শুল্কছাড়ে স্থানীয় পর্যায়ে গাড়ি সংযোজনে আকৃষ্ট হচ্ছে আরও অনেক ব্র্যান্ড

বাংলাদেশ

18 April, 2024, 10:35 am
Last modified: 18 April, 2024, 01:04 pm
সর্বশেষ অটোমোবাইল নীতিমালা অনুসারে, ২,৫০০ সিসি ক্ষমতা পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল করা গাড়ির জন্য কর ও শুল্ক দিতে হবে ২৫–৩৫ শতাংশ, যেখানে পুরোপুরি তৈরি করা আমদানিকৃত ১,৬০০ সিসি গাড়ির জন্য ট্যাক্স ও শুল্কহার ১২৭ শতাংশ।

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

কোভিড মহামারির পর দেশের গাড়ির বাজারে গাড়ির দাম প্রতি ইউনিটে ৫০ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও বৈশ্বিক গাড়ি নির্মাতারা স্থানীয়ভাবে গাড়ি সংযোজনের দিকে ঝুঁকছে। গাড়ির দাম কমাতে ও বিক্রি বাড়াতে সরকারের দেওয়া বৃহৎ শুল্ক সুবিধা ও কর-ভ্যাট মওকুফের ফলে দেশে প্ল্যান্ট স্থাপনে উৎসাহিত হচ্ছে এসব নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

২০২২ সালের মাঝামাঝিতে শুল্ক সুবিধা চালুর পর কোরিয়ার হুন্দাই-এর মতো শুরুর দিকে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের মন্দার বাজারেও সাফল্য পায়। এরপর থেকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একই সুযোগ গ্রহণের জন্য কোরিয়ান গাড়ি নির্মাতা অপর প্রতিষ্ঠান কিয়া এবং জাপানের মিতসুবিশি আগ্রহী হয়েছে।

বাংলাদেশে কিয়া মোটরস-এর দীর্ঘদিনের অংশীদার মেঘনা অটোমোবাইলস গাজীপুরের বরমীতে একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। সেখানে শীঘ্রই স্পোর্ট ইউটিলিটি গাড়ি [এসইউভি] সংযোজন শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।

এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্য নিয়ে গাজীপুরের ভবানীপুর এলাকায় একটি গাড়ি শিল্প পার্ক স্থাপন করছে র‍্যানকন গ্রুপ। এ বছরের শেষ প্রান্তিকের মাঝে সেখানে মিতসুবিশি এবং প্রোটন গাড়ি রং ও সংযোজন করার পরিকল্পনা করেছে এটি। আগামী বছর এমজি গাড়িও সংযোজন করবে র‍্যানকন।

চেরি এবং, কমপ্যাক্ট গাড়ি নির্মাতা সুজুকির মতো উদীয়মান বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোও পাইপলাইনে রয়েছে। এছাড়া হোন্ডা গাড়ির পরিবেশক ডিএইচএস মোটরস স্থানীয় পর্যায়ে গাড়ি সংযোজনের জন্য হোন্ডার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।

সর্বশেষ অটোমোবাইল নীতিমালা অনুসারে, ২,৫০০ সিসি ক্ষমতা পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল করা গাড়ির জন্য কর ও শুল্ক দিতে হবে ২৫–৩৫ শতাংশ, যেখানে পুরোপুরি তৈরি করা আমদানিকৃত ১,৬০০ সিসি গাড়ির জন্য ট্যাক্স ও শুল্কহার ১২৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ক্রয়ক্ষমতা এবং জ্বালানিসাশ্রয়ী হওয়ার কারণে দেশের বাজারে ১,৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির উচ্চ চাহিদা রয়েছে। দেশের সড়কে চলা মোট গাড়ির ৭০ শতাংশ ১,৬০০ সিসি সক্ষমতার।

শীঘ্রই আসছে কিয়ার ৪ এসইউভি মডেল

মেঘনা অটোমোবাইলস-এর নির্বাহী পরিচালক আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, গাজীপুরের বরমীতে স্থাপিত তাদের প্ল্যান্টটি শীঘ্রই কিয়া'র ৪টি এসইউভি মডেল সংযোজন শুরু করতে প্রস্তুত হয়েছে।

গতবছর প্রায় ৪০০টি আনকোরা আমদানিকৃত গাড়ি বিক্রি করেছে কিয়া। প্রতিষ্ঠানটি এখন স্থানীয়ভাবে সংযোজন শুরুর প্রথম বছরে এক হাজারেরও বেশি ইউনিট বিক্রি করবে বলে আশা করছে।

আনিসুজ্জামান বলেন, '১০–২০ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে আরও মূল্য সংযোজনের সঙ্গে সঙ্গে বার্ষিক বিক্রি আরও বাড়ার কথা।'

তার মতে, বাংলাদেশে আরও অ্যাসেম্বলি লাইন স্থাপিত হলে ক্রমবর্ধমান বাজারে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কোম্পানিগুলোকে লাভের পরিমাণ কমাতে হতে পারে। ফলে বাজারে বর্ধিত প্রতিযোগিতার জেরে গাড়ির দাম কমে আসবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

