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করা প্রয়োজন। লোকবল স্বল্পতার দোহাই দেয়া হয়, কিন্তু নিজেদের আপগ্রেড করার বিষয়ে কাউকেই ততটা আন্তরিক মনে হয় না। রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের দায়িত্বহীনতায় এই দুর্ঘটনার জন্য অনেকটাই দায়ী। সিলেট অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য জনগণের যে অবর্ণনীয় কষ্ট ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার জন্যও এরা দায় এড়াতে পারে না।'

তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতেও তখন নির্দেশ দেন প্রতিমন্ত্রী।

সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির মঙ্গলবার বলেন, কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। জেআইএস নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এটি বাজেটের অভাবে কিছুদিন বন্ধ ছিল; এখন আবার শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নিরাপত্তা অবস্থা আরো জোরদার হবে।

তিনি বলেন, 'এখানে মূল সমস্যা হলো সমন্বয়হীনতা। এখানে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ (পিডিবি) বেসরকারি আরও কয়েকটি বিদ্যুৎ কোম্পানির যন্ত্রপাতি রয়েছে। সবার মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। আমরা সবাইকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চিঠি দিচ্ছি।'

আবদুল কাদির আরও বলেন, এটি পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় অনেক যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে গেছে। নতুন গ্রিড সাবস্টেশন হচ্ছে। কাজ শেষ হলে সেখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে। 

প্রসঙ্গত, গত ১৫ এপ্রিল সোমবার সকাল ৯টার দিকে কুমারগাঁও উপকেন্দ্রের ভেতরের ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩৩ কেভি লাইনের নিচে বিদ্যুতের হাইভোল্টেজের তার ছিঁড়ে স্পার্কিং হয়। ওই সময় নিচে ডাম্পিং করে রাখা পরিত্যক্ত এয়ার ফিল্টারে আগুন লেগে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট এসে এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। 

আগুন নিভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা বেলাল হোসেন বলেন, এয়ার ফিল্টারগুলো সেখানে রাখা ঠিক হয়নি। সেগুলো দাহ্য হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.