আনিসুজ্জামান বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের অ্যাসেম্বলিং এবং পেইন্টিং মূল ব্র্যান্ডের বৈশ্বিক মান অনুযায়ী সম্পন্ন হওয়ায় গ্রাহকেরা স্থানীয় উৎপাদনের মূল্যসুবিধা পছন্দ করছেন।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১,৬০০ সিসি'র একটি এসইউভি'র দাম ৪০–৬০ লাখ টাকা, যেখানে স্থানীয়ভাবে সংযোজিত গাড়িগুলোতে আমদানি করা গাড়ির তুলনায় ৭–১২ লাখ টাকা সাশ্রয় করা যায়।

আরেক কোরিয়ান গাড়িনির্মাতা হুন্দাই গত বছরের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে ফেয়ার টেকনোলজিস কারখানায় গাড়ি পেইন্টিং ও অ্যাসেম্বলিং শুরু করে।

কোম্পানিটির বার্ষিক বিক্রি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ২০২৩ সালে এক হাজার ১৫৮ ইউনিটে পৌঁছায়, যা ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির বাজারের এক-তৃতীয়াংশ।

বাজার অংশীদারিত্বে তৃতীয় স্থানে হুন্দাই

নতুন ও রিকন্ডিশন্ড উভয় ধরনের গাড়ির ক্ষেত্রে হুন্দাই গত বছর টয়োটা ও হোন্ডা'র পরে তৃতীয় বৃহত্তম বাজার অংশীদারিত্ব অর্জন করেছে।

মূলত হুন্দাই ক্রেটা ও টাকসনের মতো স্পোর্ট ইউটিলিটি গাড়ির দাম ১৭–১৮ শতাংশ হ্রাসের কারণে এমন অর্জন সম্ভব হয়েছে। এ মূল্যে এসব গাড়ি ক্রেতাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ও লাভজনক বিবেচিত হয়েছে।

অন্যদিকে টয়োটা, হোন্ডা, মিতসুবিশি, কিয়া, নিসান, এমজি'র মতো প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কারণে তাদের গাড়ির দাম কমানোর কোনো সুযোগ পায়নি।

সর্বশেষ কর নীতির প্রভাব

বিভিন্ন অটোমোবাইল ব্র্যান্ডের দীর্ঘদিনের পরিবেশক র‍্যানকন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, তাদের গ্রুপ মিতসুবিশি, এমজি এবং প্রোটন গাড়ি উৎপাদনের জন্য ঢাকার কাছে স্থানীয় অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে।

তিনি বলেন, র‍্যানকন মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার এসইউভি সংযোজন করে আসছিল। তবে অটোমোবাইল শিল্প স্থানীয়করণের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দুবছর আগে বড় হারে কর ও শুল্ক কমানোর আগে স্থানীয়ভাবে সংযোজন করেও গাড়ির দাম কমানো যায়নি।

আগে গাড়ির কাঠামো, ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ স্থানীয়পর্যায়ে সংযোজনের ক্ষেত্রে করহার কমে ৮৬ শতাংশ ছিল, যা সম্পূর্ণ আমদানিকৃত গাড়ির ১২৭ শতাংশ করের তুলনায় পর্যাপ্ত ব্যয়সাশ্রয়ী হতে পারেনি।

তবে নতুন নীতিমালায় স্থানীয় এবং আমদানিকৃত গাড়ির মধ্যে শুল্কের ব্যবধানকে বাড়িয়ে এসব গাড়িকে আরও ব্যয়সাশ্রয়ী করে তোলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ উল্লেখ করেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে গাড়িকে বিলাসবহুল বস্তু হিসেবে বিবেচনা করে সবসময় গাড়ির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

'তবে নতুন নীতিমালা এ দিকটিকে পরিবর্তন করতে পারে। এতে গাড়ি আরও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে,' বলেন তিনি।

উত্তরা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান বলেন, স্থানীয় উৎপাদনের ধারায় যোগ দিতে একটি স্থানীয় কারখানার কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন।

ভারতের মতো, মধ্যম আয়ের পরিবার এবং ব্যবসার জন্য সুজুকি গাড়িগুলোকে আরও ব্যয়সাশ্রয়ী করতে তার গ্রুপ চট্টগ্রামে একটি গাড়ি সংযোজন প্ল্যান্ট স্থাপন করছে।

ব্যবসায়িক শর্তাবলির বিষয়ে মূল প্রতিষ্ঠান সুজুকি'র সঙ্গে এখনো আলোচনা চললেও মতিউর রহমান ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে চট্টগ্রামে গাড়ি তৈরি শুরু করার আশা করছেন।

নিটল নিলয় গ্রুপের আব্দুল মাতলুব আহমাদ উল্লেখ করেন, তাদের কোম্পানি টাটা গাড়ির জন্যও নিজেদের কারখানা প্রস্তুত করেছে। ভারতীয় বাজারে তৃতীয় বৃহত্তম শেয়ার থাকা কোম্পানিটির আমদানিকৃত গাড়ির দাম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বেশি চাহিদা দেখা যায়নি।

কর নীতিতে যা আছে

১,৬০০ সিসি'র একটি গাড়ি যদি সম্পূর্ণরূপে নির্মিত ইউনিট (সিবিইউ–কমপ্লিটলি বিল্ট ইউনিট) হিসেবে আমদানি করা হয়, তাহলে আমদানি মূল্যের ওপর মোট কর এবং শুল্ক পড়ে ১২৭ শতাংশ।

তবে অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা–২০২১ অনুসারে, পর্যাপ্ত বিনিয়োগসহ প্রতিষ্ঠিত এবং কিছু মূল্য সংযোজন মানদণ্ড পূরণ করা গাড়ি কারখানাসমূহ যদি রংবিহীন যন্ত্রাংশ সংযোজন করে, তাহলে যন্ত্রাংশ আমদানিমূল্যের ওপর সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মোট কর ও শুল্ক পরিশোধ করতে পারবে। আমদানিকৃত রং করা যন্ত্রাংশ সংযোজনের জন্য মোট কর দাঁড়ায় প্রায় ৩৭ শতাংশে।

উভয়ই পেট্রোল বা ডিজেলচালিত গাড়ির সিবিইউ ইউনিটের জন্য প্রযোজ্য মোট কর ও শুল্কের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। হাইব্রিড গাড়ি আমদানিকারকেরা বর্তমানে মোট কর ও শুল্কের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিশোধ করেন।

বাংলাদেশের গাড়ি শিল্পের ভবিষ্যৎ

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা প্রগতি বাংলাদেশে গাড়ি সংযোজনের পথিকৃৎ। পরে চট্টগ্রামে প্রোটন গাড়ি উৎপাদন শুরু করে পিএইচপি অটোমোবাইলস।

প্যাসিফিক মোটরস, র‍্যানকন এবং মা এন্টারপ্রাইজের মতো কোম্পানিগুলোও অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা–২০২১-এর আগেই হুন্দাই, মিতসুবিশি এবং ডিএফএসকে ব্র্যান্ডের গাড়ি সংযোজন করেছিল।

মহামারির সময়ে হোসেন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর প্রতিষ্ঠান বাংলা কারস গাড়ির চ্যাসিস, কাঠামো, ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ আমদানি ও নারায়ণগঞ্জে নিজস্ব কারখানায় সেগুলো সংযোজন করে প্রথম স্থানীয় গাড়ি প্রস্তুতকারক হয়ে ওঠে।

ডলার সংকটের কারণে আমদানি চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এটি তিন বছরে কমদামে প্রায় ৫০০টি এসইউভি বিক্রি করেছে। কোম্পানিটির আরও গাড়ি বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত বছর মূল্যবৃদ্ধি ও আমদানি সমস্যার কারণে দেশের গাড়ির বাজার ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ওই সময় প্রায় ২৪ হাজার যাত্রীবাহী যানবাহনের মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি ছিল জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি।

স্থানীয়ভাবে তৈরি টু-হুইলার গাড়ির জন্য সরকার শুল্ক ও কর কমানোর সুযোগ দেওয়ার পর হিরো রানার এবং অ্যাটলাসকে অনুসরণ করে হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি, বাজাজ, টিভিএস-এর মতো বৈশ্বিক বড় বড় কোম্পানিগুলো স্থানীয় পর্যায়ে কারখানা স্থাপনে আকৃষ্ট হয়েছিল। ফলে পাঁচ বছরে এ ধরনের গাড়ির বাজার তিনগুণ বেড়েছে। নিটল নিলয় গ্রুপের মাতলুব আহমাদ বলেন, ক্রয়ক্ষমতা হাতের নাগালে এলে টু-হুইলার বাজারের এ সাফল্য গাড়ির বাজারেও দেখা যেতে পারে।

কিয়া'র আনিসুজ্জামান চৌধুরী বিশ্বাস করেন, স্থানীয়ভাবে সংযোজন করা গাড়ি ধীরে ধীরে আমদানি করা গাড়ির বাজারের অংশীদার হয়ে উঠবে।

ডিএইচএস মোটরসের জেনারেল ম্যানেজার আরমান রশিদ স্থানীয় উৎপাদনকেই ভবিষ্যৎ বলে মনে করছেন।

'যদি না আমদানি করা গাড়িগুলো ভিন্নধর্মী কিছু অফার করে, সেগুলো স্থানীয়ভাবে সংযোজিত গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে উঠতে পারবে না,' তিনি বলেন।

এদিকে অটোমোবাইল শিল্পের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকার গাড়ি রপ্তানি এবং যন্ত্রাংশ তৈরির লক্ষ্যও ঠিক করেছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.